প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য

জুলাই ১৫, ২০১৬

 

রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)

দীপক সেনগুপ্ত

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯)

১৮। ফাঁদ থেকে রক্ষা


(আগের অংশ) যে খবরটা জরুরী সেটা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত গতিতে। মানুষখেকোটাকে বিষ খাইয়ে তাকে গুহায় আটকে রাখা হয়েছে এ খবরটা গত দশ দিনের মধ্যে গাড়োয়ালের প্রতিটি লোকই জেনে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ খানিকটা ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করছিল এবং চিতাটা বিষে কাবু না হয়ে, কোন রকম ভাবে গুহার বাইরে বেরিয়ে এসে অসতর্ক ভাবে চলা প্রথম লোকটিকেই মেরেছে।

আমি গুহাটা পরিদর্শন করে সকালেই ঘুরে এসেছি, অতএব পুরো সকালটাই আমাদের হাতে ছিল। প্রাতরাশের পর রাইফেল নিয়ে ইবটসনের ঘোড়ায় চেপে যে গ্রামে মহিলাটি মারা পড়েছিল সেদিকে চললাম। তীর্থযাত্রীদের রাস্তাটা দিয়ে দ্রুত চলে আমরা অন্য একটা রাস্তা ধরলাম যেটা পাহাড়ের কোণাকুণি চলে গিয়েছে। এটা ধরে কিছুটা এগিয়েই আর একটি রাস্তা পেলাম যেটা গ্রাম থেকে এসে আগের রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। এখানেই ধস্তাধস্তির চিহ্নের সঙ্গে প্রচুর রক্ত পড়ে থাকতে দেখলাম।

গ্রামের মোড়ল ও মৃতের আত্মীয়রা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তারাই আমাদের দেখিয়ে দিল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সময় চিতাটা কোথায় মহিলাটিকে ধরেছে। তাকে ধরে চিতাটা চিৎ হয়ে থাকা অবস্থায় প্রায় একশ’ গজ টেনে নিয়ে গিয়ে দুই রাস্তা যেখানে মিশেছে সেখানে একটা ঝটকা দিয়ে তাকে মেরেছে। মহিলাটিকে যখন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এবং সে যখন নিজেকে ছাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল সে সময়ে তার কাতর আর্তনাদ গ্রামের সবাই শুনেছিল কিন্তু ভয়ে কেউ সাহায্যের জন্য এগোয় নি।

মহিলাটিকে মেরে চিতাটা তাকে তুলে নিয়ে একশ’ গজ চওড়া একটা খাদ পেরিয়ে কিছু পতিত জমির মধ্য দিয়ে পাহাড়ের উপর আরও দুশ’ গজের মত গিয়েছে। টেনে নিয়ে যাবার চিহ্ন না থাকলেও রক্তের দাগ ধরে আমরা চার ফুট চওড়া ও কুড়ি ফুট লম্বা একটা সমতল জমিতে এসে পড়লাম। এই জমিটার উপরের দিকে আট ফুট উঁচু একটা দেয়ালের মত উঠে গিয়েছে যেখানে রয়েছে বেঁটে খাটো একটা আপেলের মত গাছ। এখান থেকে জমিটা নীচের দিকে অত্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। কতকগুলি বুনো গোলাপ গাছ বেড়ে উঠে আপেল গাছটিকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। এই উঁচু দেয়াল ও গোলাপ গাছের মাঝের জমিতে মহিলাটির দেহ পড়ে ছিল। সত্তর বছরের এই পাকা চুলের বৃদ্ধার শরীরে এক টুকরো কাপড়ও নেই, মাথাটা রয়েছ দেয়ালের দিকে এবং তার সমস্ত শরীর উপর থেকে খসে পড়া অজস্র গোলাপের পাপড়িতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।

ভাবলাম, এই মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য চিতাটিকে তার জীবন দিয়ে মূল্য চোকাতে হবে। সামান্য আলোচনার পর ইবটসন দ্বিতীয় ঘোড়াটি নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করতে রুদ্রপ্রয়াগে ফিরে গেল, আর আমি রাইফেলটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম যদি দিনের বেলায় চিতাটার দেখা পাওয়া যায় এই আশায়।

