প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য

মে ৩০, ২০১৬

 

রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)

দীপক সেনগুপ্ত

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭)

১২। জিন ট্র্যাপ


(আগের অংশ)   গ্রামবাসীদের অনেকের মুখেই শুনলাম যে মানুষখেকোটি তাদের ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে, আমি নিজেও রাস্তায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছি; এসব দেখে শুনে বুঝতে পারলাম সেটি এ তল্লাটেই আছে। ইবটসন আসার কিছুদিন পরে খবর পেলাম বাঘের আক্রমণে একটি গরু মারা পড়েছে। জায়গাটি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে দু’মাইল এবং আমি যে আখরোট গাছে খড়ের গাদায় বসেছিলাম সেখান থেকে আধ মাইল দূরে।

গ্রামটিতে পৌঁছে দেখি চিতাটি এক-কামরা একটি ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে থাকা গরুদের মধ্যে একটিকে মেরে দরজার কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। দরজা দিয়ে সেটিকে বের করতে না পেরে চৌকাঠে বসেই বেশ খানিকটা মাংস খেয়ে চলে গেছে।

ঘরটি গ্রামের প্রায় মাঝখানে। ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম কয়েক গজ দূরের একটা বাড়ির দেয়ালে ফুটো করে মৃত গরুটির দিকে নজর রাখা যায়। এই বাড়িটির এবং গরুগুলির মালিক একই ব্যক্তি, অতএব কাজটির জন্য সম্মতি আদায় করতে কোন অসুবিধাই হল না। সন্ধ্যা হতেই আমরা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সঙ্গে আনা স্যান্ডউইচ ও চা খেয়ে নিলাম। এরপর পালা করে রাত জেগে ফুটোটি দিয়ে বাইরে নজর রেখে বসে রইলাম। কিন্তু সারারাত বসে থেকেও চিতাটির দেখা মিলল না, কোন শব্দও শুনলাম না।

পর দিন সকাল বেলা গ্রামের লোকেরা আমাদের গ্রামটি ঘুরে দেখাল। গ্রামটি মোটামুটি বড় ধরণের এবং বহু বছর ধরে বাঘটি বাড়ির লোকদের ধরার জন্য দরজা জানলায় যে আঁচড় কেটেছে সেগুলিও দেখলাম। একটি দরজায় দেখলাম নখের আঁচড়ের দাগ খুব গভীর; এটি হল সেই ঘরটি যেখানে বাঘটি দরজা ভেঙে চল্লিশটি ছাগলের সঙ্গে থাকা একটি ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

দিন দুয়েক বাদে খবর পেলাম বাংলো থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে পাহাড়ের উপরে একটা ছোট গ্রামে একটা গরু মারা পড়েছে। এখানেও চিতাটি গরুটিকে মেরে দরজার কাছে টেনে এনে কিছুটা অংশ খেয়ে চলে গেছে। দরজার দিকে মুখ করে দশ গজ দূরে ষোল ফুট উঁচু একটি নতুন খড়ের গাদা ছিল, গাদাটি ছিল জমি থেকে ছ’ফুট উঁচুতে একটা মাচানের উপর তোলা।

গরুটি মারা যাবার খবর খুব সকালেই আমাদের কাছে পৌঁছেছিল, কাজেই সমস্ত দিনটিই ছিল আমাদের হাতে। আমরা কাজে লেগে গেলাম এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত খেটে আমরা একটা মাচান তৈরি করে ফেললাম যেটা আমাদের মতে শুধু যে কার্যকরী ছিল তাই নয়, শিল্পের ছোঁয়াও তাতে ছিল।

শুরুতে খড়গুলি সব সরিয়ে ফেলে সেখানে খুঁটি পুঁতে একটা ভারা বেঁধে ফেললাম এবং প্রথম মাচানটির চার ফুট উঁচুতে দ্বিতীয় মাচানটি তৈরি হল; এবার সামান্য একটু জায়গা খালি রেখে দু’ইঞ্চি ফোকরোয়ালা তারের জাল দিয়ে পুরোটা ঘিরে দিয়ে গোছা গোছা খড় এনে সমস্ত কাঠামোটি এবং তারের ফোকর গুলিও ঢেকে দেওয়া হল। হঠাৎ দেখলে আগের সঙ্গে কোন তফাৎ ধরা পড়বে না। বাড়ির অপর একজন মালিক কয়েকদিনের জন্য বাইরে গিয়েছিল, সে ফিরে এসে বিশ্বাসই করতে পারল না যে সেখান থেকে আগের খড় সরিয়ে দ্বিতীয় একটি মাচানের উপর গাদাটিকে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।

সূর্য অস্ত যাবার কিছু আগে মাচানে প্রবেশ করে প্রবেশ পথটি শক্ত করে বন্ধ করে দিলাম। ইবটসন আমার চেয়ে একটু খাটো হওয়ায় সে উপরের মাচানটিতে উঠল। আরাম করে বসে আমরা খড়ের গাদায় দু’টো ফুটো তৈরি করে নিলাম যার মধ্য দিয়ে গুলি করা চলে। বাঘটি যখন আসবে তখন যেহেতু আমাদের কথা বলার কোন সুযোগ থাকবে না, সেজন্য ঠিক হল, চিতাটিকে যে আগে দেখবে সে ই গুলি করবে। রাতটি ছিল চাঁদের আলোয় ভরপুর, কাজেই টর্চ ব্যবহারের কোন প্রয়োজন হবে বলে মনে হল না।

