প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬

 

রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)

দীপক সেনগুপ্ত

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫)

৩। আতঙ্ক 


(আগের অংশ) ভয় কথাটি দৈনন্দিন জীবনের এত ছোটখাট ব্যাপারেও ব্যবহৃত হয় যে, যখন সত্যিই ভয় পাবার মত কোন ঘটনা ঘটে তখন শব্দটি তার প্রকৃত অর্থ হারিয়ে ফেলে। গাড়োয়ালের পাঁচশ বর্গমাইল স্থানে বসবাস করা পঞ্চাশ হাজার অধিবাসী এবং ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর পায়ে হেঁটে যাওয়া ষাট হাজার তীর্থযাত্রীদের কাছে আতঙ্কের অর্থ কি ছিল সেটা আমি আপনাদের বোঝাবার চেষ্টা করব।

রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকোটির নামে যে কার্ফ্যুর অবস্থা বলবৎ হয়েছিল, সত্যিকারের কার্ফ্যুর আদেশ জারি হলে মানুষ বোধ হয় এতটা মান্য করত না।

দিনের আলো যতক্ষণ থাকত ততক্ষণ জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। হেঁটে বহুদূরের বাজারে যাওয়া, পাশের গ্রামে আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ত ছিলই, এছাড়া মহিলাদের পাহাড়ের ওপরে গৃহপালিত পশুদের জন্য ঘাস কাটতে, ছোটরা স্কুলে বা ছাগল চরাতে কিম্বা গাছের শুকনো ডাল যোগাড় করতে যেত। সময়টা গ্রীষ্মকাল হলে তীর্থযাত্রীরা একা বা দল বেঁধে কেদারনাথ ও বদরিনাথের মন্দির দর্শন করতে যেত বা দর্শন শেষ করে ফিরত।

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার সঙ্গে ছায়া ঘনিয়ে এলে এসব অঞ্চলের সমস্ত অধিবাসীদের মধ্যেই হঠাৎ পরিবর্তন চোখে পড়ত। দেখা যেত, যে সব মানুষেরা বাজারে বা পাশের গ্রামে গিয়েছিল তারা দ্রুত বাড়ি ফিরে আসছে, মহিলারা কাটা ঘাসের বোঝা বয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে দৌড়চ্ছে; আর যে সব ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়েছিল বা পাহাড়ের ওপর ছাগল চরাতে বা শুকনো ডাল কুড়োতে ব্যস্ত ছিল তাদের মায়েরা উৎকন্ঠিত হয়ে তাদের ডাকছে এবং স্থানীয় লোকেরা তীর্থযাত্রিদের পরামর্শ দিচ্ছে দ্রুত তাদের আশ্রয়ে ফিরে যেতে।

যখন রাত্রি নেমে আসত তখন সর্বব্যাপী নৈঃশব্দ্যে সমস্ত অঞ্চলটি ডুবে যেত, কোথাও এতটুকু শব্দ বা নড়াচড়া নেই। সকলেই শক্ত করে দরজা বন্ধ করে বাড়ির ভেতরে রয়েছে। যে সব হতভাগ্য তীর্থযাত্রীদের যাত্রী নিবাসে কোনো ঘর জোটেনি তারা গাদাগাদি করে বসে থাকত। ঘরেই হোক বা বাইরেই হোক এরা কেউ টুঁ শব্দটি করতা না, পাছে মানুষখেকোটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

দীর্ঘ আট বছর ধরে গাড়োয়ালবাসীদের কাছে আতঙ্কের অর্থ কি ছিল সেটা এ থেকেই স্পষ্ট হবে।
এবার আমি আতঙ্কের কারণ ব্যাখ্যা করে কয়েকটি ঘটনা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরব।

পিতৃমাতৃহীন এক বালককে চল্লিশটি ছাগলের একটি দল দেখাশোনা করার ভার দেওয়া হয়েছিল। বালকটি ছিল নিম্ন বর্ণের অস্পৃশ্য শ্রেণীর। প্রতি সন্ধ্যায় সে যখন ছাগল চড়িয়ে ফিরে আসত তখন তাকে খেতে দেওয়া হত এবং ছাগলের সঙ্গেই একটা ছোট ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত। ঘরটা ছিল সারি দেওয়া অনেক গুলি দোতলা বাড়ির একতলায় – দোতলায় ঠিক যে ঘরে ছাগল ও ছেলেটির মালিক থাকত তারই নীচে। ঘুমের মধ্যে ছাগলগুলি যাতে গায়ে এসে না পড়ে সেজন্য ছেলেটি নিজেই ঘরটির বাঁদিকের একটি কোণের কিছুটা জায়গা ঘিরে নিয়েছিল।