এই অঞ্চলটা আমার কাছে নতুন, কাজেই প্রথমেই আমি চারিপাশের জায়গা সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিতে চাইলাম। গ্রামে বসেই আমি লক্ষ্য করেছি যে খাদ থেকে পাহাড়টা খাড়া চার পাঁচ হাজার ফুট উঠে গেছে। পাহাড়ের দু’হাজার ফুট পর্যন্ত ঘন ওক ও পাইনের জঙ্গল; এর নীচে প্রায় আধ মাইল চওড়া ঘাসে ঢাকা জমি এবং তার নীচে ঘন ঝোপ।

ঘাসে ঢাকা জমিটা এবং ঝোপের ধার ঘেঁষে আমি পাহাড়টার প্রান্তদেশে চলে গেলাম। সেখানে তীর্থযাত্রীদের রাস্তার নীচে আধ মাইল জুড়ে খাদের মত একটা নীচু জায়গা রয়েছে, দেখেই বুঝলাম বহু বছর আগে ধস নেমে এটা তৈরি হয়েছে। এই নীচু জায়গার জমিটা ছিল স্যাঁতসেঁতে, বেশ কয়েকটা বড় বড় গাছও এখানে রয়েছে আর গাছের নীচে ঝোপ ঝাড়ের জঙ্গল। এই নীচু জমিটার উপরের দিকে ঝুলে রয়েছে বেশ কয়েকটা খাড়া পাথর, উচ্চতায় প্রায় কুড়ি থেকে চল্লিশ ফুট এবং একশ’ গজ লম্বা। এই দুরারোহ খাড়া পাথরের মাঝামাঝি রয়েছে কয়েক ফুট চওড়া একটা গভীর ফাটল, এর নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা ক্ষীণ জলের ধারা। পাথরের উপরে একটা সঙ্কীর্ণ ঝোপ এবং ঝোপের উপরে আবার ঘাসের জমি।

আমি সব জমিটা মন দিয়ে পরীক্ষা করলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে চিতাটা সেই নীচু জমিতেই গা এলিয়ে বিশ্রাম করছে এবং আমি চাই না যে আমার সুবিধাজনক সময়ের আগেই সে আমার উপস্থিতিটা টের পেয়ে যাক। আমার এখন জানা দরকার চিতাটা ঠিক কোথায় বিশ্রাম করছে ; এটা জানতেই আমি মরাটার কাছে ফিরে গেলাম।

গ্রামে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে মহিলাটি যখন মারা যায় তখন ভোরের আলো সবে ফুটছে। চিতাটা মহিলাটিকে মেরে তাকে চারশো’ গজ টেনে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছুটা মাংস খেয়েছে। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, সে যখন খেয়ে দেয়ে সেখান থেকে চলে যায় তখন বেলা হয়ে গেছে।

যে পাহাড়টাতে মরাটা পড়ে ছিল, গ্রাম থেকে সেটা পরিষ্কার দেখা যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে অনেক লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়েছে, কাজেই ধরে নেওয়া যায় চিতাটা তার শিকারকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। শক্ত মাটিতে পায়ের ছাপ পড়ে নি, অতএব চিতাটা যেদিকে যেতে পারে বলে মনে হয়েছে আমি সেদিকটাতেই চললাম।

আমি প্রায় আধ মাইল চলে এসেছি, গ্রামটাও দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছে; ধীর পায়ে সেই নীচু জমিটার দিকে এগোতে গিয়ে দেখে খুশি হলাম যে আমি প্রায় চিতাটার পায়ের ছাপ ধরে ধরেই এগিয়েছি। একটা ঝোপের ধারে আলগা জমির উপর সে যে কয়েক ঘণ্টা শুয়েছিল, তার চিহ্ন রয়েছে। এ জায়গাটা যখন সে ছেড়ে চলে গেছে তখন তার পায়ের ছাপ থেকে এটা স্পষ্ট যে সেই খাড়া পাথরগুলোর পঞ্চাশ গজ নীচ দিয়ে সে নীচু জমিটায় ঢুকেছে।

