সাহিত্য

মার্চ ১৫, ২০১৬
রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)
দীপক সেনগুপ্ত
৫। তদন্ত
(আগের অংশ) যে দশ সপ্তাহ আমি রুদ্রপ্রয়াগে ছিলাম তার দৈনন্দিন কাজের বিবরণ লিখতে চেষ্টা করব না, সেসব আপনাদের একঘেয়ে লাগবে, তাছাড়া সে সব খুঁটিনাটি এতদিন পরে আমার মনেও নেই। আমি বরং যে সময়ে একা অথবা ইবটসনের সঙ্গে কাটিয়েছি সে সময়ের কিছু অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের তুলে ধরি। কিন্তু তারও আগে যে অঞ্চলে চিতা বাঘটি আট বছর ধরে দৌরাত্ম্য চালিয়েছে এবং আমি দশ সপ্তাহ ধরে যেখানে তাকে তাড়া করে বেরিয়েছি তার প্রাকৃতিক দিকটা একটু বর্ণনা করি।
আপনি যদি রুদ্রপ্রয়াগের পূর্বদিকের পাহাড়ে উঠতে পারেন তবে বিস্তীর্ণ যে পাঁচশ’ বর্গ মাইল অঞ্চলে রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকোটি ত্রাস সৃষ্টি করেছে তার অধিকাংশই আপনার চোখে পড়বে। অঞ্চলটিকে অলকানন্দা নদী প্রায় সমান দু’ভাগে ভাগ করেছে। অলকানন্দা কর্ণপ্রয়াগ ছাড়িয়ে দক্ষিণে বয়ে গিয়ে রুদ্রপ্রয়াগে উত্তর-পশ্চিম থেকে নেমে আসা মন্দাকিনীর সঙ্গে মিশেছে। এই দুই নদীর মাঝখানের ত্রিভুজাকৃতি স্থানটি অলকানন্দার বাঁ দিকের অঞ্চলের মত অতটা চড়াই নয় এবং এ কারণেই প্রথম অঞ্চলটিতে গ্রামের সংখ্যা অনেক বেশি।
পাহাড়ের উপর থেকে দূরের চষা জমিগুলি পাহাড়ের গায়ে কতগুলি রেখার মত মনে হয়। এই জমিগুলি এক গজ থেকে পঞ্চাশ গজ বা তারও বেশি চওড়া। গ্রামের সব বাড়ি চষা জমির উপরের দিকে তৈরি কারণ তাহলে চরে বেড়ানো প্রাণী বা অন্য বন্য জন্তুর হাত থেকে ফসল বাঁচানো যাবে। বিশেষ কারণ ছাড়া এসব জমি কখনই কাঁটা ঝোপ দিয়ে ঘেরা হয় না। উপর থেকে ধূসর বা সবুজ রঙের ছোপের মত যেগুলি দেখা যায় সেগুলি ঘাস জমি বা জঙ্গল। এখানকার কিছু গ্রাম আপনি দেখবেন জমি দিয়ে ঘেরা আবার কতকগুলির চারপাশে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। এ অঞ্চলের সবটাই পাথুরে, অমসৃণ ও অসংখ্য খাদে ভর্তি। এখানে রাস্তা দুটি – একটি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে শুরু হয়ে কেদারনাথ অবধি গিয়েছে এবং মূল যাত্রীপথটি চলে গেছে বদরিনাথের দিকে। আমি যখনকার কাহিনী লিখছি, তখন দুটি রাস্তাই ছিল সরু ও এবড়ো খেবড়ো এবং কখনো কোনো গাড়ির চাকা এসব রাস্তা স্পর্শ করে নি।
যে সব গ্রাম জমি দিয়ে ঘেরা তার চেয়ে জঙ্গলে ঘেরা গ্রামেই যে বেশি মানুষ মারা পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। সাধারণ বাঘের ক্ষেত্রে এটাই প্রযোজ্য হত, কিন্তু মানুষখেকো যেহেতু শুধু রাত্রি বেলাই শিকার করে তার কাছে ফাঁকা বা জঙ্গলে ঢাকা জমিতে কোন তফাৎ নেই। অতএব একটা গ্রামে যে অন্য গ্রামের চেয়ে বেশি মানুষ মারা পড়েছে সেটা নিছক সতর্কতার অভাবেই।