সন্ধ্যাবেলা খাওয়া দাওয়া সারা হয়ে গেলে গ্রামটি নিঃশব্দ হয়ে পড়ল। রাত দশটা নাগাদ আমি পেছনের পাহাড় বেয়ে চিতাটিকে নেমে আসতে শুনলাম। খড়ের গাদার কাছে এসে সে চুপ করে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল, পরে আমি যে মাচানটিতে বসে ছিলাম তার নীচ দিয়ে গুড়ি মেরে সে এগোতে লাগল। আমার মাচানের নীচে ঠিক এক তক্তা দূরত্বে তার মাথাটা এসে থামল। আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। আমি আশা করেছিলাম যে এইবার তার মাথাটা মাচানের বাইরে বেরোবে এবং আমি তিন চার ফুট দূর থেকে গুলি করার সুযোগ পাব। ঠিক এই সময়ে উপরের মাচান থেকে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল। বাঘটি ডান দিক দিয়ে সজোরে বেরিয়ে পাহাড় বেয়ে দৌড়ে উপরে চলে গেল, আমার দেখার কোন সুযোগই হল না। ইবটসনের দু’টি পায়েই খিল ধরে যাওয়ায় নড়ে বসতে গিয়েই শব্দটি হয়েছিল। বাঘটি এতটাই ভয় পেয়েছিল যে সে রাতে তো বটেই, পরের রাতেও আর শিকারের কাছে ফিরে আসে নি।

দু’রাত পরে রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের দু’শ গজ দূরে পাহাড়ের উপরে একটি গরু মারা যাবার খবর পাওয়া গেল।
গরুটির মালিক একাই একটা নির্জন ঘরে থাকত। বাড়িটির একটি মাত্র ঘর; সেখানে তক্তা দিয়ে দেয়াল তুলে শোয়ার ঘর ও রান্নাঘর বানিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সে রাতে লোকটি শুতে যাবার আগে রান্নাঘরের দরজাটি বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। রাত্রিবেলা শব্দ শুনে জেগে উঠে দরজা দিয়ে আসা চাঁদের আবছা আলোয় দেখতে পেল যে চিতাটি তক্তা ভেঙে তার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। যখন একটির পর একটি তক্তা ভাঙার চেষ্টা চলছে, লোকটি তখন শুয়ে শুয়ে ঘামছিল। শেষে কোন তক্তাই সরাতে না পেরে বাঘটি রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় এবং ঘরের পাশেই বেঁধে রাখা একটি গরু মেরে তার দড়িটি ছিঁড়ে ফেলে। কিছু দূর গরুটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বেশ খানিকটা মাংস খেয়ে খোলা জায়গায় ফেলে রেখে চলে যায়।

পাহাড়ের গায়ে যেখানে গরুটির দেহাংশ পড়েছিল তার কুড়ি গজ দূরে একটা বড় আকারের গাছ ছিল। গাছটির উপরের দিকের ডালে একটি খড়ের গাদা রেখে দেওয়ায় মাচানের মত একটা কাঠামো তৈরি হয়েই ছিল। এই মাচানের ঠিক নীচে পাহাড়টি কয়েক শ’ ফুট নেমে উপত্যকায় মিশেছে। আমি ও ইবটসন এই মাচাটিতেই বসব ঠিক করলাম।

মানুষখেকোটিকে মারার সুবিধার জন্য কয়েক দিন আগে সরকার থেকে একটা ‘জিন ট্র্যাপ’ পাঠানো হয়েছিল। আশি পাউন্ড ওজনের এই ট্র্যাপটি ছিল পাঁচ ফুট লম্বা; এরকম ভয়াবহ জিনিস আমি এর আগে খুব কমই দেখেছি। এর ধারাল দাঁত গুলি ছিল তিন ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এবং চব্বিশ ইঞ্চি ‘হাঁ’ করা এই ট্র্যাপটি ফাঁক করতে দুটি শক্তিশালী স্প্রিং চেপে ধরার জন্য দু’জন লোকের দরকার হয়।

শিকার ছেড়ে চিতাটি একটা চব্বিশ ফুট চওড়া জমির উপর দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ ধরে এগিয়ে তিন ফুট উঁচুতে উঠে জঙ্গলে ঘেরা আর একটা জমি ধরে চলে গেছে। এই তিন ফুট উঁচু জায়গায় আমরা ফাঁদটা পাতব ঠিক করলাম এবং চিতাটি যাতে সন্দেহ না করে সেজন্য কিছু ঝোপ ঝাড় দিয়ে জায়গাটা ঢেকে দিলাম। ফাঁদের সঙ্গের আধ ইঞ্চি চওড়া স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটা লোহার শেকল তিন ইঞ্চি ব্যাসের একটা আংটার মধ্য দিয়ে নিয়ে জমিতে শক্ত করে পোঁতা একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হল।