চিতাটা যেখানে শুয়েছিল আমিও সেখানে শুয়ে সামনের গাছ ও ঝোপের দিকে লক্ষ্য রাখলাম কারণ, যদি চিতাটা সামান্য নড়াচড়া করে তবে সে ঠিক কোথায় রয়েছে সেটা আমি বুঝতে পারব।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পর শুকনো পাতায় একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল। দেখলাম দু’টো ‘সিমিটার ব্যাবলার’ (হিমালয়ের পাখি) খাবারের সন্ধানে শুকনো পাতা সরানোর কাজে ব্যস্ত। জঙ্গলে কোন মাংসাশী পশুর উপস্থিতি এই পাখি গুলো নির্ভুল ভাবে জানান দেয়। আমি এদের কাজে লাগিয়ে চিতাটার খোঁজ পাবার আশায় রইলাম।

একটু নড়াচড়া বা সামান্য সাড়াশব্দ কোন কিছু থেকেই বোঝা গেল না যে চিতাটা নীচু জমিটাতেই রয়েছে, কিন্তু সেটা যে ওখানে আছে এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। এভাবে যখন তাকে গুলি করার সুযোগ পাওয়া যাবে না তখন আমি অন্য এক উপায়ে সেটা করব ঠিক করলাম।

ফাঁকা জমিতে না বেরিয়ে চিতাটার পালাবার দু’টো রাস্তা ছিল; একটা হল পাহাড় বেয়ে তীর্থযাত্রীদের রাস্তায় দিকে, অন্যটা পাহাড়ের উপরে উঠে। চিতাটাকে নীচের দিকে নেমে যেতে দিয়ে আমার কোন লাভ হবে না বরং সে যদি পাহাড়ে উঠে বড় পাথরগুলির উপরের ঝোপে আশ্রয় নেয়, তবে আমি তাকে দেখতে পেলে গুলি করার একটা সুযোগ পাব।

যেখানে চিতাটা আছে মনে করেছিলাম সেই নীচু জমিটায় এঁকেবেঁকে আমি চলতে শুরু করে প্রত্যেকটি মোড় নেবার সময় কয়েক ফুট করে উপরে উঠতে লাগলাম। উপরের ফাটলটার দিকে আমার আর নজর রাখার কোন প্রয়োজন নেই কারণ, ‘ব্যাবলার’গুলো রয়েছে, চিতাটা চলতে শুরু করলে ওরাই আমাকে জানাবে। এভাবে সামনে পিছনে চলতে চলতে যখন প্রায় চল্লিশ গজ উপরে উঠেছি এবং ফাটলটা থেকে দশ গজ দূরে রয়েছি তখন হঠাৎ ‘ব্যাবলার’গুলি সতর্কতা সূচক ডাক ছাড়তে ছাড়তে একটা ওক গাছের ডালে বসে উত্তেজিত ভাবে লাফালাফি শুরু করল। এদের এই বিশেষ ডাকটি পাহাড়ে প্রায় আধ মাইল দূর থেকে শোনা যায়। আমি রাইফেলটা নিয়ে তৈরি হলাম যাতে মুহূর্তের মধ্যে গুলি চালাতে পারি। এভাবে মিনিট কয়েক স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থেকে আবার সামনের দিকে এগোতে লাগলাম।

জমিটা ছিল ভেজা ও পিছল। জুতো পড়ে ফাটলটার দিকে যেই দু’পা এগিয়েছি, আমার পা পিছলে গেল। পড়ে যাওয়া আটকাতে যেই নিজেকে সামলাচ্ছি সেই সময় চিতাটা ফাটলটা থেকে লাফিয়ে ঝোপে গিয়ে পড়ল এবং এতে ঘাবড়ে গিয়ে একদল ‘ফেজেন্ট’ আমার মাথার উপর দিয়ে সজোরে উড়ে গেল। আমার দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হল। ইবটসনের সঙ্গে কথা ছিল আমরা দু’টোর সময় খোলা খাদের জমিটার কাছে দেখা করব। তার একটু আগেই সে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ফিরে এলো, সঙ্গে কয়েকজন লোক ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। এগুলির মধ্যে রয়েছে খাবার, চা, আমাদের পুরানো বন্ধু ‘পেট্রোম্যাক্স’ বাতি, দু’টো অতিরিক্ত রাইফেল এবং কার্তুজ, মাছ ধরার সুতো, যথেষ্ট পরিমাণ সায়ানাইড ও ‘জিন ট্র্যাপ’। ঠিক করেছিলাম এবার যদি বাতিটা বইবার দরকার হয় তবে সেটা আমিই বইব।