আমি আগেই বলেছি যে মানুষখেকোটি একটি যৌবন অতিক্রান্ত বড় আকৃতির পুরুষ চিতা। বৃদ্ধ হলেও তার গায়ের জোর ছিল অসাধারণ। মাংসাশী প্রাণী তার শিকার কতদূর বয়ে নিয়ে গিয়ে নিরিবিলিতে খাবে সেটা নির্ভর করছে সে কোথায় শিকারটি করেছে তার উপর। রুদ্রপ্রয়াগের চিতাটির কাছে অবশ্য সব জায়গাই সমান। আমি একটি ঘটনা জানি যেখানে বাঘটি চার মাইল তার শিকার বয়ে নিয়ে গিয়েছিল। একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষকে তার বাড়ির ভিতরেই মেরে বাঘটি পাহাড়ের উঁচু চড়াই বেয়ে দু’মাইল রাস্তা উঠেছে, পরে সে পাহাড় পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢাল বেয়ে দু’মাইল রাস্তা নেমে গেছে। এর কোনও উদ্দেশ্য আমি খুঁজে পাই নি, কারণ বাঘটি মানুষটিকে মেরেছে প্রথম রাতেই এবং পরদিন দুপুরের আগে কেউ তার পিছু নেয় নি।
মানুষখেকো না হলে চিতাবাঘ শিকার করা খুব সহজ, কারণ চিতার কোনো ঘ্রাণ শক্তি নেই।
চিতাবাঘ শিকারের জন্য বহুবিধ যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, অন্য কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে সম্ভবত ততটা হয় না। কি ভাবে সেটিকে মারা হবে সেটা নির্ভর করছে প্রকৃত শিকারির মনোভাব নিয়ে, না কি নিছক অর্থ উপার্জনের জন্য বাঘটিকে মারা হচ্ছে তার উপর। শিকারি হ’লে বাঘটিকে সন্তর্পণে খুঁজে বার করে ওৎ পেতে বসে গুলি করে তাকে মারবে। অর্থের লোভে হ’লে যে নিষ্ঠুর ও সহজ রাস্তা অবলম্বন করা হয় সেটি হল তার শিকার করা পশুর মাংসে শক্তিশালী বিস্ফোরক গুঁজে রাখা। এসেব ক্ষেত্রে বাঘ মাংস খেতে গেলে দাঁতের চাপ লেগে বিস্ফোরকটি ফেটে চোয়াল শুদ্ধ উড়ে গেলে মৃত্যু হয় মুহূর্তের মধ্যে। কোন কোন ক্ষেত্রে বাঘটি ভীষণ রকম আহত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রণা পেয়ে মারা যায়। এসব ক্ষেত্রে রক্তের দাগ ধরে কেউ যে বাঘের পিছু নিয়ে তাকে মেরে ফেলবে সেরকম সাহসী ব্যক্তির খুব অভাব।
চিতাবাঘের পিছু নিয়ে, তাকে অনুসরণ করে তার জন্য ওৎ পেতে বসে থেকে গুলি করার মধ্যে উত্তেজনার খোরাক আছে ঠিকই কিন্তু কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কারণ, চিতাবাঘ সাধারণতঃ পায়ে চলা পথ ধরেই হাঁটে এবং জঙ্গলের প্রতিটি পাখী এবং অন্যান্য প্রাণী তার উপস্থিতি জানান দেয়, এছাড়া তার শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হলেও ঘ্রাণশক্তির অভাব। শিকারি সেজন্য তার সুবিধা মত দিক থেকে বাঘটির দিকে এগোতে পারে-বাতাস কোন দিকে বইছে সেটা জানার প্রয়োজন নেই।