ঘরটিতে কোন জানালা ছিল না, ছিল কেবল একটি মাত্র দরজা। ছেলেটি ঠিকঠাক ঘরে ঢুকে গেলে, মালিক দরজাটি বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে কুলুপ এঁটে দিত। অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য ছেলেটি ঘরের ভিতরে একটা পাথরের টুকরো দরজার সঙ্গে চেপে রাখত। এক রাতে ছেলেটি ঘরে ঢুকলে মালিক যথারীতি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই, যেহেতু বাঘটি দরজার বাইরে গভীর আঁচড়ের দাগ কেটেছিল সেটা আমি দেখেছি। সে রাতে আঁচড় কাটতে গিয়ে যে ভাবেই হোক কুলুপটি খুলে যায়; এর পর পাথরটি সরিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়া ছিল সামান্য ব্যাপার। ঘরটিতে চল্লিশটি ছাগল গাদাগাদি করে থাকার জন্য বাঘটির নড়াচড়ার খুব বেশি জায়গা থাকার কথা নয়। বাঘটি ঘরে ঢোকার পর ছাগলগুলি নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বাঘটি ছাগলগুলির পিঠের উপর দিয়ে না কি পেটের তলা দিয়ে ঘরের কোণে শুয়ে থাকা ছেলেটির কাছে পৌঁছেছিল, সেটা কল্পনার বিষয়।

ধরে নেওয়া যেতে পারে, দরজা খুলে ফেলে বাঘটি যখন ঘরে ঢুকেছে অথবা ছাগলগুলি হয় তো যখন ডেকেছে, কোনো শব্দই ছেলেটি শোনে নি অথবা তার ঘুমই ভাঙে নি; সাহায্যের জন্য সে কোনো চীৎকার করেছিল বলেও জানা যায় নি।

দরজা খোলা পেয়ে ছাগলগুলি বাইরে বেরিয়ে আসে। বাঘটি ঘরের কোণে ছেলেটিকে মেরে তাকে বয়ে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নেমে কয়েকটা ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে নুড়ি ছড়ানো একটা খাদে গিয়ে বসে। সূর্য ওঠার কয়েক ঘন্টা পরে ছেলেটির মালিক এখানে এসেই ছেলেটির যেটুকু অংশ চিতাটি ফেলে রেখেছিল সেটা দেখতে পায়।

অবিশ্বাস্য হলেও চল্লিশটি ছাগলের একটির গায়ে আঁচড়টুকুও পর্যন্ত লাগে নি।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হল – একজন প্রতিবেশী এক বন্ধুর বাড়িতে জমিয়ে তামাক খেতে গিয়েছিল। ঘরটি ছিল L –আকৃতির এবং সেটিতে ছিল একটি মাত্র দরজা। দুজনে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে যেখানে বসেছিল সেখান থেকে দরজাটা দেখা যায় না। দরজাটা ভেজানো ছিল কিন্তু খিল দেওয়া ছিল না, কারণ সে রাত্রি পর্যন্ত সে গ্রামে বাঘের মানুষ মারার কোনো ঘটনা ঘটে নি।

ঘরটা ছিল অন্ধকার এবং ঘরের মালিক তার বন্ধুকে হুকাটি এগিয়ে দিতেই সেটি পড়ে গিয়ে জ্বলন্ত কাঠ কয়লা ও তামাক ছড়িয়ে পড়ে। যদি সে সাবধান না হয় তবে কম্বলে আগুন লেগে যাবে, বন্ধুর উদ্দেশ্যে এই সাবধান বাণী উচ্চারণ ক’রে সে নীচু হয়ে কয়লাগুলি তুলতে গিয়েই দরজার দিকে তার নজর পড়ে। চাঁদের আবছা আলোয় সে দেখতে পায় চিতাবাঘটি তার বন্ধুকে মুখে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরে লোকটি সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আমাকে বলে – “আমি আপনাকে সত্যি বলছি সাহেব, আমি এক হাত দূরে বসে থাকা আমার বন্ধুর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ টুকুও শুনিতে পাই নি। বাঘটি যখন বন্ধুকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, সে অবস্থায় আমার করার কিছুই ছিল না। বাঘটি বেরিয়ে গেলে আমি চুপিসাড়ে দরজার কাছে গিয়ে সেটিকে দ্রুত বন্ধ করে দিই।”

তৃতীয় ঘটনা – গুর্জর শ্রেণীর দু’জন লোক তাদের ত্রিশটি মোষের দল চরাবার জন্য একটা মাঠ পেরিয়ে আর একটি মাঠে যাচ্ছিল। তারা সম্পর্কে ছিল দুই ভাই এবং বড় ভাইয়ের বারো বছরের মেয়েটাও ছিল তাদের সঙ্গে।
সে অঞ্চলটা ছিল তাদের সম্পূর্ণ অজানা। হয় তারা মানুষখেকোটা সম্বন্ধে কিছুই শোনে নি, অথবা যেটার সম্ভাবনা বেশি, তারা ভেবেছিল যে বিপদ এলে মোষগুলোই তাদের রক্ষা করবে।