খাদের ধারে একটা স্বচ্ছ জলের ধারার পাশে বসে মধ্যাহ্ন ভোজন সারার পর বেশ কয়েক কাপ চা খেয়ে আমরা মৃতদেহের কাছে গেলাম।

মৃতদেহটা যেখানে পড়েছিল সে জায়গাটার একটা বিশদ বিবরণ আমি আপনাদের দেব যাতে আমাদের গতিবিধি এবং পরের ঘটনাগুলি সহজে আপনারা বুঝতে পারেন।

সমতল জমিটা ছিল চার ফুট চওড়া এবং কুড়ি ফুট লম্বা এবং এখান থেকে খাদের দিকে পাঁচ ফুট দূরে মরাটা পড়ে ছিল। এই জমিটার উপর ছিল উঁচু দেয়ালের মত একটা বাঁধ যার নীচের দিকটা অত্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে গেছে, মাঝে ছড়ানো গোলাপের ঝাড়। বাঁধের ধারের বেঁটেখাটো আপেলের গাছটা এত ছোট যে সেখানে মাচান বেঁধে বসা যায় না। সব দিক ভেবে আমরা ঠিক করলাম, বন্দুক দিয়ে তৈরি ফাঁদ, বিষ এবং ‘জিন ট্র্যাপে’র উপরে নির্ভর করব। সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি শুরু করলাম।

সময়ের অভাবে চিতাবাঘটা মরাটা থেকে খুব অল্পই মাংস খেয়েছিল। সেখানে সে নিশ্চয়ই আবার ফিরে আসবে মনে করে আমরা মাংসের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ বিষ মিশিয়ে রাখলাম, এবার যদি কিছু ফল পাওয়া যায় এই আশায়। মরাটার উপর ঝুঁকে থেকে বুঝে নিলাম চিতাটা মাংস খাবার সময় তার অবস্থানটা কি হবে, সে অনুযায়ী ইবটসন তার .২৫৬ ম্যানলিসার ও আমার দ্রুত গতির .৪৫০ রাইফেল আমাদের পথের পনেরো গজ দূরে দু’টো গাছের সঙ্গে বেঁধে দিলাম।

চিতাটা যেদিক দিয়ে খুশি মরাটার কাছে আসতে পারে, তবে যেটার সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি সেটা হল সে সমতল জমিটা দিয়েই এগোবে। এই ভেবে এখানে বিশালাকৃতির ‘জিন ট্র্যাপ’টা বসাবার জন্য তৈরি হলাম। প্রথমে প্রত্যেকটি পাতা কাঠি ও ঘাস সরিয়ে একটা চওড়া ও গভীর গর্ত খুঁড়ে মাটিগুলি দূরে সরিয়ে নিলাম এবং গর্তের মধ্যে ট্র্যাপটা রেখে স্প্রিংটা চেপে পাতের মত ট্রিগারটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জায়গা মত বসিয়ে দিলাম। এরপর এটার উপরে সবুজ পাতার একটা আবরণ তৈরি করে কিছু ঝুরো মাটি ও ঘাস দিয়ে ঢেকে দিলাম। আমাদের পক্ষেও জমির উপরে ট্র্যাপটার সঠিক অবস্থানটা কোথায় সেটা বুঝে ওঠা কঠিন হল।