বাঘের পিছু নিয়ে তাকে খুঁজে বের করে তার দিকে তাক করে বন্দুকের ট্রিগার টেপার চেয়ে তাকে অনুসরণ করে ক্যামেরার বোতাম টেপার আনন্দ অনেক বেশি। একটি ক্ষেত্রে জঙ্গলের সব চেয়ে সুন্দর ও লালিত্যপূর্ণ জন্তুটিকে প্রাণভরে দেখে তার ছবি ক্যামেরায় ধরে রাখলে, সেটা চিরকালীন বস্তু হয়ে যায়। অপর পক্ষে বন্দুকের ঘোড়া টিপলে এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট না হলে, যে প্রাণীটি মারা পড়ে স্মারক হিসাবে তার স্মৃতি ধরে রাখলেও সে সৌন্দর্য ও আনন্দ কিন্তু উপভোগ করা যায় না।
৬। প্রথম শিকার
আমার রুদ্রপ্রয়াগে এসে পৌঁছনোর কিছু আগে ইবটসন একটা ‘বিটে’র ব্যবস্থা করেছিল; সেটা যদি সফল হত তাহলে পরবর্তী সময়ে পনের জন মানুষকে মরতে হত না। (অনেক লোক একত্র হয়ে ঢাক ঘন্টা ইত্যাদি বাজিয়ে শব্দ করতে করতে বাঘকে শিকারির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার নাম ‘বিট’)। এখানে ‘বিট’টি যে পরিস্থিতিতে আয়োজিত হয়েছিল সেটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
কুড়ি জন তীর্থযাত্রী বদরিনাথে যাবার পথে একদিন সন্ধ্যাবেলা রাস্তার ধারে একটা দোকানে এসে পৌঁছোল। কেনাকাটা হয়ে গেলে দোকানদার যাত্রীদের দিনের আলো থাকতে থাকতে আরও চার মাইল এগিয়ে যেতে বলল, কারণ সেখানে তারা খাবার ও রাতের জন্য নিরাপদ আশ্রয় পাবে। কিন্তু যাত্রীরা রাজি হল না। তারা বলল, দীর্ঘপথ হেঁটে আসায় তারা সকলেই খুব ক্লান্ত, আরও চার মাইল হাঁটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় বরং দোকানদার যদি রাতের খাবার তৈরি করার ব্যবস্থা করে দেয় এবং দোকান সংলগ্ন চাতালে তাদের শোবার অনুমতি দেয় তাহলেই যথেষ্ট। এই প্রস্তাবে দোকানদার তীব্র আপত্তি জানালো। তার বক্তব্য, বাঘটি এখানে প্রায়ই আসে এবং এখানে খোলা জায়গায় রাত কাটান মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা।
তর্ক বিতর্ক যখন তীব্র হয়ে উঠেছে তখন মথুরা থেকে বদরিনাথ যাবার পথে একজন সাধু সেখানে এসে উপস্থিত হল এবং যাত্রীদের মত সমর্থন করে কথা বলতে শুরু করল। সে বলল, দোকানদার যদি তার ঘরে মহিলাদের আশ্রয় দেয় তবে সে নিজে পুরুষদের সঙ্গে চাতালেই শোবে এবং রাত্রিবেলা যদি কোন চিতাবাঘ – তা সে মানুষখেকো হোক বা না ই হোক – তাদের ধরতে আসে তবে বাঘটিকে মুখে নিয়ে সে দু’টুকরো করে ফেলবে।
একথা শুনে দোকানী বাধ্য হয়ে রাজি হল, কাজেই দশ জন মহিলা যখন রাত্রিবেলা এক-কামরা ঘরে দরজা বন্ধ করে শুতে গেল তখন বাকি দশ জন লোক এবং সাধুটি বাইরে চাতালে শুয়ে পড়ল। সাধুটির শোয়ার ব্যবস্থা হল ঠিক মাঝখানে।