রাস্তার কাছেই আট হাজার ফুট উচ্চতায় একফালি সরু সমতল জমি ছিল এবং ঠিক নীচেই ছিল কাস্তে আকারের সিকি একরের একখন্ড জমি যেখানে দীর্ঘদিন কোন চাষ হয় নি। এখানেই তারা তাঁবু ফেলবে ঠিক করল এবং মোষের খাবারের জন্য চারপাশের জঙ্গল থেকে পর্যাপ্ত ডালপাতা কেটে আনল। এরপর মোষগুলোকে মাঠের মাঝামাঝি জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটা লম্বা সারিতে বেঁধে রাখল।

মেয়েটি রাতের খাবার তৈরি করলে খাওয়া সেরে নিয়ে রাস্তা এবং মোষের মাঝখানে সরু জমিটায় চাদর বিছিয়ে তিনজনে ঘুমিয়ে পড়ল।

রাতটা ছিল অন্ধকার। ভোর হবার কিছু আগে মোষের গলার ঘন্টা ও তাদের ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনে লোক দুটো জেগে উঠল। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝতে পেরেছিল যে কোন মাংসাশী পশুর আগমন ঘটেছে। একটা লন্ঠন জ্বেলে তারা দেখতে গেল কোন মোষ দড়ি ছিঁড়েছে কি না; তাদের শান্ত করারও প্রয়োজন ছিল।
তারা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য গিয়েছিল; ফিরে এসে দেখে যে মেয়েটাকে তারা ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে গিয়েছিল সে বিছানায় নেই এবং যেখানে সে শুয়েছিল সেখানে চাদরের উপর চাপ চাপ রক্ত।

দিনের আলো ফুটলে বাবা ও কাকা রক্তের দাগ ধরে এগিয়ে চলল। মোষগুলোর ধার দিয়ে ঘুরে সরু জমিটা পেরিয়ে পাহাড়ের ঢাল ধরে কয়েক গজ এগিয়ে একটা জায়গায় চিতাটা মেয়েটাকে খেয়েছে।

“সাহেব, আমার ভাইয়ের জন্মটাই অশুভ নক্ষত্রে হয়েছে। তার কোন ছেলে নেই, এই একটা মাত্র মেয়ে ছিল, যথাসময়ে উত্তরাধিকারীও পেত; কিন্তু দেখুন চিতাটা এসে সেই মেয়েটাকেই খেয়েছে।”

মানুষ মারা যাবার এরকম বহু কাহিনী আমি আপনাদের শুনিয়ে যেতে পারি। প্রতিটি ঘটনার পেছনেই লুকিয়ে আছে কোন না কোন করুণ কাহিনী। তবে আমার মনে হয় রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকোটির জন্য গাড়োয়ালবাসীদের যে যথেষ্ট আতঙ্কিত হবার কারণ ছিল সেটা আমি আপনাদের বোঝাতে পেরেছি। মুশকিল হচ্ছে গাড়োয়ালের লোকেরা অসম্ভব রকমের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী। বাঘের আক্রমণের সঙ্গে এসব যুক্ত হয়ে ভয়টাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এ রকম একটি ঘটনা আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরব।

দিনের আলো ফুটতেই আমি রুদ্রপ্রয়াগ ইন্সপেকশন বাংলোর ছোট ঘরটি থেকে বেরোলাম। বারান্দা পেরিয়ে পায়ে চলা জমির ধুলোর উপর বাঘটির পায়ের ছাপ পড়ে থাকতে দেখলাম। ছাপগুলি একেবারে টাটকা; আমি বেরোবার কয়েক মিনিট আগে বাঘটি বাংলোয় কিছু পাবার নেই দেখে পঞ্চাশ গজ দূরে যাত্রীদের পথের দিকে চলে গেছে।

বাংলো এবং রাস্তার মাঝের জমি শক্ত বলে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে যাবার কোন উপায় নেই। তবে ফটকের কাছে গিয়ে দেখলাম পায়ের ছাপ গোলাবরাই গ্রামের দিকে চলে গেছে। ধুলোর উপর পায়ের ছাপ এত স্পষ্ট, মনে হয় যেন সদ্য ঝরে পড়া বরফের উপর দিয়ে বাঘটি হেঁটে গেছে।

আমি বাঘটির পায়ের ছাপের সঙ্গে এতটাই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম যে অন্য একশটি বাঘের পদচিহ্নের মধ্যে এই বিশেষ ছাপটি খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হত না।

মাংসাশী কোন জন্তুর পায়ের ছাপ থেকে তার লিঙ্গ, বয়স, আকার ইত্যাদি বহু জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করা যায়। মানুষখেকোটির পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে আমার ধারণা হয়েছিল এটি একটি যৌবন অতিক্রান্ত বড় আকারের পুরুষ চিতা।