এবার আমার মাছ-ধরা ছিপের সুতো নিয়ে এলাম। এক প্রান্ত একটা রাইফেলের ট্রিগারের সঙ্গে বেঁধে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে আবার অন্য রাইফেলটার ট্রিগারে বেঁধে সুতোটা কেটে দিলাম। এবার সুতোর এক প্রান্ত মৃত মহিলাটির কোমরে জড়িয়ে নিয়ে এসে আগের বেঁধে রাখা সুতোটার সঙ্গে টান করে গিঁট দিয়ে সুতোটা আবার কেটে দিলাম। সুতোটা কাটতে খুবই মায়া হচ্ছিল কারণ সেটি ছিল নতুন এবং খুবই মজবুত ধরণের।

আমাদের শিল্পী সুলভ হাতের কাজ যখন নিজেদের কাছেই সন্তোষজনক মনে হচ্ছিল তখন হঠাৎ খেয়াল হল চিতাটা যে রাস্তায় আসবে বলে মনে করছি সেভাবে না এসে যদি উলটো রাস্তায় আসে তবে বন্দুকের ফাঁদ ও ‘জিন ট্র্যাপ’ কোনটাই কাজে আসবে না। এটা যাতে না হয় সেজন্য আমরা গ্রাম থেকে গর্ত খোঁড়ার একটা যন্ত্র আনিয়ে এক হাঁটু সমান গভীর পাঁচটা গর্ত খুঁড়ে কিছুটা দূর থেকে গাছ কেটে এনে সেগুলিতে পুঁতে দিলাম; সাজিয়ে গুছিয়ে সেগুলিকে এমন স্বাভাবিক করে দিলাম যাতে মনে হয় পাহাড়েই সেগুলি গজিয়েছে। যা ফাঁক রইল তাতে ইঁদুরের চেয়ে বড় কোন প্রাণী সেখানে ঢুকে মাংস খেয়ে যাবে অথচ কোন না কোন ভাবে মৃত্যুকে ডেকে আনবে না এটা সম্ভব না। শেষে রাইফেলের ‘সেফটি ক্যাচ’ লাগিয়ে আমরা গ্রামে ফিরে এলাম।

গ্রাম থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে যেখানে আমরা প্রচুর রক্ত পড়ে থাকতে দেখেছিলাম সেখানে একটা ডালপালা ছড়ানো আমগাছ ছিল। গ্রাম থেকে তক্তা আনিয়ে এই গাছটার উপরেই আমরা মাচান বানিয়ে বসব ঠিক করলাম। মাচান তৈরি হয়ে গেলে তার উপরে আমরা মিষ্টি গন্ধের খড় বিছিয়ে দিলাম। আমাদের উদ্দেশ্যটা ছিল চিতাটা যদি ‘জিন ট্র্যাপে’ ধরা পড়ে তবে সেটাকে মেরে ফেলা।

সূর্যাস্তের পরেই আমরা মাচানে উঠে পড়লাম। পা ছড়িয়ে শোবার মত সেটা যথেষ্ট লম্বা ছিল এবং পাশাপাশি দু’জনে শোবার মত জায়গাও ছিল যথেষ্ট। মাচানটা থেকে মরাটা ছিল একশ’ ফুট উপরে এবং খাদটা থেকে দু’শ গজ দূরে।

ইবটসনের ভয় ছিল টেলিস্কোপ লাগানো থাকলেও তার লক্ষ্য নির্ভুল হবে না; কাজেই সে যখন একজোড়া শক্তিশালী দূরবীন বাক্স থেকে বের করল, আমি .২৭৫ রাইফেলটাতে গুলি ভরে নিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল – চিতাটা যেদিক থেকে আসবে বলে আশা করা গিয়েছিল ইবটসন পাহাড়ের সে দিকটাতে লক্ষ্য রাখবে আর আমি সার্বিক ভাবে সম্পূর্ণ পাহাড়ের উপরেই নজর রাখব এবং চিতাটার দেখা পাওয়া মাত্র গুলি চালাব, সেটা যদি সর্বোচ্চ লক্ষ্য মাত্রা তিনশ’ গজ দূর থেকে হয় তা হলেও।

