সাহিত্য

মে ৩০, ২০১৬
রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)
দীপক সেনগুপ্ত
১৪। ফিরে যাওয়া
(আগের অংশ)
পর দিন সকালে আমরা মৃতদেহটি পরীক্ষা করতে গিয়ে হতাশ হলাম, দেখলাম চিতাটা সেখানে ফিরে আসে নি। আমরা কিন্তু আশা করেছিলাম যে আগের দিন সে আমাদের দু’জনের একজনকেও ধরতে না পেরে তার ফেলে যাওয়া শিকারের কাছে ফিরে আসবে।
দিনের বেলায় ইবটসনকে তার দপ্তরের কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হল, আমি রাইফেলটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম যদি চিতাটাকে দেখতে পেয়ে গুলি করার সুযোগ পাই এই আশায়। পাইনের ফল ছড়ানো শক্ত জমিতে বাঘের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া অসম্ভব, সেজন্য আমি পাহাড়ের বাঁকটার দিকে যেতে চাইলাম; আমি জানতাম সেদিকে একটা ঘন জঙ্গল আছে। কিন্তু সেদিকে গিয়ে দেখি এত বড় বড় ঝোপঝাড় এবং পাথরের চাই সেখানে ছড়িয়ে আছে যে ভিতরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব, পাথরের উপর কোন মানুষের পা রেখে দাঁড়ানোও সম্ভব নয়। তবে দেখে আশ্চর্য হলাম জায়গাটা শিকারের পক্ষে উপযোগী কারণ, জমিতে কাকর, ঘুরাল ও শুওর চলার দাগ রয়েছে। কিন্তু কয়েকটি আঁচড়ের দাগ ছাড়া চিতার কোনো চিহ্ন দেখলাম না।
আমরা যখন দুপুরের খাবার খাচ্ছি, তখন রুদ্রপ্রয়াগ থেকে আগের দিন যে ‘জিন ট্র্যাপ’টি পাঠানো হয়েছিল সেটি এসে পৌঁছল। সন্ধ্যার আগেই আমরা ট্র্যাপটি একটা খোলা জায়গায় পেতে রেখে বেশ কিছু সায়ানাইড মরা গরুটির মাংসে মিশিয়ে দিলাম। ইবটসন বা আমার দু’জনেরই বিষ সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না। সরকার চাইছিল যে কোন উপায়েই হোক আমি যেন মানুষখেকোটাকে মেরে ফেলি। নৈনিতাল ছাড়ার আগে আমি এক ডাক্তার বন্ধুকে কথায় কথায় বলেছিলাম যে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিষে চিতার কোন ক্ষতি হয় না, স্বাভাবিক ভাবেই সে চলাফেরা চালিয়ে যায়। কি কি বিষ ব্যবহার করেছি সেটাও তাকে জানিয়েছিলাম; শুনে সে আমায় সায়ানাইড ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল, তার মতে বিড়াল গোত্রীয় জন্তুর পক্ষে সায়ানাইড খুবই কার্যকরী। আমি ইবটসনকে একথা জানানোর পরে, বেশ কিছু পরিমাণ সায়ানাইড বন্ধ মোড়কে পুরে আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সায়ানাইডই আমি মৃতদেহটির মাংসে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।
বাঘটির তার ফেলে যাওয়া শিকারের কাছে ফিরে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। আগের দিন গাছের উপর বসেছিলাম বলে এবার আর বসলাম না, ‘জিন ট্র্যাপ’ ও সায়ানাইডেই কাজ হবে ধরে নিলাম।
পরের দিন পায়ে চলা পথের কাছে একটা বড় পাইন গাছের উপরে আমরা একটা মাচান তৈরি করলাম, উপরে খড় বিছিয়ে দেওয়ায় কিছুটা গদির মত হল। ইবটসনের তৈরি করা রাতের খাবার খেয়ে মাচানের উপর উঠে পড়লাম। মাচানটা ছিল যথেষ্ট বড়, এর উপর আমরা আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে কথা বলতে বলতে সিগারেটও টানতে পারি। আমাদের সেখানে বসার উদ্দেশ্য ছিল, ফেলে যাওয়া মরাটির দিক থেকে কোনও শব্দ আসে কি না সেটা শোনা। আর বাঘটি যদি ফাঁদে গিয়ে পড়ে তবে সে গর্জন করতে থাকবে।