অত সকাল বেলা রাস্তায় কোন লোক চলাচল ছিল না। চিতাটি দিনের আলোয় চলাফেরা করার অভ্যাস হয়ত বদলেছে ভেবে আমি রাস্তার প্রতিটি বাঁক অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পেরোতে লাগলাম এবং এভাবে মাইল খানেক যাবার পর দেখি বাঘটি মূল রাস্তা ছেড়ে অন্য একটি পথ ধরে ঝোপ পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেছে। বাঘটি রাস্তা ছেড়ে যেখান থেকে বেরিয়ে গেছে সেখান থেকে একশ গজ দূরে কাঁটা ঝোপ দিয়ে ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গায় এক পাল ছাগল ও ভেড়া আমার চোখে পড়ল। আগের দিন সন্ধ্যা বেলাতেই এরা এখানে এসেছে। আমি এগিয়ে গেলে এদের মালিক শক্তপোক্ত চেহারার একটি লোক ঝোপের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে বলল যে সে কোন বাঘকে দেখতে পায় নি, তবে ভোরের দিকে তার সঙ্গের কুকুর দুটো বেশ কিছুক্ষণ চেঁচিয়েছে এবং তার কিছু পরে পাহাড়ের উপরে জঙ্গলের দিক থেকে একটা কাকরের (হরিণ জাতীয় প্রাণী) ডাক শোনা গেছে।

আমি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম সে একটি ছাগল আমাকে বিক্রি করতে রাজি আছে কি না, উত্তরে সে জানতে চাইল কেন আমি সেটা চাইছি। আমি যখন বললাম বাঘটি মারার জন্য টোপ হিসাবে আমি ছাগলটি চাইছি, তখন সে গম্ভীর হয়ে আমার দেওয়া একটা সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার পাশে একখন্ড পাথরের উপর গিয়ে বসল।

আমার প্রশ্নের কোন উত্তর সে দিল না। আমরা বসে বসে সিগারেট টানতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে লোকটি বলতে শুরু করল – “সাহেব, এখন দেখছি বদরিনাথের কাছে আমার গ্রাম থেকে এখানে আসার রাস্তায় আমি যার কথা শুনেছি তুমিই সেই লোক। তুমি একটা নিষ্ফল কাজ করতে বাড়ি ছেড়ে এত দূরে এসেছ এটা ভেবে খারাপ লাগছে। এসব মানুষ যে মারছে সে কোন পশু নয়, সে দুষ্ট আত্মা। একে তুমি গুলি করে মারবে ভেবেছ? তোমার আগে আরও ত অনেকে চেষ্টা করেছে। আমি যা বলেছি, প্রমাণ হিসাবে দ্বিতীয় সিগারেটটি খেতে খেতে তোমাকে একটা কাহিনী বলছি শোন। এটি আমার বাবা আমাকে বলেছিল এবং সকলেই জানে যে, আমার বাবাকে কখনও মিথ্যা কথা বলতে শোনা যায় নি।”

“আমার বাবার তখন তরুণ বয়স, আমি তখনও জন্মাই নি। এখন যেমন এখানে দেখছ, সে রকমই একটি দুষ্ট আত্মা আমাদের গ্রামে অত্যাচার শুরু করেছিল, সকলে বলত সেটা না কি একটি চিতাবাঘ। পুরুষ, মহিলা, শিশুরা নির্বিচারে মারা যেতে লাগল এবং ঠিক এখনকার মতই জন্তুটিকে মারবার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। ফাঁদ পেতে, গাছের উপর থেকে গুলি চালিয়ে এবং অন্য সব চেষ্টা সত্বেও বাঘটিকে যখন মারা গেল না তখন এক ভয়াবহ আতঙ্ক সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল এবং কোন লোকই সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত ঘরের বাইরে বেরোতে সাহস করত না।”

“তখন আমার বাবার গ্রাম ও আশেপাশের গ্রামের মোড়লরা একত্র হয়ে পঞ্চায়েত সভা ডেকে মানুষখেকোটির কবল থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করার জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু করল। এ সময়ে এক বৃদ্ধ, সে তখন সদ্য বাঘের আক্রমণে মারা যাওয়া তার নাতির সৎকার করে শ্মশান থেকে ফিরেছে, উঠে দাঁড়িয়ে বলল যে তার পাশে শুয়ে থাকা নাতিকে তুলে নিয়ে গিয়ে যে মেরে ফেলেছে, সেটি কোন চিতাবাঘ নয়; সেটি তার নিজেরই সম্প্রদায়ের কোন লোক।  তার রক্ত খাবার ইচ্ছা হলে সে চিতাবাঘের রূপ ধরে এবং একে আগুন ছাড়া অন্য কোন উপায়ে মারা যাবে না। বৃদ্ধটি আরও জানালো যে তার সন্দেহ হয় একজন মোটা সাধুবাবাকে;  কাছেই একটা ভাঙা মন্দিরের কাছে সে থাকে”।