ইবটসন বসে বসে ঢুলছিল, আমি ধূমপান করতে করতে পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্য পাহাড়ে যে ছায়া ফেলেছিল সেটা দেখছিলাম। ছায়াটা ক্রমশ: এগিয়ে আমাদের সামনে চলে এলো। অস্তমিত সূর্যের আলো যখন পাহাড়ের চূড়ায় লাল আভা সৃষ্টি করল, ইবটসন তখন জেগে উঠে তার দূরবীনটা খুলে বসল আর আমি রাইফেলটা তুলে নিলাম কারণ চিতাটার আসবার সময় হয়েছে বলে মনে হল। তখনও পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মত দিনের আলো বাকি ছিল। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমার চোখের দৃষ্টি ছিল খুবই জোরালো; সেটাকে কাজে লাগিয়ে এবং ইবটসন তার দূরবীনটা চোখে লাগিয়ে মাচান থেকে যতদূর দেখা যায় পাহাড়ের প্রতিটি অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখেও পাখি বা কোন জন্তু কারোরই কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

গুলি করার মত যথেষ্ট দিনের আলো আর যখন বাকি নেই, আমি তখন রাইফেলটা নামিয়ে রাখলাম আর ইবটসন তার দূরবীনটা বাক্সে ঢুকিয়ে রাখল। চিতাটাকে শিকার করার একটা সুযোগ চলে গেল ঠিকই কিন্তু এখনও তিনটে সুযোগ রয়েছে, কাজেই হতাশ হবার কোন কারণ দেখলাম না।

অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। আমি ইবটসনকে ফিসফিস করে বললাম যে আমাদের সব চেষ্টা বোধ হয় বৃথা হল, কারণ বৃষ্টির জলের চাপ লেগে ‘জিন ট্র্যাপ’টা ছুটে যেতে পারে অথবা মাছ ধরার সুতো, তা সে যতই সরু হোক না কেন, বৃষ্টির জল পড়ে টান লাগায় রাইফেল দু’টো থেকে গুলিও বেরিয়ে আসতে পারে। বৃষ্টি তখনও পড়ছে, ইবটসন আমাকে কটা বাজে জিজ্ঞাসা করল। আমার ঘড়ির কাটা অন্ধকারেও দেখা যেত, আমি তাকে জানালাম তখন আটটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। ঠিক সেই সময় মরাটার দিক থেকে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল। যাক, অবশেষে রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো ‘জিন ট্র্যাপে’ ধরা পড়েছে!

ইবটসন মাচা থেকে লাফিয়ে উঠলো আর আমি একটা ডাল থেকে লাফিয়ে নীচে নামলাম। নিতান্ত বরাত জোরে আমাদের কারো হাত-পা ভাঙে নি। ঝোপের মধ্যে যে ‘পেট্রোম্যাক্স’ বাতিটা লুকিয়ে রাখা ছিল ইবটসন সেটা জ্বালাতে লেগে গেল এবং আমি একটা সন্দেহ প্রকাশ করায় সে ভর্ৎসনার সুরে বলল –“তোমার মত নৈরাশ্যবাদী আর হয় না। এই তুমি বলছিলে বৃষ্টির জলে আমাদের দু’টো রাইফেলের সঙ্গে ‘জিন ট্র্যাপ’টাও ছুটে যাবে আর এখন আবার মনে করছ, যেহেতু কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না, অতএব চিতাটা ফাঁদ থেকে পালিয়েছে।” হয় ত তার মতামতই ঠিক, কিন্তু এক্ষেত্রে আমার চিন্তাটাই ঠিক মিলে গিয়েছিল। অন্য সময়ে আমরা যখন ফাঁদ পেতে চিতাবাঘ শিকার করেছি তখন সেগুলি সমানে চীৎকার করে চলত, কিন্তু এবার ক্রুদ্ধ গর্জন শুনে লাফিয়ে নামার পর আর কোন সাড়াশব্দই ছিল না।

