সাহিত্য

জুন ৩০, ২০১৬
রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)
দীপক সেনগুপ্ত
১৬। একটি ছাগলের মৃত্যু
(আগের অংশ)
ইবটসন মার্চ মাসের শেষ দিনটিতে পাউরি থেকে ফিরে এল। আমরা যখন প্রাতরাশ সারছি তখন খবর এসে পৌঁছল যে রুদ্রপ্রয়াগের উত্তর পশ্চিম দিকে একটা গ্রামে আগের দিন রাতে বহুক্ষণ ধরে একটা চিতার ডাক শোনা গেছে। এই গ্রামটা হল যেখানে আমরা ‘জিন ট্র্যাপ’ পেতে একটা চিতা মেরেছিলাম সেখান থেকে মাইল খানেক দূরে।
গ্রামটি থেকে আধ মাইল উত্তরে পাহাড়ের ঠিক তলায় একটা বেশ বড় জায়গা জুড়ে জমিটা ছিল অত্যন্ত এবড়ো-খেবড়ো, বড় বড় পাথরের টুকরো ছড়ানো এবং বেশ কয়েকটি গুহাও সেখানে ছিল; আর ছিল গভীর কিছু গর্ত। স্থানীয়দের বিশ্বাস এই সব গর্তে তাদের পূর্বপুরুষেরা তামার খোঁজ করেছিলেন। পাহাড়ের তলদেশ থেকে আধ মাইল দূরে চষা জমি পর্যন্ত জায়গাটা ছিল ঝোপ-ঝাড়ে পূর্ণ, কোথাও গভীর কোথাও একটু হালকা।
বহুদিন থেকেই আমার সন্দেহ যে মানুষখেকোটা যখন রুদ্রপ্রয়াগের ধারে কাছে থাকে তখন লুকিয়ে থাকার জায়গা হিসাবে সে এই ঝোপ জঙ্গলটি বেছে নেয়।
শীতের দিনে বড় পাথরের উপর শুয়ে সকালের রোদ পোয়ানো চিতা বাঘের একটা সাধারণ অভ্যাস। আমি অনেকদিন পাহাড়ের উপর একটা সুবিধামত জায়গায় উঠে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখেছি চিতা বাঘটি রোদ পোয়াচ্ছে কিনা। এভাবে বহু চিতা বাঘ শিকার করা হয়েছে; এর জন্য শুধু প্রয়োজন ধৈর্য ও নির্ভুল লক্ষ্য।
তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার সেরে নিয়ে আমাদের .২৭৫ রাইফেল সঙ্গে করে আমি ও ইবটসন বেরিয়ে পড়লাম। ইবটসনের একজন লোক এক খণ্ড দড়ি নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলল। গ্রামে গিয়ে আমরা একটা ছাগল কিনলাম, আগে যতগুলি ছাগল কিনেছিলাম সব গুলিই চিতার হাতে মারা পড়েছে।
গ্রাম থেকে একটা ছাগল-চড়া রাস্তা সোজা সেই উঁচু নীচু জমিটা পর্যন্ত গিয়েছে, তারপর বা দিকে বেঁকে পাহাড়ের গা দিয়ে একশ’ গজ এগিয়ে পাহাড়ের তলদেশ ঘুরে ওপাশে চলে গেছে। এরই উপরে পাহাড়ের গা ছিল ঝোপ-ঝাড় ছড়ানো এবং নীচের দিকে ছোট ছোট ঘাস দিয়ে ঢাকা।
ঝোপের দশ গজ দূরে রাস্তাটার বাঁকের কাছে একটা শক্ত খুঁটির সঙ্গে ছাগলটাকে বেঁধে রেখে আমরা পাহাড় বেয়ে দেড়শ’ গজ নেমে এসে বড় বড় কয়েকটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। এই ছাগলটির মত সমানে ডাক ছাড়তে আমি আর কোন ছাগলকে দেখিনি; এতে সুবিধা হল এই যে ছাগলটার উপর আমাদের আর সব সময় নজর রাখার দরকার নেই, আর যে শক্ত দড়ি দিয়ে ছাগলটাকে বাঁধা হয়েছে সেটা কোন চিতা ছিঁড়ে ফেলবে সে সম্ভাবনা কম।
লাল আগুনের গোলার মত সূর্যটিকে কেদারনাথের বরফ-ঢাকা চূড়ার যেন ঠিক এক হাত দূরে মনে হচ্ছিল। পাথরের পেছনে বসার আধ ঘণ্টা পরে রোদ সরে গিয়ে আমাদের উপর ছায়া এসে পড়ল এবং একটু পরেই ছাগলটা ডাকা বন্ধ করে দিল। পাথরের এক পাশে সরে গিয়ে ঘাসের ফাঁক দিয়ে দেখি ছাগলটা কান খাড়া করে ঝোপের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু পরে সেটি মাথা নেড়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় যতটা সম্ভব পিছিয়ে এসে দাঁড়াল।