“একথা শোনার পর মহা শোরগোল শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল, নাতির মৃত্যুতে বুড়োর মাথা খারাপ হয়ে গেছে; আবার অনেকে বলল, কথাটা ঠিক কারণ সাধুটি গ্রামে আসার পরেই মানুষ মারার ঘটনা ঘটছে এবং একদিন একটা লোক মারা যাবার পর সাধুটি রোদে বিছানা পেতে সারাদিন ধরে ঘুমিয়েছে।” 

“যারা জমায়েতে এসেছিল তাদের চেঁচামেচি একটু থামলে, উপস্থিত সবাইকে তিনটি দলে ভাগ করা হল। ঠিক হল, সাধুটির গতিবিধির উপর নজর রাখা হবে। যে সময় থেকে পরের মানুষটি মারা যাবে সে সময় থেকেই প্রথম দলটি তাদের কাজ শুরু করবে; মানুষ কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানেই মারা পড়ছিল।”

“প্রথম ও দ্বিতীয় দলটির যখন পাহারা ছিল, তারা কিছুই দেখতে পায় নি। আমার বাবা ছিল তৃতীয় দলে। রাত নেমে এলে, একটি সুবিধা জনক স্থানে বসে সে সাধুটির উপর লক্ষ্য রাখছিল। কিছুক্ষণ পরেই সাধুটি নিঃশদে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কয়েক ঘন্টা পরে পাহাড়ের উপরের গ্রাম থেকে একটা আর্ত চীৎকার ভেসে এল এবং তার পরেই সব চুপচাপ।”

“সে রাতে আমার বাবার দলের কেউই ঘুমোয় নি এবং ভোরের আলো সবে যখন ফুটতে শুরু করেছে তখন সাধুটিকে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরতে দেখা গেল, তার সারা মুখে রক্ত লেগে রয়েছে।”

“সাধু তার কুটিরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে, যারা পাহারায় ছিল তারা গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে পাশে রাখা খড়ের গাদা থেকে বড় বড় গোছা খড় তুলে নিয়ে এল। সূর্য যখন উঠেছে তখন দেখা গেল সাধুর কুটিরটি যেখানে ছিল সেখানে চাপা আগুনের উপর কিছু ভস্মরাশি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে দিন থেকেই মানুষ মারা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।”

“এখানে এখন যে বহু সংখ্যক সাধু রয়েছে, তাদের কারো উপরে কোন সন্দেহ এখনও জাগে নি। তবে আমার বাবার সময়ে যা করা হয়েছিল, এখানে সেরকম যতদিন না হচ্ছে ততদিন গাড়োয়ালবাসীকে ভুগতে হবে।”

“ আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন আমি আপনাকে একটা ছাগল বিক্রি করব কি না। সাহেব, আপনাকে দেবার মত আমার অতিরিক্ত কোন ছাগল আমার নেই। তবে আমার কাহিনী শোনার পরেও যদি আপনার ছাগল বেঁধে রেখে বাঘটিকে মারার ইচ্ছা থাকে, তবে আমি আপনাকে একটা ভেড়া ধার দিতে পারি। যদি সেটা মারা পড়ে, আপনি তার দাম দিয়ে দেবেন; আর যদি মারা না যায় লেনদেনের কোন প্রশ্ন নেই। আজ সারাদিন এবং সারারাত আমি এখানে আছি, তবে কাল সকালেই কিন্তু আমি রওনা হয়ে যাব।”

“সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যা নেমে এলে আমি সেই ঝোপে ঘেরা জায়গাটিতে এসে পৌঁছলাম এবং লোকটির কাছে বাঘটির দু’রাতের খাওয়া চলতে পারে এরকম একটা মোটা দেখে ভেড়া চেয়ে নিলাম। বাঘটি বারো ঘন্টা আগে যেখান থেকে হেঁটে গেছে সেখানেই রাস্তার কাছে জঙ্গলের মধ্যে ভেড়াটিকে বেঁধে রাখলাম।”
“পর দিন ভোরে উঠে আমার বাংলোর বারান্দা থেকে বাঘটির নেমে যাবার চিহ্ন চোখে পড়ল। দেখলাম সেটি গোলাবরাই গ্রামের দিক থেকে এসে বাংলোয় কিছু না পেয়ে রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের দিকে চলে গেছে। বাঘটি যে মানুষ মারার জন্যই চেষ্টা করছে সেটা বুঝতে পারলাম, কারণ তার জন্য যে ভেড়াটি বেঁধে রাখা ছিল, বেঁধে রাখার পরেই সেটিকে মেরে ফেললেও তার মাংস সে খায় নি।”