রাতের বেলা শুধু একটা কাকরের (পাহাড়ি হরিণ) ডাক ভেসে এল, আমরা যে দিক থেকে বাঘটা আসবে বলে ভেবেছিলাম ঠিক তার উলটো দিক থেকে।
ভোর হতে না হতেই এক কাপ চা খেয়ে মরাটির কাছে গিয়ে দেখি, সেটি যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে।
প্রাতরাশের পর ইবটসন রুদ্রপ্রয়াগ রওনা হয়ে গেল। আমি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে পনেরো দিনের যাত্রা পথে নৈনিতালের দিকে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এমন সময় একদল লোক এসে জানালো চার মাইল দূরে একটা গ্রামে চিতাবাঘ একটা গরু মেরেছে। আগের দিন রাতেই বাঘটা ইবটসন ও আমাকে সেই গাছটা থেকে বারান্দা পর্যন্ত অনুসরণ করে এসেছিল। পরে গ্রামের মোড়লের বাড়ির দরজা ভেঙে ফেলতেও সে চেষ্টা করেছে, কিছুই না পেরে বাড়ি থেকে তিন শ’ গজ দূরে গরুটিকে মেরেছে। গ্রামের লোকদের ধারণা এটা মানুষখেকোটারই কাজ। যারা এসেছিল তাদের কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে আমি নৈনিতাল যাওয়া স্থগিত করে দিলাম এবং ‘জিন ট্র্যাপ’ ও বিষ সঙ্গে নিয়ে তাদের সঙ্গে গ্রামের দিকে চললাম।
মোড়লের বাড়িটা ছিল চষা জমির মাঝখানে একটা টিলার উপর, একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা বাড়িটার দিকে চলে গেছে। এখানেই নরম জমির উপর আমি মানুষখেকোটির পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম।
মোড়ল আমাকে উপত্যকার মধ্য দিয়ে আসতে দেখেছিল। পৌঁছন মাত্র সে আমাকে দুধ এবং গুড় দিয়ে তৈরি এক কাপ গরম চা এগিয়ে দিল। ঘুরালের চামড়া দিয়ে তৈরি একটা আসনে বসে সেই অতিরিক্ত মিষ্টি দেওয়া চা খেতে খেতে আমি তার দরজায় বাঘের আক্রমণের কাহিনী শুনতে লাগলাম। সে জানালো যে বাড়ির ছাদ সারানোর জন্য অনেকগুলি চেরা তক্তা কেনা হয়েছিলে এবং সেগুলি দরজার গায়ে শক্ত করে আটকে রাখা ছিল, কাঠগুলি না থাকলে সে রাতে মানুষখেকোটি দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেই পড়ত।
মোড়লটি ছিল বৃদ্ধ ও বাতের অসুখে কাবু। সে তার ছেলেকে আমার সঙ্গে পাঠাল গরুটি যেখানে মারা পড়েছে সে জায়গাটা দেখিয়ে দিতে এবং নিজে আমার ও আমার লোকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করতে লেগে গেল।
আমি মৃত গরুটিকে দেখলাম, অল্প বয়স ও পরিপুষ্ট চেহারা। মাঠের মাঝে চলা পথের উপরেই গরুটি পড়ে ছিল; ‘জিন ট্র্যাপ’টি বসবার ঠিক উপযুক্ত জায়গা ছিল সেটা। এক ফুট উঁচু একটা আলের ঠিক পাশে গরুটি রয়েছে, বাঘটি মাংস খাবার সময় এই আলটির উপরেই বসেছিল, সামনের থাবা দু’টি ছিল গরুটির পায়ের মাঝখানে।