পর দিন সকাল বেলা যখন তীর্থ যাত্রীদের ঘুম ভাঙল, তারা দেখল সাধুটি নেই। যে কাপড়টি পেতে সে শুয়েছিল সেটি এলোমেলো হয়ে আছে, তার গায়ের চাদরটির কিছু অংশ চাতালের বাইরে বেরিয়ে রয়েছে এবং তাতে চাপ চাপ রক্তের দাগ। যাত্রীদের উত্তেজিত স্বর শুনে দোকানদার বাইরে বেরিয়ে এল এবং এক নজরেই বুঝতে পারল কি ঘটেছে। সূর্য উঠলে যাত্রীদের নিয়ে রক্তের দাগ অনুসরণ করে পাহাড় বেয়ে নেমে একটি পাঁচিলের ধারে তারা সাধুটিকে দেখতে পেল; তার নীচের অংশ বাঘটি খেয়ে ফেলেছে।
ইবটসন সে সময়ে বাঘটির খোঁজে রুদ্রপ্রয়াগেই ছিলেন। তিনি মানুষ মারা যাবার কোন খবর পান নি। এই অবস্থায় অলকানন্দার কিছুটা দূরে একখন্ড জমি থেকে তিনি ‘বিট’ শুরু করতে মনস্থ করলেন। স্থানীয় লোকদের ধারণা ঐ জমিটিতে বাঘটি দিনের বেলায় বিশ্রাম নেয়। কুড়ি জন তীর্থযাত্রী যখন কথাবার্তা বলছিল তখন গ্রামের পাটোয়ারী আশে পাশের গ্রামগুলির সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছিল যে তারা যেন তৈরি থাকে কারণ, পর দিন সকালেই ‘বিট’ শুরু হবে।
পর দিন সকালে তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে ইবটসন তার স্ত্রী ও এক বন্ধুকে নিয়ে (বন্ধুটির নাম এখন আমার মনে নেই) দু’শ জনের একটি দল সহ অলকানন্দার ঝোলা পুল পেরিয়ে দু’এক মাইল দূরে পাহাড়ের উপর ‘বিট’ শুরু করার জায়গায় এসে দাঁড়ালেন।
‘বিট’ যখন চলছে সেই সময়ে মানুষখেকোটি সাধুকে যে মেরেছে সেই খবর এসে পৌঁছল।
‘বিট’টি ব্যর্থই হয়েছিল; জরুরী আলোচনার শেষে ঠিক হল দু’শ জন ‘বিটের’ লোক চার মাইল দূরে অন্য একটি ঝোলাপুল পেরিয়ে বা দিক ধরে যেখানে বাঘটি সাধুটিকে মেরেছিল সেখানে যাবে। ইতিমধ্যে সম্ভব হলে আরও লোক জনের ব্যবস্থা করা হবে।
সন্ধ্যার দিকে কয়েকটি অতিরিক্ত বন্দুক নিয়ে প্রায় ছ’হাজার লোক জড় হল এবং দোকানের অদূরে পাহাড়টির উপর থেকে নীচ অবধি ‘বিট’ চালানো হল। ইবটসনকে যারা চেনেন এবং জানেন তারা বুঝতে পারবেন যে কি সুশৃঙ্খল ও সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে ‘বিট’ পরিচালিত হয়েছিল।
‘বিট’টি যে ফলপ্রসূ হয় নি তার কারণ চিতাটি সে সময়ে সে তল্লাটেই ছিল না।
যখন কোন বাঘ বা চিতা খোলা জায়গায় তার শিকার করা মৃতদেহ ফেলে যায়, তখন বুঝতে হবে শিকারটির উপরে তার আর কোন আগ্রহ নেই। খাবার পরে বাঘ দু’তিন মাইল দূরে চলে যায়, মানুষখেকো হলে দশ মাইল বা আরও দূরে চলে যেতে পারে। অতএব এটা খুবই সম্ভব যে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে যখন ‘বিট’ চালানো হচ্ছে, মানুষখেকোটি তখন দশ মাইল দূরে আরামে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
৭। চিতার খোঁজে