“সাহেব, তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যাও, এতে তোমার সময় ও অর্থ দুইই বাঁচবে” – আমাকে এই উপদেশ দিয়ে লোকটি তার ছাগল ও ভেড়ার দল নিয়ে হরিদ্বারের পথে চলে গেল।

প্রশ্ন উঠতে পারে, গাড়োয়ালবাসীকে মানুষখেকোটির কবল থেকে বাঁচাতে সরকার কি করেছে। আমি সরকারের হয়ে কোন ওকালতি করছি না, তবে দশ সপ্তাহে কয়েকশ’ মাইল পথ পায়ে হেঁটে আক্রান্ত গ্রামগুলির প্রায় সব ক’টিতে ঘুরে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে সরকার তার ক্ষমতার মধ্যে যা যা করণীয় ছিল তা সবই করেছে। স্থানীয় লোকেরা বলে - সরকার থেকে দশ হাজার টাকা এবং দু’টি গ্রাম পুরস্কার দেবার ঘোষণা করা হয়েছে, যেটা গাড়োয়ালের চার হাজার লাইসেন্সধারী শিকারিকে কাজে নামানোর পক্ষে যথেষ্ট। অন্যান্য শিকারিকেও লোভনীয় পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতি এবং বাঘটিকে মারতে পারলে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণাও করা হয়েছে। চার হাজার বন্দুকের লাইসেন্স, যা বর্তমানে রয়েছে, সেটা ছাড়াও বাঘটিকে মারার জন্য অতিরিক্ত আরও তিনশ’ বিশেষ লাইসেন্স মঞ্জুর করা হয়েছে। গাড়োয়ালের সৈন্যবাহিনীর যে বিভাগটি ল্যান্সডাউনে ছিল তাদের ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় সঙ্গে বন্দুক রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতের সমস্ত শিকারির কাছে বাঘটিকে মারার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। অসংখ্য ফাঁদ পেতে ছাগল বেঁধে রাখা হয়েছে বাঘটি যে রাস্তায় চলাফেরা করে তার ধারে। গ্রামের পাটোয়ারীদের প্রচুর পরিমাণে বিষ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে শিকার করা মানুষের মাংসে সেটা মিশিয়ে রাখার জন্য।

এত আয়োজনের ফল যেটা হয়েছে সেটা হল বাঘের পেছনের পায়ের বাদিকে পাতায় গুলি লেগে শুধু কিছুটা চামড়া উঠে যাওয়া। ডেপুটি কমিশনার তার রিপোর্টে মন্তব্য করেছেন যে, বহু ব্যবস্থা নেওয়া সত্বেও বাঘটি একই ভাবে তার হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিষ মেশানো মাংস তার ক্ষেত্রে সম্ভবত উত্তেজকের কাজ করেছে।
তিনটি বেশ কৌতুকপ্রদ ঘটনা সরকারি নথিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমি সংক্ষেপে সেগুলির উল্লেখ করব।
প্রথম ঘটনা : সংবাদপত্রে শিকারিদের কাছে আবেদনের বিজ্ঞপ্তি পড়ে দু’জন অল্পবয়স্ক ব্রিটিশ অফিসার বাঘটিকে মারতে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে ১৯২১ সালে রুদ্রপ্রয়াগে এসেছিল। তাদের কেন যে মনে হয়েছিল যে বাঘটি অলকানন্দার ঝোলাপুল দিয়ে যাতায়াত করে সেটা জানা নেই। যাই হোক, চিতাটা যখন রাত্রিবেলা পুল পেরিয়ে যায় তখন সেখানেই সেটিকে মারবে বলে তারা ঠিক করল। পুলটির দু’প্রান্তেই ঝোলাপুলের দড়ি বেঁধে রাখার জন্য স্তম্ভ ছিল। শিকারিদের একজন বাঁদিকের স্তম্ভে এবং অপর জন ডান দিকেরটিতে বসবে ঠিক হল।
দু’মাস বসার পর বাঁদিকের শিকারি এক রাতে বাঘটিকে পুল পেরিয়ে যেতে দেখে এবং নিশানা ঠিক করে গুলি করে; ওদিকে বাঘটিকে দৌঁড়ে যেতে দেখে ডান দিকে বসে থাকা ব্যক্তি তার রিভলবারের ছ’টি গুলিই বাঘটিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেয়। পরের দিন পুলের উপর রক্তের দাগ দেখে এবং আঘাতটি মারাত্মক মনে করে একটি অনুসন্ধান দল দীর্ঘদিন ধরে বাঘটির খোঁজ চালিয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী বাঘটি এর পর ছ’মাস কোনো মানুষ মারে নি।