গরুটির পায়ের মাঝখানের জমি কিছুটা খুঁড়ে বাঘটি যেখানে তার থাবা দু’টি রেখেছিল সেখানে ট্র্যাপটি বসালাম এবং সবুজ পাতা দিয়ে জায়গাটা ঢেকে কিছুটা মাটি ছড়িয়ে শুকনো পাতা টুকরো ডাল ইত্যাদি ফেলে রাখলাম। একশ’ জন লোক এলেও বুঝতে পারবে না যে সেখানের জমি সরানো হয়েছে এবং একটা ফাঁদ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। মনের মত সব ব্যবস্থা হয়ে গেলে মোড়লের বাড়ি এবং গরুটির মাঝামাঝি জায়গায় একটা গাছের উপর উঠে পড়লাম।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, একজোড়া ফেজেন্ট (লম্বা লেজওয়ালা বড় পাখি) ও তাদের পাঁচটা ছানা হঠাৎ ডেকে উঠল। এদের আমি অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছিলাম। কয়েক মিনিট পরে একটা কাকর ডাকতে ডাকতে আমার গাছটার কাছে ছুটে এল এবং কিছুক্ষণ ডাকার পর ধীর পায়ে পাহাড়ের উপরে চলে গেল। এর পর আর উল্লেখযোগ্য কিছুই হল না এবং যখন অন্ধকার এতটাই নেমে এলো যে আমি আমার রাইফেলটাও ভাল দেখতে পাচ্ছিলাম না তখন গাছ থেকে নেমে রাবারের জুতো পরা অবস্থায় পা টিপে টিপে গ্রামের দিকে চললাম।
মোড়লের বাড়ির একশ’ গজ দূরের পায়ে চলা রাস্তাটা ত্রিশ গজ লম্বা ও কুড়ি গজ চওড়া একটা খোলা সমতল জায়গার উপর দিয়ে চলে গেছে। এ জায়গাটা থেকে ঠিক উপরে পাহাড়ের গায়ে প্রকাণ্ড এক খণ্ড পাথর ছিল। আমি যখন এই খোলা জায়গায় এসে পৌঁছলাম তখন আমার মনে হল কেউ একটা আমাকে অনুসরণ করছে। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে আমি পথ ছেড়ে দু’টো লম্বা পা ফেলে একটা স্পঞ্জের মত নরম জমির উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানে পাথরের আড়ালে শুয়ে পড়ে এক চোখ দিয়ে মরাটাকে দেখতে লাগলাম।
ভিজে মাটির উপর আমি প্রায় দশ মিনিট শুয়ে ছিলাম। দিনের আলো যখন একেবারে মিলিয়ে গেছে তখন আবার আগের পথটিতে ফিরে এসে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে হেঁটে মোড়লের বাড়ি পৌঁছলাম।
সে রাতে গভীর ঘুম ভাঙিয়ে মোড়ল আমাকে বলল যে সে দরজায় আঁচড় কাটার শব্দ শুনতে পেয়েছে। পরদিন ভোর বেলা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেলাম দরজার সামনে ধুলোর উপর মানুষখেকোটির পায়ের ছাপ পড়ে রয়েছে। পায়ের ছাপ ধরে ধরে আমি সেই খোলা জায়গাটায় ফিরে এসে দেখি আমি গত সন্ধ্যায় ঠিক যা যা করেছি চিতাটাও ঠিক সেটাই করেছে। সে পথ ছেড়ে পাথরটির কাছে গিয়েছে, ফিরে এসে আবার রাস্তা ধরে মোড়লের বাড়ি পর্যন্ত এসেছে এবং বাড়ির চার পাশে কয়েক পাক ঘুরেছে।
বাড়ি ছেড়ে চিতাটা আবার রাস্তায় এসে পড়েছে, আমি যখন তার পায়ের ছাপ ধরে মরাটার কাছে এগোচ্ছি তখন খুবই আশান্বিত ছিলাম, কিন্তু তখনও আমি বুঝিনি দীর্ঘ আট বছর মানুষের সংস্পর্শে এসে এবং তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে একটা বাঘ কতটা ধূর্ত হয়ে উঠতে পারে।
আমি পথটা ছেড়ে উঁচু জমিটার দিকে এগিয়ে দূর থেকেই দেখতে পেলাম মরা গরুটা অদৃশ্য হয়েছে এবং যেখানে ট্র্যাপটা বসিয়েছিলাম সেখানে দু’টো পায়ের ছাপ পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছুরই নড়চড় হয় নি।
প্রথম রাতে বাঘটি তার সামনের থাবা দু’টি গরুর পায়ের মাঝখানে রেখে মাংস খেয়েছিল, কিন্তু এবারে পা দু’টিকে দু’পাশে অনেকটা ছড়িয়ে দিয়ে সে মাংস খেয়েছে যাতে ট্র্যাপটা না ছুটে যায়, অতএব সে সম্পূর্ণ নিরাপদ অবস্থাতেই ছিল। খাওয়া হয়ে গেলে সে সম্পূর্ণ ঘুরে গরুটার মাথার দিকটা ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দিয়েছে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে সেটা একটা ওক গাছে আটকে ছিল। খুব সন্তুষ্টচিত্তে চিতাটা আবার সেই পথটায় ফিরে এসেছে। প্রায় মাইল খানেক অনুসরণ করে আমি শক্ত জমিতে এসে পড়লাম, এখানে আর বাঘের কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