এসব আয়োজন শেষ হয়ে গেলে জিন ইবটসন (ইবটসনের স্ত্রী) আমাদের লোকজনের সঙ্গে বাংলোয় ফিরে গেলেন। ইবটসন ও আমি খড়ের গাদার উপর উঠে পড়ে আমাদের সামনে একটা ডাল বেঁধে কিছু খড় ঝুলিয়ে একটা পর্দার মতন করে আরাম করে বসলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম এবার বাঘটা পালাতে পারবে না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। রাত ন’টার আগে চাঁদ ওঠার কথা নয়, কাজেই লক্ষ্য ঠিক করে গুলি করার জন্য আমাদের টর্চের আলোর উপরেই নির্ভর করতে হবে। এই টর্চটা ছিল একটি জটিল ধরণের ভারী যন্ত্র। ইবটসন ঠিক করেছিল যে গুলিটা আমিই করব, সেজন্য একটু কষ্ট করে টর্চটা রাইফেলের সঙ্গে বেঁধে নিলাম।

অন্ধকার নেমে আসার ঘণ্টা খানেক পর ঘন ঘন ক্রুদ্ধ গর্জন শুনে বুঝতে পারলাম যে বাঘটা ফাঁদে পড়েছে। টর্চটা জ্বেলে দেখলাম সে সামনের পা খাঁচায় বদ্ধ অবস্থায় লাফাচ্ছে। আমি গুলি চালালাম, কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে আমার .৪৫০ বুলেটটি খাঁচার শেকলে লেগে সেটিকে ছিঁড়ে দিল।
খুঁটি থেকে ছাড়া পেয়ে খাঁচাটি সামনের পায়ে আঁটকে থাকা অবস্থাতেই বাঘটি কয়েকটা বড় লাফ দিয়ে জমির উপর দিয়ে ছুটল। আমার বা দিকের নল থেকে ছোড়া গুলি এবং ইবটসনের শট-গান থেকে ছোড়া দুটি জোরালো বুলেট কোনটিই তার গায়ে লাগে নি। আমি রাইফেলে গুলি ভরতে গিয়ে টর্চটির কিছু অংশ নড়ে যাওয়ায় সেটি অকেজো হয়ে পড়ল।

বাঘের গর্জন ও চারটি গুলির শব্দ শুনে রুদ্রপ্রয়াগ বাজার ও কাছেপিঠের সব গ্রামের লোকেরা চারিদিক থেকে দল বেঁধে লন্ঠন ও পাইনের মশাল জ্বেলে আমাদের দিকে ছুটে এল। তাদের বাড়ির বাইরে বেরোতে নিষেধ করার কোন মানে হয় না, কারণ তারা এত আওয়াজ করছিল যে আমাদের কোন কথা শুনতেই পেত না; সুতরাং আমি রাইফেলটি নিয়ে নীচে নেমে পড়লাম এবং ইবটসন যে পেট্রোলের বাতিটি সঙ্গে নিয়ে মাচানের উপর উঠেছিল সেটি জ্বালার চেষ্টা করল। বাতিটি দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে আমার হাতে দিয়ে ইবটসন নীচে নেমে পড়ল এবং আমরা দু’জনে মাঠের মধ্য দিয়ে বাঘটি যে দিকে গেছে সেদিকে এগোলাম। জমিটার মাঝামাঝি জায়গায় ঢিপির মত একটা বড় পাথর বেরিয়ে ছিল। ইবটসন আলোটা দু’হাত দিয়ে মাথার উপরে তুলে ধরল এবং আমি গুলি ভরা রাইফেলটি নিয়ে তার পাশে পাশে এগোতে লাগলাম। পাথরটা পেরিয়ে জমিটা একটু নেমে গেছে, এখানেই চিতাটি আমাদের দিকে মুখ করে গর্জন করতে শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার ছোঁড়া বুলেটটা বাঘটির মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেল। উত্তেজিত জনতা তখন তাদের দীর্ঘ দিনের শত্রুটিকে ঘিরে আনন্দে নাচতে শুরু করেছে।

আমার সামনে যে জন্তুটি মরে পড়ে আছে সেটি একটি বড় আকারের পুরুষ চিতা। যে অঞ্চলে এটি মারা পড়েছে সেখানের বহু মানুষ মানুষখেকোটির আক্রমণে মারা পড়েছে, কাজেই এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এ বাঘটিই সেই মানুষখেকো। কিন্তু যে রাতে আমি মেয়েটির মৃতদেহের কাছে বসেছিলাম তখন যে বাঘটিকে দেখেছিলাম, এ বাঘটি যে একই বাঘ এটা বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। এটা ঠিকই যে সে রাতটা ছিল অন্ধকার এবং বাঘটির অস্পষ্ট অবয়বটাই শুধু দেখা গিয়েছিল, তবু এখন যে বাঘটিকে আমার সামনে সবাই মিলে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য একটা লম্বা লাঠির সঙ্গে বাঁধছে সেটা যে মানুষখেকোটি নয় এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম। যাই হোক, প্রথমে ইবটসন, তার পিছনে বাঘটি বয়ে নিয়ে যাওয়া লোকজন এবং সবার শেষে কয়েক শ’ লোকের একটা জনতা - সবাই মিলে বাজার হয়ে বাংলোর দিকে এগোতে লাগল।

