প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য

মার্চ ১৫, ২০১৬

 

রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)

দীপক সেনগুপ্ত

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬)

১০। যাদুবিদ্যা


(আগের অংশ)   প্রতি সন্ধ্যায় আমি যখন পুলের কাছে যেতাম, আমার সঙ্গে দু’জন লোক থাকত। তারা মইটি বয়ে নিয়ে আসত এবং আমি পিলারের উপরে উঠে পড়লে আমার হাতে রাইফেলটা তুলে দিয়ে মইটা নিয়ে চলে যেত।

দ্বিতীয় দিনে আমরা যখন পুলের কাছে পৌঁছেছি, তখন সাদা আলখাল্লা পরা একটি লোক চোখে পড়ল; তার হাতে রয়েছে ছ’ফুট লম্বা রূপোর একটি ক্রুশ এবং মাথায় ও বুকের কাছে চকচকে কিছু একটা লাগান রয়েছে। কেদারনাথের দিক থেকে সে পুলের কাছে আসছিল। পুলের কাছে পৌঁছে সে ক্রুশটি সামনে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে প্রণামের ভঙ্গিতে মাথা নীচু করল। এর পর উঠে দাঁড়িয়ে কিছু দূর হেঁটে আবার একই ভাবে বসে হাঁটু গেড়ে প্রণাম করল। দীর্ঘ পুলের সমস্ত পথটিই সে এভাবে পেরোল।

আমার কাছে পৌঁছে সেলাম জানানোর ভঙ্গিতে সে হাতটা তুলল, কিন্তু তাকে গভীর প্রার্থনারত মনে করে আমি কোন কথা বললাম না। তার মাথা ও বুকের কাছে চকচকে যা চোখে পড়েছিল দেখলাম সেগুলি রূপোর ক্রুশ।

আমার সঙ্গের লোকেরা সেই লোকটি সম্বন্ধে আমার মতই কৌতূহলী ছিল। সে যখন উঁচু রাস্তা ধরে রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের দিকে এগোচ্ছিল, তখন তারা জিজ্ঞাসা করল, সে কি ধরণের লোক, কোথা থেকেই বা এসেছে? লোকটি যে খ্রিষ্টান সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আমি তাকে কথা বলতে শুনিনি তবে তার লম্বা চুল এবং ঘন সৌখিন কাল দাড়ি দেখে তাকে উত্তর ভারতের লোক বলেই মনে হল।

পরের দিন সকালে আমি মই বেয়ে নেমে এসে ইনস্পেকশন বাংলোর দিকে চললাম। যদি আমাকে মানুষখেকোটির খোঁজে কোথাও না যেতে হত তাহলে এই বাংলোতেই দিনের বেলাটা কাটাতাম। আসার পথে সেই সাদা পোষাকের লোকটিকে দেখলাম একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে সে এগিয়ে এসে আমাকে অভিনন্দন জানালো। আমার প্রশ্নের জবাবে সে বলল যে সে অনেক দূর থেকে এসেছে গাড়োয়ালের মানুষ যে দুষ্ট আত্মার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তা থেকে তাদের মুক্ত করার জন্যই। আমি জানতে চাইলাম কি করে সে এটা করবে। উত্তরে সে জানাল বাঘটির একটা প্রতিকৃতি তৈরি করে মন্ত্র পড়ে সে দুষ্ট আত্মাটিকে এর মধ্যে প্রবেশ করাবে এবং পরে সেটাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে, যেখান থেকে সেটা সাগরে গিয়ে পড়লে আর ফিরে এসে মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না।