চিতাটির তার শিকারের কাছে ফিরে আসবে সে আশা আর ছিল না। আগের রাতে আমি যেটা করিনি, এবার সেটা করলাম – মরা গরুটার মাংসে বেশ কিছুটা সায়ানাইড ঢুকিয়ে রাখলাম। অবশ্য এভাবে বিষ মিশিয়ে মারাকে আমি বরাবর ঘৃণার চোখেই দেখে এসেছি, এখনও আমার সে দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় নি।
পর দিন সকালে গিয়ে দেখি যেখানে আমি বিষ মিশিয়ে রেখেছিলাম সেখানকার পুরো মাংসটাই চিতাটা খেয়েছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, যে পশুটা মাংস খেয়েছে সেটা মানুষখেকো নয়, অন্য কোন চিতা এবং সেটা মারা পড়বে। গ্রামে ফিরে আমি পাটোয়ারীকে বললাম যে বাঘটা মারা যাওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না, তবে যে কেউ বাঘটিকে খুঁজে পেয়ে তার চামড়াটা ছাড়াতে পারবে, আমি তাকে একশ’ টাকা পুরস্কার দেব। মাস খানেক পরে একজন সেই পুরস্কারটা দাবী করেছিল।
আমি জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে খুব বেশি সময় নিই নি এবং দুপুরের একটু পরেই দীর্ঘ যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে নৈনিতালের দিকে রওনা হলাম। চাটোয়াপিপল সেতুর কাছে একটা সরু রাস্তা ধরে চলার সময় একটা বড় আকৃতির ঢোঁড়া সাপ ধীরে ধীরে রাস্তাটি অতিক্রম করে চলে গেল। আমি যখন সেটা তাকিয়ে দেখছিলাম তখন আমার পেছন থেকে মাধো সিং বলে উঠল –“যে দুরাত্মার জন্য আপনি ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা ওই চলে গেল।”
সবাইকে মানুষখেকোটির মর্জির উপর সঁপে দিয়ে এভাবে আমার গাড়োয়াল ছেড়ে চলে যাওয়াটাকে আপনাদের হয় ত নিষ্ঠুর কাজ বলে মনে হবে; আমারও যে একথাটা মনে হয় নি তা নয়। সংবাদপত্রেও আমার এই কাজের সমালোচনা হয়েছে, সংবাদপত্রে বাঘটি সম্বন্ধে রোজই কিছু না কিছু খবর বেরত। এ ব্যাপারে আমি সবাইকে ভেবে দেখতে বলব যে, অতিরিক্ত চাপ অনির্দিষ্ট কালের জন্য সহ্য করা যায় না। গাড়োয়ালে আমি রাতের পর রাত জেগে থেকে পাহারা দিয়েছি, পরের দিনই মাইলের পর মাইল হেঁটে যেখানেই বাঘটির খবর পেয়েছি সেখানে ছুটে গিয়েছি। চাঁদের আলোয় বহু রাত আমাকে এক ভাবে বসে থেকে শারীরিক অসুবিধা সহ্য করতে হয়েছে, অনেক সময় এমন হয়েছে যে আমি আর চোখ খুলে রাখতে পারছি না, অথচ বাঘটা কাছে পিঠেই রয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি একা যে রাস্তায় হেঁটেছি, আমি জানি সেখানে আমি ও মানুষখেকোটি ছাড়া আর কেউ নেই; আমি যতই প্রতিপক্ষকে বাগে আনার চেষ্টা করেছি, প্রতিবারই সে অদ্ভুত ভাবে রক্ষা পেয়ে গেছে। বহু রাত আমার মনে হয়েছে যে বাঘটি আমার অনুসরণ করছে এবং পরে মিলিয়ে দেখেছি ঠিক সেটাই হয়েছে। চাঁদের আলো যতই থাক না কেন, আমি যখন জানি একটা বাঘ আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে তখন এ ভাবে দীর্ঘদিন চলাফেরা করা স্নায়ুকে অকেজো করে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট।