আমি যখন হোঁচট খেতে খেতে পাহাড় বেয়ে নামছি, তখন সে দলে আমিই ছিলাম একমাত্র লোক যে বিশ্বাস করে নি যে রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাটিই মারা পড়েছে। এ প্রসঙ্গে আমার বহুদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি তখন খুবই ছোট এবং এটা ঘটেছিল আমাদের শীতকালীন আবাসের খুব কাছেই। বহু বছর পড়ে ‘ব্রেভ ডিডস’ নামক বইতে কাহিনীটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সেটা আমি পড়েওছি। ঘটনাটি এরকম – আই. সি. এস. স্মেটন ও বন বিভাগের ব্রেডউড দু’জনে মিলে এক অন্ধকার ঝড়ের রাতে ডাক গাড়ি করে মোরাদাবাদ থেকে কালধুঙ্গির দিকে যাচ্ছিলেন। তখনও রেল ব্যবস্থা চালু হয় নি। একটা রাস্তার মোড় ঘুরতেই তারা একটা পাগলা হাতির মুখোমুখি পড়ে যান। চালক ও ঘোড়া দু’টিকে মেরে হাতিটি গাড়িটিকে উলটে দেয়। ব্রেডউডের সঙ্গে রাইফেল ছিল। ঢাকা খুলে সেটি বের করে গুলি ভরে তিনি যখন প্রস্তুত হচ্ছেন স্মেটন তখন ভাঙা গাড়ি থেকে একটি মাত্র আলো যেটি জ্বলছিল সেটি বের করে আনলেন। স্মেটন তখন আলোটি মাথার উপর তুলে ধরে ব্রেডউডকে গুলি করতে সাহায্য করেন। এটা ঠিকই যে একটা পাগলা হাতি আর চিতাবাঘ এক জিনিস নয়; কিন্তু খুব কম লোকই পায়ে হেঁটে আহত, যন্ত্রণা-কাতর একটা চিতা বাঘের পিছু নিতে সাহস করবে। তবে দু’টি ক্ষেত্রেই মাথার উপর আলো তুলে ধরে সঙ্গীকে গুলি করতে সাহায্য করার মিল রয়েছে। পরে দেখেছিলাম চিতা বাঘটির থাবাটি ছিঁড়ে গিয়ে শুধু চামড়াটুকু ‘জিন ট্র্যাপে’র সঙ্গে লেগে ছিল।

বহু বছর পরে এই প্রথম বাজারের প্রতিটি বাড়ির দরজা খুলে বাড়ির মহিলা এবং ছেলেমেয়েরা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের গতি ছিল খুবই মন্থর, কারণ কিছু দূর অন্তর ছোট ছেলেমেয়েদের দেখাবার জন্য বাঘটিকে মাটিতে নামানো হচ্ছিল। রাস্তাটির শেষে গ্রামবাসীরা বিদায় নিল এবং আমাদের লোকেরা বাঘটিকে নিয়ে বিজয় গর্বে বাংলোর দিকে এগিয়ে চলল।

বাংলোয় ফিরে হাত মুখ ধুয়ে আমি ও ইবটসন এই বাঘটি সত্যিই মানুষখেকোটি কিনা এ নিয়ে তর্ক জুড়ে দিলাম। দু’জনের কেউই অন্য জনের যুক্তি মেনে নিতে চাইল না। শেষে আমরা ঠিক করলাম যেহেতু ইবটসন পাউরিতে ফিরে গিয়ে কাজে যোগ দেবেন এবং আমিও দীর্ঘ সময় রুদ্রপ্রয়াগে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, অতএব পরের দিন বাঘটির চামড়া ছাড়িয়ে শুকিয়ে নিয়ে তার পরের দিনই তাঁবু গুটিয়ে পাউরি রওনা হয়ে যাবো।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু লোক বাঘটিকে দেখতে এল এবং সকলেই এক বাক্যে বলল এটাই সেই মানুষখেকো; তার অর্থ ইবটসনের মতটাই প্রতিষ্ঠিত হতে চলল। আমার দু’টি অনুরোধ ইবটসন অবশ্য মেনে নিল; প্রথমটি হল সবাইকে আগের মতই মানুষখেকোটি সম্বন্ধে সজাগ হয়ে চলতে বলা এবং দ্বিতীয়টি সরকারকে টেলিগ্রাফ করে তখনই না জানানো যে মানুষখেকো বাঘটিই মারা পড়েছে।

আমরা সে রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম কারণ পর দিন ভোরেই আমাদের যাত্রা করতে হবে। অন্ধকার থাকতেই আমি উঠে পড়লাম এবং শুনতে পেলাম রাস্তায় কারা যেন কথা বলছে। এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার, আমি সেজন্য চেঁচিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলাম তারা সে সময়ে ওখানে কি করছে। আমাকে দেখতে পেয়ে চারজন লোক পাহাড় বেয়ে আমার বাংলোয় উঠে এসে বলল যে পাটোয়ারী তাদের পাঠিয়েছে আমাকে খবর দেবার জন্য যে চাটোয়াপিপল সেতু থেকে নদী ছাড়িয়ে এক মাইল দূরে মানুষখেকোটি একটি মেয়েকে মেরেছে।

১৩। বিপদের মুখে শিকারিরা


চা খাবার জন্য ইবটসন দরজা খুলতেই আমি এসে হাজির হলাম। ইবটসন আগেই তার পাউরি যাত্রা বাতিল করেছিল। এবার জিনের বিছানায় আমরা দু’জন একটা বড় মানচিত্র নিয়ে বসে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ঠিক করতে লাগলাম।