ইবটসন যে কোন কোম্পানির পেট্রোলের বাতি জ্বালাতে ছিল ওস্তাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ‘পেট্রোম্যাক্স’ বাতিটা জ্বেলে ফেলল; দেখলাম চারপাশ এত চুপচাপ দেখে সেও এখন সন্দেহ করতে শুরু করেছে। আমরা দ্রুত পায়ে সেই এবরো-খেবরো জমিটার দিকে এগোতে লাগলাম; তবে বৃত্তাকার পথে অনেকটা ঘুরে মরাটার কাছে গেলাম পাছে আমাদের পায়ে লেগে সেই রাইফেল দুটো ছুটে যায়, তা ছাড়া চিতাবাঘটাও হয় ত আশেপাশেই রয়েছে। আমরা ঘুরপথে উপরের দিক থেকে গর্তের কাছ গিয়ে দেখি ‘জিন ট্র্যাপ’টা গর্তের মধ্যে নেই। আমাদের আশা আবার বাড়তে শুরু করল। ‘পেট্রোম্যাক্সে’র উজ্জ্বল আলোয় খুব শীগগিরই ‘জিন ট্র্যাপ’টা আমাদের চোখে পড়ল - পাহাড়ের ঢালু অংশে দশ গজ দূরে সেটা পড়ে রয়েছে; দাঁতগুলো বসানোই রয়েছে কিন্তু সেটা ফাঁকা। মরাটার মাথাটা উঁচু বাঁধের মত জায়গাটার উপরে আর নেই এবং বেশ কিছুটা মাংসও খাওয়া হয়েছে।

আমরা যখন আমগাছটার কাছ থেকে ফিরে গিয়ে মাচানে উঠলাম তখন আমাদের মনের যা তিক্ত অবস্থা সেটা ভাষায় প্রকাশ না করাই ভাল। আমাদের আর জেগে থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না। কোন বিছানা নেই, রাতটাও ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, কাজেই গায়ের উপর কিছু খড় বিছিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোর হতেই আমরা উঠে পড়ে আমগাছটার কাছে আগুন জ্বেলে পরপর কয়েক কাপ চা খেয়ে নিয়ে আগুনে গাটা গরম করে মরাটার দিকে এগোলাম। সঙ্গে ছিল আমার ও ইবটসনের লোকজন, পাটোয়ারী এবং গ্রাম থেকে আসা থাকা বেশ কিছু লোক।

আমাদের সে রাতের প্রস্তুতি যদি কেউ কাছে থেকে দেখত, কেউ বুঝতেই পারত না যে একটা অন্ধকার বৃষ্টির রাতে কি ভাবে মানুষখেকোটা, তাকে মারবার জন্য যে কটি উপায় অবলম্বন করা হয়েছিল তার কোন একটিতেও পা না দিয়ে, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে। সে রাতে চিতাটা যে দিক থেকে আশা করা গিয়েছিল সেদিক থেকেই সে সমতল জমিটায় এসেছে এবং সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে যেদিকে আমরা কাঁটাঝোপ ও গাছ পুঁতে রেখেছিলাম সেদিক থেকে এগিয়ে তিনটে গাছ তুলে ফেলে ঝোপ সরিয়ে নিজের ঢোকার মত ফাঁক করে নিয়েছে। সেখান থেকে ঢুকে সে মরাটাকে রাইফেলের দিকে ফুট খানেক টেনে নিয়ে যাওয়ায় টেনে রাখা সুতোটা ঢিলে হয়ে গিয়েছে; এবার সে মহিলার কোমরে বেঁধে রাখা সূতোটা বাঁচিয়ে মাংস খেতে শুরু করেছে। ঠিক যে সব জায়গায় আমরা বিষ মিশিয়ে রেখেছিলাম সেসব জায়গা বাদ দিয়ে পুরো শরীরটাই সে খেয়ে ফেলেছে।