শরীর ও মনে এভাবে ক্লান্তি নিয়ে গাড়োয়ালে থেকে গেলে সেখানকার লোকদেরও কোন লাভ হত না, আমারও জীবন বিপন্ন হত। এটা জানা ছিল যে সাময়িকভাবে হলেও চলে আসার জন্য আমি সংবাদপত্রে সমালোচিত হব, কিন্তু আমি জানি যে আমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি। আসার সময় আমি গাড়োয়ালবাসীকে আশ্বস্ত করে এসেছি যে যত তাড়াতাড়ি পারি আমি ফিরে এসে তাদের পাশে দাঁড়াব।
১৫। রুদ্রপ্রয়াগে প্রত্যাবর্তন
ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে ১৯২৫ সালের শরতের শেষে আমি রুদ্রপ্রয়াগে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। ১৯২৬-এর বসন্তের শেষে উজ্জীবিত হয়ে ফিরে এসে আমি আবার কাজে লেগে পড়লাম।
এবার মানুষখেকোটির খোঁজে গাড়োয়ালে ফেরার সময় আমি ট্রেনে চেপে কোটদোয়ারা গিয়ে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পাউরি গেলাম, এতে আমার আট দিনের পরিশ্রম বেঁচে গেল। পাউরিতে ইবটসন এসে আমার সঙ্গে যোগ দিল এবং আমরা একসঙ্গে রুদ্রপ্রয়াগের পথে যাত্রা করলাম।
যে তিন মাস আমি রুদ্রপ্রয়াগে ছিলাম না, সে সময়ে মানুষখেকোটা দশ জন লোক মেরেছে এবং সেখানকার লোকেরা ভয়ে এতটাই সিঁটিয়ে ছিল যে চিতাটিকে মারার কোনও চেষ্টাই তারা করে নি।
শেষ যে মৃত্যুটি ঘটেছিল সেটির শিকার ছিল একটা ছোট ছেলে, আমাদের এসে পৌঁছবার দু’দিন আগে অলকানন্দার বা দিকে ছেলেটা মারা পড়েছিল। পাউরিতে বসে এই খবরটা টেলিগ্রাফে পেয়েছিলাম। আমরা খুব তাড়াতাড়িই ফেরার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু দু’দিন পরে ফিরে এসে পাটোয়ারীর কাছে শুনি চিতাটা ছেলেটিকে পুরোটাই খেয়ে ফেলেছে, কোন অংশই বাকি নেই।
রুদ্রপ্রয়াগ থেকে চার মাইল দূরে ছেলেটা মারা পড়েছিল। পেট ভরে খাবার পর বাঘটা যে নদী পেরিয়ে ওপারে যাবে তার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম, আমরা সেজন্য দু’টি ঝোলাপুলই বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা করলাম।
শীতকালে ইবটসন একটা সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থা তৈরি করেছিল, এদের কাজ ছিল কুকুর ছাগল গরু বা মানুষ যাই মারা পড়ুক না কেন সে খবরটা আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাতে মানুষখেকোটার গতিবিধি পুরোটাই আমাদের নজরে থাকে। এতে অবশ্য বহু গুজব আসা শুরু হল এবং খবরের সত্যতা যাচাই করতে আমাদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হত। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ মানুষখেকোটা যে অঞ্চলে শিকার ধরে বেড়াচ্ছে, সেখানে প্রত্যেকে তার নিজের ছায়াকেও সন্দেহ করত এবং সামান্য শব্দ শুনলেই মনে করত মানুষখেকোটা আসছে।
এরকমই একটা গুজব অলকানন্দার ডান পারে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে সত্তর মাইল দূরে কুণ্ডা গ্রামের গাল্টুকে নিয়ে ছড়িয়েছিল। গাল্টু নিজের গ্রাম থেকে এক মাইল দূরে একটা রাত তার গরু-মোষ থাকার আস্তানায় কাটাবে বলে গিয়েছিল। তার ছেলে পরদিন সেখানে গিয়ে দেখে বাবার চাদরের অর্ধেকটা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে রয়েছে এবং তার মনে হয়েছে সে রাস্তায় কিছু একটা টেনে নিয়ে যাবার দাগের সঙ্গে বাঘের পায়ের ছাপও সে দেখতে পেয়েছে। খবর পেয়ে ষাট জন লোক গাল্টুর মৃতদেহটি খুঁজতে বেরিয়ে গেল এবং চারজন লোক গেল খবরটা আমাদের পৌঁছে দিতে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে বাঘটা মোটেই নদী পেরোয় নি কাজেই গাল্টুর খবরটা সত্যি হতে পারে না। ইবটসন পাটোয়ারিকে আদেশ দিল চারজন লোক লাগিয়ে গাল্টুর সঠিক খবরটা যোগাড় করতে সে যেন ব্যক্তিগত ভাবে চেষ্টা করে।