পাউরিতে ইবটসনের একটা জরুরী কাজ রয়েছে, তিনি বড় জোর আর দু’দিন দু’রাত কাটাতে পারেন। আমিও আগের দিন টেলিগ্রাফ করে জানিয়েছি যে আমি পাউরি ও কোটদোয়ারা হয়ে বাড়ি ফিরছি। এটিও আমাকে বাতিল করতে হবে, রেলে চেপে যাবার বদলে হেঁটেই যাব ঠিক করলাম। এসব প্রাসঙ্গিক বিষয় মিটে গেলে, মেয়েটি যে গ্রামে মারা গেছে মানচিত্রে তার অবস্থান দেখে নিয়ে আমি তাবুতে ফিরে এসে আমার লোকদের এই পরিবর্তিত কর্মসূচীর কথা জানালাম। আমি নির্দেশ দিলাম সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে যে চারজন লোক খবর নিয়ে এসেছিল তাদেরও আমাদের সঙ্গে যেতে।

জিনকে রুদ্রপ্রয়াগেই রেখে ইবটসন ও আমি দুটো তেজী ঘোড়ায় চেপে রওনা হলাম। ঘোড়া দু’টির একটি আরব ও অপরটি ইংল্যাণ্ডের; এ দু’টির মত সতর্ক পদক্ষেপ ফেলে চলতে আমি খুব কম ঘোড়াকেই দেখেছি।
আমরা সঙ্গে রাইফেল, স্টোভ, পেট্রোল বাতি ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলাম এবং অন্য একটা ভাড়া করা ঘোড়ায় চেপে ইবটসনের এক সঙ্গী ঘোড়ার খাবার নিয়ে চলল।

চাটোয়াপিপল সেতুর কাছে এসে আমরা ঘোড়া ছেড়ে দিলাম। যে রাতে আমরা চিতাটিকে মেরেছিলাম, সে রাতে সেতুটি বন্ধ করা হয় নি; তার ফল হল এই যে মানুষখেকোটি সেতু পেরিয়ে ওপারে গিয়ে প্রথম গ্রামটি থেকেই একজন লোককে মেরেছে।

আমাদের জন্য একজন গাইড অপেক্ষা করছিল। সে আমাদের নিয়ে ঘাসে ঢাকা একটা চড়াই পেরিয়ে নেমে গিয়ে গভীর জঙ্গলে একটা খাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে জলের একটা ছোট ধারা বয়ে যাচ্ছে। এখানেই পাটোয়ারী বিশ জন লোককে সঙ্গে করে মৃতদেহটি পাহারা দিচ্ছিল।

মৃতদেহটি ছিল একটা সুঠাম গড়নের সুন্দরী মেয়ের। বয়স হবে আঠারো কি কুড়ি। সে দু’পাশে হাত রেখে উপুড় হয়ে শুয়েছিল, শরীরে একখণ্ড কাপড়ও ছিল না। দাঁত বসানোর চারটি দাগও রয়েছে দেখতে পেলাম। বাঘটি তার শরীরের উপর ও নীচের দিকে কয়েক পাউন্ড করে মাংস খেয়ে চলে গেছে।

পাহাড়ে উঠতে উঠতে বাদ্যযন্ত্রের যে আওয়াজ শুনছিলাম সেটা যারা পাহারা দিচ্ছিল তারাই বাজাচ্ছিল। তখন বেলা দু’টো বেজে গেছে, মানুষখেকোটির ধারে কাছে কোথাও থাকার সম্ভাবনা নেই জেনে আমরা পাটোয়ারীকে সঙ্গে নিয়ে চা খেতে গ্রামের দিকে চলে গেলাম।

চা খেয়ে আমরা গ্রামে যে বাড়িটিতে মেয়েটা মারা পড়েছিল সেটি দেখতে গেলাম। বাড়িটা ছিল পাথর দিয়ে তৈরি এবং একটাই মাত্র ঘর সেটাতে। দু’ তিন একর চষা জমির মাঝখানে বাড়িটি দাঁড়িয়েছিল, সেখানে থাকত মেয়েটি, তার স্বামী ও ছ’মাসের একটি বাচ্চা।

মেয়েটি মারা যাবার দু’দিন আগে স্বামী জমি সংক্রান্ত একটা বিবাদে সাক্ষী দিতে পাউরি গিয়েছিল, শ্বশুরকে রেখে গিয়েছিল বাড়ির পাহারায়। সে রাতে মেয়েটি শ্বশুরের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়েছিল। শুতে যাবার আগে শ্বশুরের হাতে বাচ্চাটিকে দিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েছিল প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। আমি আগেই বলেছি এসব গ্রামের বাড়িতে কোন শৌচালয়ের ব্যবস্থা ছিল না।

শিশুটিকে যখন মায়ের হাত থেকে দাদুর হাতে দেওয়া হচ্ছিল তখন সে চীৎকার করে কাঁদছিল। বাইরের কোন শব্দ ভিতরে শুনতে পাবার কথা নয়-যদিও আমি নিশ্চিত কোন শব্দই হয় নি। রাতটি ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লোকটি মেয়েটিকে ডাকল, দ্বিতীয় বার ডেকে সাড়া না পেয়ে সে দ্রুত উঠে দরজা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিল।