খিদে মিটিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য চিতাটা সুবিধামত আশ্রয়ের খোঁজে যাবার সময় যে ভয়টা আমি পেয়েছিলাম ঠিক সেটাই ঘটল। বৃষ্টির জলের ওজনে ট্রিগারে টান পড়ে ‘জিন ট্র্যাপ’টা ছুটে গেল এবং সেটা হল ঠিক তার পেছনের পা যখন ‘ট্র্যাপে’র উপরে রয়েছে সেই অবস্থায়। এবারই সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটল। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ‘ট্র্যাপ’টা বয়ে নিয়ে আসার সময় যার হাতে সেটা ছিল তার হাত থেকে পাথরের উপর পড়ে গিয়ে একটা তিন ইঞ্চি লম্বা দাঁত ভেঙে যায় এবং চিতাটার পেছনের পা ঠিক সেই ফাঁকের ভিতরে গিয়ে পড়ে। এসব সত্বেও সে আশি পাউন্ড ওজনের ‘ট্র্যাপ’টা গর্ত থেকে বের করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দশ গজ টেনে নিয়ে গিয়েছে। ‘ট্র্যাপে’র দাঁত যদি না ভাঙা থাকত তাহলে সে পালাবার পথ পেত না। এখন চিতাটার বদলে ‘ট্র্যাপে’র সঙ্গে লেগে রয়েছে কিছু লোম ও এক টুকরো চামড়া। পরে আমরা দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলাম যে এই চামড়ার টুকরোটা যেখান থেকে সেটা ছিঁড়ে এসেছিল তার সঙ্গে ঠিক ঠিক খাপ খেয়ে যায়।

চিতাটির আচরণ ও যেভাবে সে চলাফেরা করছে সেটা যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন এটা ভুলে গেলে চলবে না যে আট বছর ধরে সে মানুষ মেরে চলেছে। এজন্যই, খোলা জায়গা ছেড়ে, পোঁতা গাছগুলি উপড়ে ফেলা, মরাটিকে নিজের দিকে সুবিধাজনক অবস্থায় টেনে নিয়ে যাওয়া এবং মরাটার যে সব জায়গায় বিষ মেশানো ছিল ঠিক সেই অংশ গুলি বাদ দিয়ে মাংস খাওয়া ইত্যাদি যা কিছু সে করেছে সবই ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার।

‘ট্র্যাপ’টা ছুটে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা আমি দিয়েছি, আমি নিশ্চিত যে সেটাই সত্যি। এটা নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার যে ঠিক যে সময়ে বৃষ্টির জলে ‘ট্র্যাপে’র স্প্রিং ছুটে গিয়েছিল সেই মুহূর্তেই চিতাটার পা ফাঁদের উপরে ছিল।

‘জিন ট্র্যাপ’টা ঠিকঠাক করতে করতেই বৃদ্ধা মহিলার আত্মীয় স্বজন সেখানে পৌঁছে মৃতের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা নিয়ে সৎকার করতে চলে গেল আর আমরা আমদের লোকজনদের নিয়ে রুদ্রপ্রয়াগে ফিরে চললাম।

সে রাতে কোন এক সময়ে চিতাটা আবার আমগাছটির কাছে ফিরে এসেছিল কারণ যে জায়গাটা রক্তে ভেসে গিয়েছিল, তখন অবশ্য বৃষ্টিতে সে দাগ মুছে গিয়েছে, সে জায়গায় তার পায়ের ছাপ দেখা গেছে। আমরা সে ছাপ অনুসরণ করে দেখেছি চিতাটা সেখান থেকে তীর্থযাত্রীদের পথটায় নেমে এসেছে, তারপর আরো চার মাইল এগিয়ে ইনস্পেকশন বাংলোর ফটকের গোড়ার মাটিতে আঁচড় কেটে সেই রাস্তা ধরেই মাইল খানেক এগিয়ে আমার এক পরিচিত বন্ধুর গরু-ছাগলের আস্তানায় অহেতুক ভাবে একটা ছাগলকে মেরে রেখে চলে গেছে।
যারা রাইফেল হাতে নিয়ে শিকার করতে উৎসাহী তাদের উদ্দেশ্যে আমি একটা কথা বলতে চাই যে আমার সব ব্যর্থতা ও হতাশা আমার মনের বলকে আরো জোরালো করে তুলেছে এবং আমার মনোগত ইচ্ছা হল সব ধরণের ফাঁদ ও বিষ প্রয়োগ ছাড়াই আমি সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকব যখন আমি মানুষখেকোটাকে রাইফেলের গুলিতেই মারতে পারব, কারণ নির্ভুল ও নিখুঁত লক্ষ্যে যদি মানুষখেকোটাকে না মারতে পারি তবে রাইফেল রাখার উদ্দেশ্য কি ?


(চলবে)

 



লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।