বহু খোঁজ করেও গাল্টুর দেহ পাওয়া গেল না, তবে ঠিক হল চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে। ইতিমধ্যে পাটোয়ারির কাছে গাল্টুর ছেলে বাঘের পায়ের যে ছাপ দেখেছিল তার ছবি এসে পৌঁছোল; একটা বড় থালার মত গোল বৃত্ত এবং তার চারপাশে চায়ের কাপের মত আর পাঁচটি ছোট ছোট বৃত্ত, মনে হল সেগুলি সবই কম্পাস দিয়ে আঁকা হয়েছে।
পাঁচ দিন পর আমি ও ইবটসন যখন সেতুর প্রবেশ পথের পিলারের উপর ওঠার জন্য রওনা হচ্ছি তখন একদল লোক বাংলোয় এসে উপস্থিত হল, সবার সামনে রয়েছে যে লোকটি সে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলল যে সে এমন কিছু করেনি যার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে রুদ্রপ্রয়াগে নিয়ে আসা হবে। এই লোকটিই হল সেই গাল্টু। আমরা তাকে শান্ত করলাম , তখন সেদিন কি হয়েছিল সেটা সে শোনাতে বসল। তার বক্তব্য – সেদিন গ্রাম ছেড়ে বেরোবার সময় তার ছেলে এসে বলল যে একজোড়া ষাঁড় সে একশ টাকা দিয়ে কিনেছে যেটা গাল্টুর মতে সত্তর টাকার বেশি হবে না। এভাবে টাকা অপচয় হওয়ায় রাগে গাল্টুর মাথা গরম হয়ে যায় এবং সে রাতটা সে তার গরু-মোষের আস্তানায় কাটিয়ে পরদিন দশ মাইল দূরের এক গ্রামে যেখানে তার এক বিবাহিত মেয়ে থাকত সেখানে চলে যায়। পরের দিন গ্রামে ফিরতে পাটোয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করে, সে এখন জানতে চায়, সে কি করেছে যাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। একথা শুনে উপস্থিত সকলেই প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়ল। অর্থাৎ পাটোয়ারির সঙ্গে দু’শ জন লোক যখন পাঁচ দিন ধরে হন্যে হয়ে গাল্টুর মৃতদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছে, গাল্টু তখন দশ মাইল দূরে মেয়ের বাড়িতে তার মেজাজ ঠাণ্ডা করছে।
ইবটসন রুদ্রপ্রয়াগের ঝোলাপুলের ফটক সংলগ্ন পিলারের মসৃণ উপরিভাগে সারারাত শুয়ে থাকতে মোটেই রাজি ছিল না। মিস্ত্রি ছিল, কাঠেরও অভাব নেই, অতএব শোয়ার উপযোগী একটা খাঁচা পিলারের পাশে খিলানের উপর তৈরি করে নেওয়া হল। যে পাঁচদিন ইবটসনের পক্ষে রুদ্রপ্রয়াগে কাটান সম্ভব ছিল, সে পাঁচটা রাত এখানে শুয়েই কাটানো হয়েছিল।
ইবটসন চলে যাওয়ার পর বাঘটা একটা কুকুর, চারটা ছাগল এবং দু’টো গরু মেরেছিল। কুকুর ও ছাগলগুলো যে রাতে মারা পড়েছিল, সে রাতেই বাঘটা সেগুলো পুরোটাই খেয়েছে। গরু দুটোর মৃতদেহের প্রতিটির কাছে আমি দু’রাত ধরে বসে অপেক্ষা করেছি। প্রথম গরুটার কাছে দ্বিতীয় রাতে চিতাটা এসেছিল। রাইফেলটা তুলে টর্চটা জ্বালিয়ে গুলি করার জন্য যখন আমি প্রস্তুত হচ্ছি ঠিক সেই সময় কাছের একটা বাড়িতে এক জন মহিলা দরজা খুলে বেরনোর আগে দরজায় ধাক্কা দিল। এই শব্দ শুনেই চিতাটা পালিয়ে যায়।