সেদিন সন্ধ্যার আগেই বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে এবং কি ঘটেছিল সেটা বুঝে নেওয়া কঠিন নয়। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার কিছু পরেই চিতাটি গ্রামের দিক থেকে এসে দরজা থেকে ত্রিশ গজ দূরে একটা পাথরের পাশে গুড়ি মেরে বসেছিল। এখানে সে শুয়ে শুয়ে লোকটির সঙ্গে মেয়েটির কথাবার্তার আওয়াজ পাচ্ছিল। মেয়েটি যখন দরজা খুলে বাইরে এসে বসল তখন সে বাঘটির দিকে পিছন ফিরে ছিল। বাঘটি জমির উপর বুক রেখে কুড়ি গজ দূরত্ব অতি সন্তর্পণে পেরিয়ে পেছন দিক থেকে মেয়েটিকে ধরে এবং পাথরের কাছে বয়ে নিয়ে যায়। লোকটির ডাক শুনে বাঘটি মেয়েটিকে কামড়ে উঁচু করে ধরে বয়ে নিয়ে গেছে, সেজন্য মেয়েটির হাত বা পায়ের কোন ঘষে যাবার দাগ নরম মাটির ওপর পড়ে নি। বাঘটি এর পর নতুন চষা জমির উপর দিয়ে এগিয়ে তিন ফুট নেমে অন্য একটা জমিতে পড়েছে। জমিটি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে বারো ফুট নেমে গিয়ে একটা নিত্য ব্যবহৃত হাঁটা পথ রয়েছে, এখানে সে লাফিয়ে নেমেছে। বাঘের গায়ের জোরের একটা নমুনা পাওয়া যাবে এখান থেকে যে সে যখন বারো ফুট উচ্চতা থেকে লাফিয়ে নেমেছে তখন কামড়ে ধরা মৃতদেহটির কোন অংশই মাটির সংস্পর্শে আসে নি। হাঁটা পথটি পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালু পথে চিতাটি আধ মাইল নেমে গিয়ে মৃতদেহটি মাটিতে রেখে তার পোশাক গুলি খুলে ফেলেছে। এর পর শরীরের কিছুটা অংশ খেয়ে পান্নার মত সবুজ ঘাসের উপর ঘন লতাপাতা ঢাকা একটা গাছের ছায়ায় দেহটি ফেলে রেখে চলে গেছে।

বিকেল চারটা নাগাদ আমরা মৃতদেহটির কাছে বাঘটির অপেক্ষায় বসব ঠিক করলাম, সঙ্গে থাকবে পেট্রোলের বাতি ও টর্চ।

এটা খুব স্বাভাবিক যে মেয়েটির যখন খোঁজ চলছিল এবং তার মৃতদেহটি আগলে গ্রামের লোকেরা যে শব্দ করছিল তাতে বাঘটি যদি সেখানে ফিরেও আসে, সে খুব সতর্ক হয়ে আসবে। সেজন্য আমরা মৃতদেহটির খুব কাছে না বসে ষাট ফুট দূরে একটা গাছ বেছে নিলাম যেখান থেকে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়।

এই গাছটি ছিল একটা ওক গাছ এবং পাহাড় থেকে প্রায় সমকোণে সেটা দাঁড়িয়ে ছিল। একটা গর্তের মত জায়গায় পেট্রোল বাতিটিকে রেখে সেটা পাইনের ফল দিয়ে ঢেকে দিলাম, ইবটসন একটা বেরিয়ে আসা ডালে গিয়ে বসল, যেখান থেকে মৃতদেহটির দিকে লক্ষ্য রাখা যায়। আমি বসলাম মূল কাণ্ডটির অংশে পাহাড়ের দিকে মুখ করে এবং ইবটসনকে পিছনে রেখে। ঠিক হল ইবটসনই গুলি চালাবে, আমি শুধু সুরক্ষার দিকটা দেখব। সম্ভবত ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় টর্চটা কাজ করছিল না সেজন্য ঠিক হল ইবটসন যতক্ষণ দেখতে পায় ততক্ষণই আমরা অপেক্ষা করব, তার পর পেট্রোল বাতিটা জ্বেলে গ্রামের দিকে যাব; ইতিমধ্যে হয় ত আমাদের লোকেরাও রুদ্রপ্রয়াগ থেকে সেখানে এসে পৌঁছে যাবে।

তাড়াতাড়িতে আমরা গ্রামটা ঘুরে দেখার সুযোগ পাই নি। গ্রামের লোকদের কাছে জানতে পেরেছিলাম যে মৃতদেহটির পূর্ব দিকে একটা গভীর জঙ্গল আছে এবং তাড়া খেয়ে বাঘটা হয় ত সেখানেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। বাঘটা যদি এখান থেকেই বেরোয় তবে মৃতদেহটির কাছে পৌঁছবার আগেই ইবটসন তাকে দেখতে পাবে এবং গুলি করতে পারবে। রাইফেলটিতে একটা টেলিস্কোপ লাগানো ছিল যা দিয়ে শুধু যে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করা যায় তাই নয়, অন্ধকার নেমে এলে আধ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় ধরে দেখাও যায়। যেখানে আলো থাকা বা না থাকার এক মিনিট তফাতের উপর লক্ষ্যভেদের সফলতা নির্ভর করে, সেখানে আধ ঘণ্টা সময়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