লোকটি যা করতে চাইছে সে সামর্থ তার আছে কি না সে সন্দেহ আমার ছিলই, কিন্তু আমি তার বিশ্বাস ও চেষ্টার প্রশংসা না করে পারলাম না। প্রতিদিন আমি পিলার থেকে নেমে আসার আগেই সে তার জায়গায় এসে পৌঁছোত এবং আমি যখন সন্ধ্যাবেলা পুলের কাছে যেতাম তখন চোখে পড়ত সে চেরা বাঁশের টুকরো, দড়ি, কাগজ ও সস্তার রঙিন কাপড় দিয়ে তার ‘বাঘ’ তৈরি করছে। তার কাজ যখন প্রায় হয়ে এসেছে তখন একদিন ঝড় বৃষ্টিতে তার সমস্ত পরিশ্রম বানচাল করে ‘বাঘ’টি ভেঙেচুরে গেল। কিছুমাত্র না দমে গিয়ে পরের দিন থেকেই সে নতুন উদ্যমে গান গাইতে গাইতে আবার কাজে লেগে গেল।

অবশেষে সেই দিনটি এল যখন ঘোড়ার আকারের বাঘের প্রতিকৃতিটি সে নিজের মনের মত করে তৈরি করল। দেখলে পরে কোন চেনা প্রাণীর সঙ্গেই সেটির কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গ্রামের লোকদের মধ্যে সকলেই ‘তামাশা’ দেখতে ভালবাসে। মূর্তিটিকে একটা লম্বা লাঠির সঙ্গে বেঁধে ঢালু পথ বেয়ে নদীর ধারে বালির উপর যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন শ’খানেক লোক নানা বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে তার অনুসরণ করল।

নদীর একেবারে ধারে গিয়ে মূর্তিটিকে লাঠি থেকে খুলে সাদা পোষাকের লোকটি তার লম্বা ক্রুশটি হাতে নিয়ে বালির উপরে হাঁটু গেড়ে বসে দুষ্ট আত্মাটিকে মুর্তির মধ্যে প্রবেশ করালো। এরপর প্রচুর ঢাক ঢোলের শব্দের সঙ্গে সেটিকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল। দ্রুত গতিতে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলল মুর্তিটি; এই শুভ কাজে প্রচুর ফুল এবং মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল।

পরের দিন থেকে সেই পরিচিত লোকটিকে আর দেখা গেল না। খুব ভোরে যারা নদীতে স্নান করতে যেত সেরকম কিছু লোককে আমি জিজ্ঞাসা করলাম লোকটি কোথা থেকে এসেছে বা কোথায় গিয়েছে তারা কিছু জানে কি না। উত্তরে তারা জানাল একজন সাধু কোথা থেকে আসে এবং কোথায় চলে যায় এসব প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস কে দেখাবে?

এইসব কপালে তিলক কাঁটা লোকেরা যারা সেই লোকটিকে পবিত্র ও সাধু বলে উল্লেখ করেছিল এবং নদীর ধারে ‘বাঘে’র প্রতিকৃতি ভাসানোর দলে ছিল তারা সকলেই ছিল হিন্দু।

ভারতবর্ষের মত দেশে যেখানে মানুষের কোন পরিচয় পত্র নেই, ‘কালাপানি’ পেরিয়েছে এরকম কিছু লোককে বাদ দিলে, ধর্ম বিষয়টি এত প্রাধান্য পায় যে একজন লোক গেরুয়া কাপড় পরে ও ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে অথবা কপালে ও বুকে ক্রুশ চিহ্ন লাগিয়ে খাইবার পাশ থেকে ‘কেপ কমোরিন’ (কন্যাকুমারী) অবধি ঘুরে আসতে পারে - কেউই তাকে সে কোথায় যাচ্ছে বা কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করবে না।

    

১১। অল্পের জন্য রক্ষা

তখনো আমি রুদ্রপ্রয়াগের পুলটি পাহারা দিয়ে চলেছি। সে সময়ে একদিন ইবটসন তার স্ত্রী জিনকে নিয়ে পাউড়ি থেকে এসে উপস্থিত হল। ইনস্পেকশন বাংলোয় জায়গা ছিল খুবই কম, এজন্য তাদের বাংলোটি ছেড়ে দিয়ে যাত্রীপথের একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে আমার চল্লিশ পাউন্ড ওজনের তাবুটি খাটালাম।