সন্দেহ নেই, চিতাটা এসেছে। ছাগলটার ডাকই তাকে টেনে এনেছে এবং এখনও সে যে ঝাঁপিয়ে পড়েনি তা থেকে বোঝা যাচ্ছে তার মনে একটা দ্বিধা কাজ করছে। ইবটসনের রাইফেলে টেলিস্কোপ থাকায় নির্ভুল লক্ষ্য হবে ভেবে আমি তাকেই গুলি করতে বললাম। সে যখন রাইফেলটা হাতে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল আমি তাকে ফিসফিস করে বললাম সে যেন ছাগলটা ঝোপের যে দিকে তাকিয়ে আছে সেদিকটা ভাল করে লক্ষ্য করে। আমার ধারণা ছিল টেলিস্কোপ থাকায় সামান্য নড়াচড়াও ইবটসনের নজরে পড়বে। বেশ কয়েক মিনিট চোখ রেখেও কিছু দেখতে না পেয়ে সে আমাকে চেষ্টা করতে বলল।
ছাগলটি তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়েছিল, তাকে দেখেই আমি ঝোপের দিকে লক্ষ্য স্থির করলাম। এটা বলতে পারি যে চোখের পলক পড়লেও বা গায়ের একটি লোমের নড়াচড়াও আমার চোখ এড়াতে পারত না। কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও আমি কিছুই দেখতে পেলাম না।
টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে আমি লক্ষ্য করলাম যে দিনের আলো দ্রুত কমে আসছে, ছাগলটিকে মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে যেন একটা লাল-সাদা ছোপের মত। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে এবং আর অপেক্ষা করাটা শুধু যে নিরর্থক তাই নয় বিপজ্জনকও। কাজেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইবটসনকে নিয়ে আমি ফিরে যাবার জন্য তৈরি হলাম।
ছাগলটির কাছে গিয়ে আমরা খুঁটি থেকে তার দড়িটা খুলে দিলাম। সেটি সেই যে ডাকা বন্ধ করেছে তার পরে আর একটি শব্দও করে নি। সঙ্গের লোকটিকে ছাগলটির সঙ্গে আগে আগে যেতে বলে আমরা চলতে শুরু করলাম। কিন্তু মনে হল গলায় দড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাগলটির একেবারেই পছন্দ নয়, সেটা নড়তেই চাইছে না। আমি তখন সঙ্গের লোকটিকে গলার দড়িটা খুলে দিতে বললাম। কারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ভয়ের জন্যই হোক বা সঙ্গ লাভের জন্যই হোক ছাগলেরা ঠিক কুকুরের মতই পিছু পিছু আসে। কিন্তু এ ছাগলটি ছিল নিজের মতে চলায় বিশ্বাসী, তার গলার দড়িটি খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি ঘুরে দাঁড়িয়ে রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে ছুটতে লাগল।