যারা সাতটি গুলি ছোঁড়ার শব্দ শুনেছিল এবং যারা অনুসন্ধান চালিয়েছিল তাদের কাছে আমি ঘটনাটি শুনেছি। তাদের ধারণা প্রথম গুলিটি বাঘের পিঠে এবং পরের কয়েকটি গুলি সম্ভবতঃ মাথায় লেগেছে এবং এজন্যই বহুদিন ধরে খোঁজ চালানো হয়েছে। আমার কিন্তু বিবরণ শুনে মনে হয়েছিল যে গুলি বাঘটির পায়ে লেগেছে এবং পরে আমি দেখে খুসি হয়েছিলাম যে আমার ধারণাটাই ঠিক। প্রথম লোকটির গুলি বাঘের বা দিকের পায়ে লেগেছে এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির একটি গুলিও বাঘের গায়ে লাগে নি।

দ্বিতীয় ঘটনা : দরজা-নেমে-আসা ফাঁদ পেতে প্রায় কুড়িটি বাঘ ধরা হয়েছিল এবং এদের মধ্যে একটিকে দেখে সকলেই মনে করল যে সেটিই সেই মানুষখেকো। কিন্তু কোন হিন্দুই বাঘটিকে মারতে রাজি হল না, তাদের বিশ্বাস বাঘটিকে মারা হলে বাঘের কবলে যারা মারা গিয়েছে তাদের প্রেতাত্মা এসে তাদের উপর অত্যাচার চালাবে। এই অবস্থায় ত্রিশ মাইল দূরে বাস করে এমন একজন ভারতীয় খ্রিষ্টানের ডাক পড়ল। কিন্তু সে এসে পৌঁছবার আগেই বাঘটি খাঁচা ভেঙে পালিয়ে যায়।

তৃতীয় ঘটনা : একবার বাঘটি একটি মানুষ মেরে মৃতদেহটি নিয়ে ছোট একফালি জমিতে বসেছিল। পর দিন সকালে লোকটিকে যখন সবাই খুঁজতে বেরোল তখন দেখা গেল বাঘটি জঙ্গল থেকে বেরোচ্ছে। তাড়া খেয়ে বাঘটি একটি গুহায় ঢুকে পড়ে। উপস্থিত সবাই বড় বড় পাথরের চাই দিয়ে গুহার মুখটি বন্ধ করে তার উপর কাঁটা ঝোপ ফেলে রাখে। প্রতিদিনই বিরাট জনতা গুহার কাছে এসে জড় হয়। পঞ্চম দিনে প্রায় পাঁচশো লোক এসে হাজির হল, এমন সময় গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যঙ্গের সুরে ‘এখানে কোনো বাঘই নেই’ বলে গুহার মুখের ঢাকা সরিয়ে ফেলে। বাঘটি হঠাৎ গুহা থেকে সজোরে বেরিয়ে এসে পাঁচশো লোকের মধ্য দিয়েই পথ করে নিয়ে পালিয়ে যায়। বাঘটি যখন মানুষখেকো হয়ে উঠেছে এসবই তার কিছু পরের ঘটনা। যদি ঝোলা পুলের উপর বাঘটি মারা পড়ত অথবা খাঁচায় বন্দী অবস্থায় কেউ যদি তাকে গুলি করে মারত কিম্বা যদি সেটিকে গুহায় বন্ধ করে রাখা যেত তাহলে হয় ত পরে এতগুলি মানুষকে মরতে হত না এবং গাড়োয়াল দীর্ঘ দিনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত।       

৪। রুদ্রপ্রয়াগ যাত্রা


নৈনিতালে চ্যালেট থিয়েটারে ‘ইওমেন অফ থি গার্ড’ দেখতে গিয়ে একটা বিরতির সময়ে আমি রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকোটির কথা নির্দিষ্টভাবে শুনি। সেটা ছিল ১৯২৫ সাল। এর আগে আমি ভাসা ভাসা ভাবে মানুষখেকো চিতাটির কথা শুনেছি, সংবাদপত্রেও পড়েছি কিন্তু বন্দুকের লাইসেন্সধারী যে চার হাজার ব্যক্তি গাড়োয়ালে রয়েছে এবং রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মাত্র সত্তর মাইল দূরে ল্যান্সডাউনে যে বহু সংখ্যক শিকারি বাঘটি শিকার করতে ব্যগ্র হয়ে রয়েছে তারা কেউই যে আমার মত একজন আগন্তুককে স্বাগত জানাবে না সেটা বেশ বুঝেছিলাম।

আমি চ্যালেট থিয়েটারে বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস পানীয় হাতে নিয়ে শুনতে পেলাম, মাইকেল কেনি, যিনি যুক্তপ্রদেশ সরকারের মুখ্যসচিব ছিলেন এবং পরে আসামের রাজ্যপাল হয়েছিলেন, একদল লোককে চিতা বাঘটি মারার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। এটা শুনে আমার খুবই অবাক লাগল। কিন্তু শ্রোতাদের এ কথায় কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হল না। অনেককে বলতে শোনা গেল –“যে চিতাটি একশ’র বেশি মানুষ মেরেছে তার পিছু নেওয়া? জীবন থাকতে কখনই নয়।”