যে জন্তুটি বহু মাইল জুড়ে প্রায় প্রতিটি বাড়ির দরজা ও জানলায় তার আঁচড়ের দাগ রেখে গেছে সেটা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য তাবুটি নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়। সেজন্য আমি আমার লোকদের বললাম তারা যেন কাঁটা ঝোপ দিয়ে তাবুর চারপাশটা ঘিরে দেয়। তাবুর পাশেই জমির উপর একটা ক্যাকটাস প্রজাতির গাছ দাঁড়িয়ে ছিল, প্রায় পয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে ঝুঁকে ছিল এই গাছটি। এটির ডালপালা তাবু খাটানোয় বাধা সৃষ্টি করায় আমি গাছটিকে কেটে ফেলতে বললাম। কিছুটা কাটা হয়ে যাবার পর আমি মত বদলালাম। কারণ, সম্পূর্ণ কেটে ফেললে দুপুর রোদে ছায়াটুকুও থাকবে না; সুতরাং আমি গাছটি না কেটে ডাল গুলি শুধু ছেঁটে ফেলতে বললাম।     

ছোট তাবুটিতে আমরা ছিলাম মোট আটজন। রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে আমি কাঁটা ঝোপ দিয়ে প্রবেশ পথটি বন্ধ করে দিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল মানুষখেকোটি অনায়াসে গাছটির উপরে উঠে আমাদের উপর লাফিয়ে পড়তে পারে। যাই হোক, তখন রাত হয়ে গেছে, করার কিছুই ছিল না; ঠিক করলাম পরের দিন সকালেই গাছটি কেটে ফেলতে হবে।

আমার সঙ্গের লোকদের জন্য আলাদা তাবু ছিল না; আমি ঠিক করলাম তারা ইবটসনের লোকদের সঙ্গে ইনস্পেকশন বাংলোর বাইরের ঘরে শুলেই ভাল হয়। কিন্তু এতে তারা আপত্তি জানাল কারণ, সে ক্ষেত্রে আমাকে একা খোলা তাবুতে রাত কাটাতে হবে। রাতে আবিষ্কার করলাম আমার রাঁধুনিটি অত্যন্ত নাক ডেকে ঘুমোয়। সে আমার থেকে মাত্র একগজ দূরে শুয়েছিল মেবং তার পাশেই আমি যে ছ’জন লোককে নৈনিতাল থেকে নিয়ে এসেছিলাম তারা গাদাগাদি করে শুয়ে ছিল।

রাতটি ছিল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। মাঝরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি শুনতে পেলাম বাঘটি গাছের ডালে উঠছে। আমার গুলি ভরা রাইফেলটা বিছানার পাশেই ছিল, সেটিকে টেনে নিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাঁটা থেকে পা বাঁচাতে চটিজোড়া পায়ে সবে ঢুকিয়েছি এমন সময় বাইরের গাছটি থেকে একটা প্রচন্ড শব্দ শুনলাম এবং পরক্ষণেই রাঁধুনিটি ‘বাঘ বাঘ’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। এক লাফে আমি তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম এবং রাইফেলটা ঘুরিয়ে তাক করার আগেই বাঘটি পাশের জমির উপর লাফিয়ে পড়ল। কাঁটা ঝোপ সরিয়ে আমিও জমিটির কাছে এলাম, সেটি ছিল চল্লিশ ফুটের মত চওড়া এবং কোন ফসল তাতে ছিল না। আমি খুঁটিয়ে আশেপাশের ঝোপঝাড় ও পাথর গুলি দেখতে লাগলাম; ঠিক সেই সময়ে বহুদূরে একটা শেয়ালের ডাক শুনে বুঝলাম, বাঘটি আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে।

রাঁধুনিটি পরে আমাকে জানিয়েছিল যে যখন চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল তখন বাঘের আঁচড়ের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায় এবং তাকিয়েই তার দৃষ্টি সোজা বাঘের মুখের উপর গিয়ে পড়ে, বাঘটি তখন লাফিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

গাছটি পরের দিনই কেটে ফেলা হল। যদিও এর পরে কয়েক সপ্তাহ আমরা তাবুতে ছিলাম, কিন্তু রাতের ঘুমের ব্যাঘাত কখনও ঘটে নি।

(চলবে)

 



লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।