ইতিমধ্যে আর কোন মানুষ মারা পড়ে নি, তবে এক মহিলা ও তার বাচ্চা বাঘের আক্রমণে সাংঘাতিক রকম জখম হয়েছে। যে ঘরে বাচ্চাটিকে পাশে নিয়ে মেয়েটি শুয়েছিল সেটির দরজা বাঘটি জোর করেই খুলে ফেলে এবং মেয়েটির একটা হাত কামড়ে ধরে দরজার কাছে টেনে নিয়ে যায়। মেয়েটি ছিল খুবই সাহসী এবং বিপদেও তার বুদ্ধি লোপ পায় নি। মেয়েটিকে বের করার জন্য বাঘটি যেই বাইরে বেড়িয়েছে, তখনই সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দেয়। মেয়েটির একটা হাত প্রায় ছিঁড়েই গিয়েছিল এবং বুকে চারটি গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। শিশুটির মাথাতেও চোট লাগে। খবর পেয়ে আমি এই ঘরটার কাছে দু’টি রাত জেগেছিলাম কিন্তু বাঘটা ফিরে আসে নি।
মার্চের শেষ দিকে কেদারনাথের রাস্তার ধারে একটা গ্রাম পরিদর্শন করে ফিরছিলাম। রাস্তাটা একেবারে মন্দাকিনীর ধার ঘেঁষে গিয়েছে। এখানে একটা ঝর্ণার জল দশ বারো ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ছে, এখানেই আমি কয়েকজন লোককে একটা লম্বা বাঁশের লাঠির প্রান্তে তিন কোণা মাছ ধরার জাল লাগিয়ে পাথরের উপর বসে থাকতে দেখলাম। জলের যা গর্জন হচ্ছিল তাতে কথা বলা নিরর্থক মনে করে নদীর পাড়ে একটা পাথরের উপর বিশ্রাম ও ধূমপানের জন্য বসে লোকগুলোর কাণ্ড কারখানা দেখতে লাগলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকগুলি চার চারটা মাছ ধরে ফেলল, প্রতিটির ওজনই প্রায় দশ বারো পাউন্ড হবে। আমি আগের বার যখন রুদ্রপ্রয়াগে এসেছিলাম তখন বাংলোর চৌকিদার আমাকে বলেছিল যে বসন্তকালে, অলকানন্দা ও মন্দাকিনীতে বরফগলা জল নেমে আসার আগে, মাছ ধরার যথেষ্ট সুযোগ আছে। তার কথা শুনে এবার আমি আসার সময় চোদ্দ ফুট লম্বা ছিপ, আড়াইশ’ ফুট সুতো ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে এসেছিলাম। পর দিন সব কিছু সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরার কাজে লেগে গেলাম, তবে আগের দিন যেন অনেক বেশি মাছ দেখা গিয়েছিল বলে মনে হল। যাই হোক বহুক্ষণের চেষ্টায় ত্রিশ পাউন্ড ওজনের একটা প্রকাণ্ড মাছ ধরা পড়ল। যারা আমার মাছ ধরা দেখতে ভিড় জমিয়েছিল, তাদের বললাম যে তারা যদি আমার লোকদের জন্য একটা বড় মাছ ধরে দিতে পারে তবে আমি তাদের এই ত্রিশ পাউন্ড ওজনের মাছটা দিয়ে দিতে পারি। এতে তারা সানন্দে রাজি হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে দুটো মাছ ধরে আমাকে দিল। একজন লোক ছিপ ও মাছটা হাতে নিয়ে আমার পিছনে আসার অনুমতি চাইল। আমার রাজি না হবার কোন কারণ ছিল না। সে বলল –“সাহেব, আমার হাতে এই ছিপ ও মাছটা দেখলে গ্রামের ও বাজারের প্রতিটি লোক জানবে যে ছিপ দিয়ে মাছটা আমিই ধরেছি। এরকম বড় আকৃতির মাছ এখানে কেউ কখনও দেখে নি।”
(চলবে)
লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (
IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে
অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা
করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার
সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।