পরের দিন সকালে আমি মাইকেল কেনির সঙ্গে দেখা করে মানুষখেকোটির সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য যোগাড় করলাম। তবে বাঘটি ঠিক কোন অঞ্চলে তখন তার আস্তানা গেড়েছে সেটা তিনি বলতে পারলেন না। তিনি আমাকে রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে ইবটসনের সঙ্গে দেখা করতে বললেন; বাড়ি ফিরে দেখলাম ইবটসনের লেখা একটা চিঠি আমার টেবিলে পড়ে রয়েছে।

ইবটসন-যিনি আসলে স্যার উইলিয়ম ইবটসন, যুক্তপ্রদেশে রাজ্যপালের উপদেষ্টা ছিলেন এবং সম্প্রতি তিনি গাড়োয়ালের ডেপুটি কমিশনারের পদে বদলি হয়ে এসেছেন। নতুন পদে এসে তিনি গাড়োয়ালের লোকদের বাঘটির কবল থেকে মুক্ত করাই তার প্রধান কাজ বলে মনে করেছেন। সে প্রসঙ্গেই তিনি আমাকে চিঠি পাঠিয়েছেন।

আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। রাণীক্ষেত, আদিবদরী, কর্ণপ্রয়াগ হয়ে আমি দশ দিনের দিন সন্ধ্যাবেলা নাগ্রাসুর কাছে রাস্তার পাশে এক ইনস্পেকশন বাংলোয় এসে পৌঁছলাম। নৈনিতাল ছাড়ার সময় আমি জানতাম না যে এই বাংলোয় থাকার জন্য অনুমতি পত্র আনতে হয়। বাংলোর চৌকিদার অনুমতি পত্র ছাড়া কিছুতেই আমাকে বাংলোয় থাকতে দিতে রাজি না হওয়ায়, আমার ছ’জন গাড়োয়ালী, যারা আমার মোট বয়ে এনেছিল, আমার পরিচারক এবং আমি রুদ্রপ্রয়াগের রাস্তা ধরে আরও দু’মাইল এগিয়ে একটা সুবিধামত জায়গায় সে রাতের মত আশ্রয় পেলাম।

আমার লোকেরা যখন জল এবং শুকনো ডাল যোগাড়ে করতে ব্যস্ত এবং পরিচারকটি পাথর দিয়ে উনুন তৈরি করার কাজে মন দিয়েছে আমি তখন কুড়ুল হাতে রাত্রি বেলা আত্মরক্ষার জন্য কাঁটাঝোপ কেটে আনতে গেলাম, কারণ আমি আসার পথে দশ মাইল আগেই খবর পেয়েছিলাম যে আমরা মানুষখেকোটির রাজত্বে ঢুকছি।

রাতের খাবার তৈরি করার জন্য আগুন জ্বালার কিছুক্ষণ পরেই পাহাড়ের উপরের গ্রাম থেকে কেউ একজন উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা করল যে আমরা খোলা জায়গায় কি করছি? সে আরও জানালো যে সে জায়গায় থাকলে আমাদের দলের এক বা একাধিক ব্যক্তি বাঘের আক্রমণে মারা যাবে। বাইরে বেরিয়ে চেঁচিয়ে যিনি উপদেশটি আমাদের দিয়েছেন তিনি অবশ্যই বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন, কারণ তখন সেখানে অন্ধকার নেমে এসেছে। মাধো সিংকে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে (‘ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুন’ বইতে ‘চৌগড়ের বাঘিনী’ দ্রষ্টব্য)- সেই মাধো সিং যেন সকলের মনের কথা তুলে ধরেই বলল –“সাহেব, আমরা এখানেই থাকবো, কারণ আমাদের লন্ঠনে সারা রাতের জন্য যথেষ্ট তেল রয়েছে এবং আপনার হাতে রয়েছে রাইফেল।”

লন্ঠনে সারা রাতের মত তেল সত্যিই ছিল, কারণ গুলি ভরা রাইফেল পাশে রাখা অবস্থায় পরের দিন সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখনও সেটি জ্বলছে। কাঁটাঝোপ দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা ছিল নিতান্তই মামুলি এবং দশ দিন ধরে হেঁটে এসে আমরা এত ক্লান্ত ছিলাম যে সে রাতে যদি চিতা বাঘটি সেখানে আসত তবে অনায়াসেই আমাদের কাউকে ধরতে পারত।

পরের দিন আমরা রুদ্রপ্রয়াগে এসে পৌঁছলাম এবং ইবটসন যাদের জানিয়ে রেখেছিলেন তারা সবাই এগিয়ে এসে আমাকে উষ্ণ অভর্থনা জানালো।


(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।