পাহাড়ের ওপারে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ছিল; ছায়া নেমে আসার পর আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। এমন সময় একটা কাকর (পাহাড়ি হরিণ) জঙ্গলের দিক থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুদূর ছুটে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে কিছুক্ষণ ডাকার পর আবার উলটো দিকে চলতে শুরু করল, ক্রমে তার ডাক মিলিয়ে গেল।

কাকরটি নিশ্চয়ই চিতাটিকে দেখে ভয় পেয়েছে। যদিও সে অঞ্চলে একাধিক চিতা থাকতে পারে তবুও আমরা আশান্বিতই ছিলাম, ইবটসনকেও দেখলাম দুটো হাতই রাইফেলে রেখে সোজা হয়ে বসেছে।

আলো ক্রমশ কমে এলেও টেলিস্কোপ ছাড়াই গুলি চালানোর মত আলো যথেষ্টই ছিল। এমন সময় ত্রিশ গজ দূরে পাহাড়ের ওপর থেকে পাইন গাছের একটা ফল গড়িয়ে এসে আমাদের গাছের কাছে এসে থামল। চিতাটি এসেছে এবং সম্ভবত: বিপদ আঁচ করে পুরো জায়গাটি ভাল করে দেখার জন্য ঘুরে অন্য দিক থেকে এগিয়েছে যেখান থেকে সে আমাকে না দেখতে পেলেও ইবটসনকে তার চোখে পড়বেই।

যখন গুলি চালানোর মত আর পর্যাপ্ত আলো নেই, এমন কি টেলিস্কোপটিও আর কাজে লাগবে না তখন শুনতে পেলাম বাঘটি চুপিসারে আমাদের গাছের দিকে এগোচ্ছে। আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। ইবটসনকে আমার জায়গাটা নিতে বলে আমি পেট্রোলের বাতিটা জ্বালাতে হাত লাগালাম। বাতিটি ছিল জার্মানিতে তৈরি ‘পেট্রোম্যাক্স ল্যাম্প’। এটি থেকে অতি উজ্জ্বল আলো বেরোলেও এর গড়নটি ছিল লম্বাটে, হাতলটি ছিল আরও লম্বা; জঙ্গলে চলার জন্য এটি ছিল সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।

আমি ইবটসনের চেয়ে কিছুটা লম্বা হওয়ায় আমিই বাতিটা নিয়ে এগোতে চাইলাম কিন্তু ইবটসন জানাল সে ই বাতিটা নিয়ে যেতে পারবে বরং নিজের চেয়ে আমার রাইফেলের উপরেই তার আস্থা অনেক বেশি। এর পর ইবটসন বাতি হাতে আর আমি দু’হাতই রাইফেলে রেখে এগোতে শুরু করলাম।

গাছটি থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে একটা পাথরের উপর উঠতে গিয়ে ইবটসনের পা পিছলে গেল এবং বাতির তলাটা সজোরে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ম্যান্টেলটা গুড়ো হয়ে বাতির ভিতরে ছড়িয়ে পড়ল। বাতিটার সরু মুখটি দিয়ে বেরিয়ে আসা পেট্রোলের নীলাভ শিখার আলোয় চারিদিক ভালোই দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু ইবটসন জানালো এটা বড় জোর তিন মিনিট চলতে পারে, তার পর বাতিটা ফেটে যাবে। রাতের অন্ধকারে পাথরে ভর্তি চড়াইয়ের পথ বেয়ে আধ মাইল পথ তিন মিনিটে অতিক্রম করা অসম্ভব ব্যাপার। হয় ত মানুষখেকোটিও আমাদের পিছু নিয়েছে – পরে দেখা গিয়েছিল সত্যিই সে সমস্ত পথটাই আমাদের অনুসরণ করেছিল।

কারো কারো জীবনে এমন ঘটনা ঘটে, যতদিন আগেরই হোক না কেন, স্মৃতি থেকে সেটা কখনও মুছে যায় না। সে রাতের সেই পাহাড় বেয়ে ওঠা ছিল এমনই এক অভিজ্ঞতা। যখন সেই পায়ে হাঁটা পথটিতে এসে পৌঁছলাম, তখনও আমাদের দুর্ভোগ শেষ হয় নি। রাস্তাটিতে মোষেরা বৃষ্টিতে জল কাদার মধ্যে নেমে অসংখ্য গর্ত করে রেখেছে। কখনও পিছল রাস্তায় কখনও পাথরে ঠোক্কর খেয়ে চলতে চলতে ডান দিকে কতকগুলি পাথরের সিঁড়ির মত দেখতে পেলাম। এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা চাতাল এবং এগিয়ে গিয়ে দূরে একটা দরজা। হুঁকো টানার শব্দ শুনে আমরা দরজায় লাথি মেরে ভেতরের লোকদের দরজাটা খুলে দিতে বললাম। কিন্তু কোন সাড়াশব্দই পেলাম না। এবার একটা দেশলাই বাক্স বের করে সেটা ঝাঁকিয়ে শব্দ করতে করতে বললাম যদি এক মিনিটের মধ্যে দরজা না খোলা হয় তাহলে আমরা ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব। এতে ভেতর থেকে ভীতস্বরে জানানো হল ঘরে যেন আগুন না লাগানো হয়, দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। মিনিট খানেক পরে প্রথমে ভিতরের দরজা এবং পরে বাইরের দরজা খুলে দেওয়া হল, কয়েক লাফে আমি ও ইবটসন ঘরে ঢুকে ভিতরের দরজা বন্ধ করে তাতে পিঠ চেপে দাঁড়ালাম।