চিতাবাঘ সাধারণত মানুষখেকো হয় না এবং সেজন্য তাদের সম্বন্ধে খুব কম তথ্যই জানা আছে। এদের সম্বন্ধে আমার নিজের অভিজ্ঞতা খুবই কম। বহু বছর আগে এক চিতাবাঘ মারতে গিয়ে আমি ধরে নিয়েছিলাম যে সাধারণ বাঘ যখন মানুষখেকো হয় তখন তার যা পরিবর্তন ঘটে চিতাবাঘের ক্ষেত্রেও সেরকমই হয়। এটা ধরে নিয়েই আমি মানুষখেকোটি মারতে চেষ্টা করেছিলাম।
চিতাবাঘ মারার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় সেটি হল তার শিকার করা কোন মৃতদেহের কাছে অপেক্ষা করা অথবা টোপ হিসাবে কোন ছাগল বা ভেড়া বেঁধে রেখে বাঘটির অপেক্ষায় বসে থাকা। একটি ক্ষেত্রে বাঘটি যেখানে কোন প্রাণী মেরেছে সে স্থানটি চিহ্নিত করতে হবে আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রথমে তার আস্তানা খুঁজে বার করতে হবে।
আমার রুদ্রপ্রয়াগে আসার উদ্দেশ্য ছিল চিতাটি যাতে আর মানুষ মারতে না পারে সেটি দেখা; অতএব পরের মানুষটি মারা যাবে এবং তার মৃতদেহের কাছে আমি বাঘটির জন্য অপেক্ষা করব এতে আমি রাজি ছিলাম না। কাজেই আমি জীবন্ত কোন পশু বেঁধে রেখে বাঘটির জন্য বসে থেকে সেটিকে মারার চেষ্টা করব সেটাই ঠিক করলাম।
এখানেই একটা অসুবিধা দেখা দিল। আমার কাছে যে তথ্য ছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে বাঘটি পাঁচশ’ বর্গমাইল অঞ্চল তার শিকারের স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছে। গাড়োয়ালের মত কঠিন পাহাড়ী এত বিস্তীর্ণ কোন অঞ্চলে শুধুমাত্র রাতের বেলাই শিকার করে এরকম একটা প্রাণীকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হল। শেষে আমি অলকানন্দা নদীটিকে লক্ষ্য করলাম যেটি এ অঞ্চলকে মোটামুটি সমান দু’ভাগে ভাগ করেছে।
স্থানীয় লোকের ধারণা ছিল অলকানন্দা বাঘটির কাছে কোন বাধাই নয়; নদীর একপাশে শিকার না পেলে অনায়াসে সে সাঁতরে নদী পার হয়ে অন্যদিকে চলে আসতে পারে। আমি কিন্তু এই ধারণা সমর্থন করতে পারলাম না। আমার মতে একটা চিতাবাঘ কোন অবস্থাতেই খরস্রোতা নদীর বরফ-গলা ঠান্ডা জলে সাঁতার কেটে এক পার থেকে অন্য পারে যেতে চাইবে না। আমার স্থির বিশ্বাস ছিল বাঘটি ঝোলা পুল দিয়েই এক দিক থেকে অন্য দিকে যাতায়াত করে।
ঐ অঞ্চলে দু’টি ঝোলা পুল ছিল; একটি রুদ্রপ্রয়াগে, অপরটি নদীর বার মাইল উপর দিকে চাটোয়াপিপল নামক স্থানে। এ দু’টি পুলের মাঝখানে একটি দোলনা সেতু ছিল – যেটি দিয়ে ‘বিটে’র সময়ে ইবটসন, তার সঙ্গীরা এবং আরও দু’শ লোক নদীটি পেরিয়েছিল। এই সেতু দিয়ে সম্ভবতঃ ইঁদুর ছাড়া আর কোন প্রাণী পেরোতে চাইবে না। এ রকম ভয়াবহ কাঠামোর সেতু আমি জীবনে দেখি নি। হাতে পাকানো এক জোড়া ঘাসের দড়ি দিয়ে দু’শ ফুট লম্বা সেতুটি ঝোলান রয়েছে; দড়িগুলিতে সময়ের সঙ্গে কাল রঙ ধরেছে এবং নদী থেকে উঠে আসা জলীয় বাস্পে সেগুলি পিছল হয়ে রয়েছে। সেতুর নীচের শুভ্র ফেনিল জল একশ’ গজ দূরে দু’টো পাথরের দেয়ালে লেগে গুরু গর্জন করে ছুটে চলেছে। এখানেই একটা কাকর (পাহাড়ী হরিণ) কতকগুলি বুনো কুকুরের তাড়া খেয়ে অলকানন্দার জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দুই দড়ির মাঝখানে পা ফেলার জায়গায় দেড়-দু’ ইঞ্চি ব্যাসের কাঠের টুকরো ছ’ফুট ব্যবধানে ঘাসের দড়ি দিয়ে আলগা করে বাঁধা রয়েছে। আরো যা হয়েছে সেটা হল, একটি দড়ি একটু বেশি ঝুলে যাওয়ায় পা ফেলার কাঠের টুকরোগুলো পয়তাল্লিশ ডিগ্রি বেঁকে গিয়েছে।
টোল সংগ্রাহক লোকটি এক পয়সা নিয়ে আমাকে সেতুটি পেরোবার অনুমতি দিল। আমি বোকার মত তাকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম যে সেতুটি কখনো পরীক্ষা করা বা মেরামত করা হয় কি না। উত্তরে সে জানালো, না সেটা হয় না, তবে একবার এক জন দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যাওয়ায় নতুন দড়ি লাগান হয়েছে। শুনে আমার মেরুদণ্ডে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সেতুটি পেরিয়ে ওপারে যাবার পরেও বহু দিন আমার সে অনুভূতিটি ছিল।
এই দোলনা সেতুটি পেরোনো মানুষখেকোটির সাধ্যাতীত, তা হলে রইল আর দু’টি ঝোলা পুল। আমি ঠিক করলাম বাঘটিকে অলকানন্দার একদিকে আটকে রাখব, কারণ তাহলে আমার শুধু অর্ধেক অঞ্চলের উপর নজর রাখলেই চলবে।
এজন্য আমাকে প্রথমে খুঁজতে হবে নদীর কোন দিকে বাঘটি রয়েছে। সাধুটিই বাঘের শেষ শিকার এবং সেটি ঘটেছে নদীর বা দিকে, চাটোয়াপিপল ঝোলা পুল থেকে কয়েক মাইল দূরে। আমি নিশ্চিত যে বাঘটি ঝোলা পুল পেরিয়ে অন্য দিকে চলে গেছে, কারণ কোন গ্রামে একজন মানুষ মারা গেলে সেখানকার লোকেরা দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে যায় এবং বাঘের সেখানে তখনই আর একটি শিকার ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন হতে পারে, তা হলে একটি গ্রামে পরপর ছ’জন লোক মারা যায় কি ভাবে? এর উত্তর হল, মানুষ সতর্কতা এক নাগাড়ে বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না। গ্রামে শৌচালয়ের ব্যবস্থা না থাকাও আর একটি কারণ। বাঘটি দশ, পনের বা কুড়ি মাইল দূরে শিকার ধরেছে শুনে কোন গ্রামের পুরুষ, মহিলা বা শিশুরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে নির্ভয়ে রাত্রিবেলা বাইরে বেরিয়ে আসে এবং মানুষখেকোটির কবলে পড়ে মারা যায়।
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (
IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে
অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা
করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার
সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।