ডাক-ছাড়া একটা ছাগলকে আমরা এত সহজে হাতছাড়া করতে রাজী ছিলাম না। কারণ, একবার তার ডাকে চিতাটা এসেছে, হয় ত আবারও আসবে। তা ছাড়া কিছু আগেই এটিকে কিনতে আমাদের বেশ মূল্য দিতে হয়েছে। এসব ভেবে আমরা তার পিছু নিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। বাঁকের কাছে এসে ছাগলটা বা দিকে ঘুরে যাওয়ায় সেটা আমদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। যে রাস্তায় ছাগলটা গিয়েছিল সেটা ধরে এগিয়ে আমরা পাহাড়ের তলদেশে এসে পৌঁছলাম। সেখানে ঘাসে ঢাকা একটা বিস্তীর্ণ জায়গা চোখে পড়ল কিন্তু ছাগলটিকে কোথাও দেখলাম না। কোন একটা সোজা পথ দিয়ে সে হয় ত গ্রামের দিকেই গেছে ভেবে আমরা আবার ফিরে চললাম। আমি আগে আগে যাচ্ছিলাম, একশ’ গজ লম্বা রাস্তাটির মাঝামাঝি এসে ঝোপের ধারে ঘাসের ঢালু জমির শেষের দিকে সামনের রাস্তার উপরে সাদা রঙের একটা কিছু আমার নজরে পড়ল। দিনের আলো তখন প্রায় মিলিয়েই গিয়েছে, সাবধানে সেই বস্তুটার দিকে এগিয়ে দেখি সেটি সেই ছাগল; হাত-পা ছড়িয়ে এমন ভাবে রয়েছে যাতে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে না পড়ে। তার গলা থেকে রক্ত ঝরছে এবং গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম তার মাংসপেশী তখনও কাঁপছে।
বুঝলাম এটা মানুষখেকোটারই কীর্তি, কারণ অন্য কোন চিতা ছাগলটিকে মেরে এভাবে আমাদের রাস্তায় ফেলে রাখত না। বাঘটা যেন বলতে চাইছে –“ছাগলটিকে যদি তোমাদের দরকার হয়, তবে এটিকেই নিয়ে যাও। আর অন্ধকার রাস্তায় তোমাদের অনেকখানি পথ ত ফিরে যেতে হবে, দেখব তোমরা ক’জন জীবিতাবস্থায় ফিরতে পার।”
আমার মনে হয় না সে রাতে আমরা তিন জনের কেউই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতাম যদি না সৌভাগ্যক্রমে আমার পকেটে এক বাক্স দেশলাই থাকত (ইবটসন ধূমপান করত না)। একটা কাঠি জ্বালিয়ে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে, আবার একটা কাঠি জ্বেলে পাথরে হোঁচট খেতে খেতে আমরা এগিয়ে চললাম। এভাবে চলতে চলতে যখন দেখলাম আমরা গ্রামের কাছে এসেছি এবং আমাদের ডাক গ্রামের লোকের কানে পৌঁছবে তখন আমরা চীৎকার করে সাহায্য চাইলাম। আমাদের ডাক শুনে তারা লন্ঠন ও পাইনের মশাল জ্বেলে আমাদের কাছে এলো।
পর দিন ভোরে ছাগলটির কাছে যেতে গিয়ে পায়ের ছাপ দেখে বুঝলাম আগের রাতে বাঘটা সমস্ত পথটাই আমাদের অনুসরণ করে গ্রাম অবধি এসেছিল। আর ছাগলটা ঠিক যে ভাবে মারা পড়েছিল সে ভাবেই পড়ে আছে।
১৭। সায়ানাইড প্রয়োগ
আগের দিন রাতে যে ছাগলটা মারা পড়েছে সেটা দেখে আমি ইন্সপেকশন বাংলোয় ফিরছি তখন গ্রামেই জানতে পারলাম যে আমার তখনই রুদ্রপ্রয়াগে ফিরে যাওয়া দরকার, কারণ খবর পাওয়া গেছে যে আগের দিন রাতেই মানুষখেকোটা একটা লোককে মেরেছে। যে খবরটা এনেছিল সে বিশদ ভাবে কিছুই বলতে পারল না, ঠিক কোথায় লোকটা মারা পড়েছে তাও সে জানে না। তবে পায়ের ছাপ দেখে যেটা বুঝতে পেরেছিলাম যে আগের রাতে আমাদের পিছু পিছু এসে আমাদের কাউকে ধরতে না পেরে চিতাটা ছাগল-চড়া রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে বাঁকের কাছে এসে ডান দিকে চলে গেছে এবং পাহাড়ের উপরের গ্রামের একজন লোককে মেরেছে; পরে দেখেছিলাম আমার এই অনুমানটাই সত্যি।