ঘরটিতে মহিলা, পুরুষ ও বাচ্চারা মিলে মোট বারো চোদ্দ জন লোক ছিল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি দরজা না খোলার জন্য তারা ক্ষমা চাইল এবং জানালো তারা এবং তাদের পরিবারের লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে মানুষখেকোটির ভয়ে এতটাই শঙ্কিত হয়ে রয়েছে যে তাদের সাহস কিছুই অবশিষ্ট নেই। মানুষখেকোটা কি রূপ ধরে দেখা দেবে তারা তা জানে না এবং কোন শব্দ শুনলেই তারা ভীত হয়ে ওঠে। আমি তাদের সহানুভূতিই জানালাম। কারণ, যে ভাবে ইবটসন পা পিছলে পড়ায় বাতিটা ধাক্কা খেয়ে নিভে গেল এবং বাতিটা যাতে না ফাটে সেজন্য বাকি আলোটুকুও নিভিয়ে দিতে হল তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে আমাদের কোন একজন এবং সম্ভবত দু’জনেই বেঁচে গ্রামে ফিরতে পারব না।

আমরা জানতে পারলাম যে আমাদের লোকজন সূর্যাস্তের সময়েই ফিরে এসেছে এবং কিছুদূরের বাড়িগুলির একটিতে এসে উঠেছে। দু’জন শক্ত সমর্থ লোক আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু তাদের একা ফিরতে হবে বলে তাদের সে প্রস্তাবে আমরা রাজী হলাম না। তাদের কাছে জানতে চাইলাম তারা কোন আলো আমাদের দিতে পারবে কি না। খুঁজে খুঁজে ঘরের কোণ থেকে একটা জীর্ণ কাঁচভাঙা লণ্ঠন তারা আমাদের এনে দিল। বেশ খানিকটা ঝাঁকিয়ে বোঝা গেল, কিছুটা তেল তখনও অবশিষ্ট রয়েছে। সেই লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে সবার শুভেচ্ছা নিয়ে আমরা পথে নামলাম। আমরা বেরিয়ে যাবার পর মুহূর্তেই তারা দরজাটা বন্ধ করে দিল।

আবার সেই মোষের গর্ত ও পাথর পেরিয়ে চলতে লাগলাম, তবে সঙ্গে আলো থাকায় এবার আমাদের চলার গতি অনেক দ্রুত হল। কিছুদূর এসে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটা চাতালের দু’ধারে সারি সারি দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম। প্রত্যেকটি দরজাই বন্ধ করা এবং এক চিলতে আলোও কোথাও দেখা গেল না।

আমাদের ডাকে একটা দরজা খুলল, কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে আমরা একটা বাড়ির দোতলার বারান্দায় এসে পৌঁছলাম। পাশাপাশি দু’টি ঘরে আমাদের লোকদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। তারা যখন আমাদের হাত থেকে আলো ও রাইফেলটি নিয়ে রাখল তখন কোথা থেকে একটা কুকুর এসে উপস্থিত হলও। বুঝলাম সেটি গ্রামেরই কুকুর। কিছুক্ষণ লেজ নেড়ে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা শোঁকাশুঁকি করে সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। পর মুহূর্তেই সে আর্ত চিৎকার করে তারস্বরে ডাকতে ডাকতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল, তার গায়ের প্রতিটি লোম তখন খাড়া হয়ে উঠেছে।

যে লণ্ঠনটি আমাদের সঙ্গে ছিল, চাতালে পৌঁছেই সেটি নিভে গিয়েছে; আমাদের লোকজন সেরকমই আর একটি লণ্ঠন যোগাড় করে আনল। ইবটসন যখন সেটি নিয়ে চারিদিক দেখতে শুরু করেছে, আমি তখন রাইফেলে গুলি ভরে নিলাম। লণ্ঠনের আলোয় সিঁড়ির আট ফুট নীচের চাতালে কিছুই দেখা গেল না।

কুকুরটির দিকে নজর রেখে বাঘটির গতিবিধি কিছুটা বোঝা সম্ভব ছিল। চিতাটি যখন চাতাল ছাড়িয়ে নীচের রাস্তায় নেমে গেছে, কুকুরটি তখন ডাকা বন্ধ করল এবং সতর্ক দৃষ্টিতে বাঘটি যে দিকে গেছে সেদিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে নিচু স্বরে গজরাতে লাগলো।

আমাদের জন্য যে ঘরটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তাতে একটিও জানালা নেই। নিরাপত্তার জন্য দরজা বন্ধ করে দিলে ঘরটিতে আলো হাওয়া কিছুই ঢুকবে না। এসব ভেবে আমরা বারান্দাতেই রাত কাটাব ঠিক করলাম। কুকুরটি আমাদের পায়ের কাছেই শুয়ে পড়ল; সে থাকাতে আমরা অন্তত কিছুটা নিরাপদ। সে রাতে আর কিছুই ঘটল না।


(চলবে)

 



লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।