বাংলোয় এসে ইবটসনকে নন্দরাম নামে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম। নন্দরাম যে গ্রামে থাকে সেটা আগের দিন বাঘের অপেক্ষায় যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে চার মাইল দূরে। এই গ্রাম থেকে আধ মাইল উপরে একটা গভীর খাদের ধারে গাইয়া নামে দরিদ্র শ্রেণীর একজন লোক কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করে নিজের একটা বাড়ি তৈরি করে নিয়েছিল এবং এখানেই সে তার মা, স্ত্রী ও তিন জন বাচ্চাকে নিয়ে থাকত। সেদিন ভোরে গাইয়ার বাড়ির দিক থেকে মহিলাদের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে চেঁচিয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করে সে জানতে পারে যে ‘ঘরের লোক’কে মানুষখেকোটা আধ ঘণ্টা আগে ধরে নিয়ে গেছে। এই খবর শোনা মাত্র নন্দরাম দ্রুত পায়ে বাংলোয় এসে হাজির হয়েছে।
বেশ ভাল রকম খেয়ে নিয়ে ইবটসনের সেই আরব ও ইংরেজ ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে নন্দরামের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়লাম। পাহাড়ের উপর রাস্তা বলতে কিছুই ছিল না, কেবল গরু-ছাগল চরবার একটা সরু পথ ছাড়া। ইংরেজ ঘোড়াটির পক্ষে সে পথে চুলের কাঁটার মত বাঁক গুলো পেরোনো খুবই অসুবিধা জনক হওয়ায় আমরা ঘোড়া দু’টোকে ফেরত পাঠিয়ে উঁচু চড়াইটা পায়ে হেঁটেই যাব ঠিক করলাম।
আমরা যখন সেই নির্জন জায়গায় ছোট ফাঁকা জমিটাতে এসে দাঁড়ালাম, তখনও দু’জন বিধ্বস্ত মেয়েমানুষ প্রাণপণে সেবার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে যদি তাদের ‘ঘরের লোক’টি বেঁচে ফিরে আসে এই আশায়। তারাই আমাদের দেখিয়ে দিল দরজার কাছে গাইয়া কোথায় বসেছিল যেখানে মানুষখেকোটা তাকে ধরেছে। চিতাটা লোকটির গলা কামড়ে ধরেছিল এবং কোন শব্দই সে করতে পারে নি। তাকে মেরে চারশো’ গজ দূরে একটা জঙ্গলে ঘেরা নীচু জমিতে বয়ে নিয়ে গেছে। এখানে মহিলাদের কান্না এবং নন্দরামের চীৎকারে সে নিশ্চয়ই বিরক্তি বোধ করেছে কারণ, গলা, চোয়াল এবং কাঁধ ও উরুর একটা ছোট অংশ ছাড়া আর কিছুই সে খায় নি।
আশেপাশে কোনো গাছই দেখতে পেলাম না যার উপরে আমরা বসতে পারি। কাজেই, বাঘটা যে সব অংশের মাংস খেয়েছিল সে রকম তিনটি জায়গায় আমরা সায়ানাইড বিষ মিশিয়ে রাখলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে আমরা পাহাড়ের উপর – যেখান থেকে নীচু জমিতে থাকা মৃতদেহটি সম্পূর্ণ নজরে পড়ে – অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাঘটা নিশ্চয়ই ঘন ঝোপটার মধ্যেই ছিল, কিন্তু দু’ঘণ্টা ধরে বসে থেকেও কিছুই দেখতে পেলাম না।
পর দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। আলো ফুটে উঠতেই আমরা আবার পাহাড়ে চড়ে নীচু জমিটায় মৃতদেহটির উপর নজর রাখলাম, কিন্তু এবারও কিছুই দেখতে বা শুনতে পেলাম না। সূর্য যখন ঘণ্টা খানেক হয় উঠেছে সে সময়ে আমরা মরাটার কাছে গিয়ে দেখি শরীরের যে তিনটি জায়গায় আমরা বিষ মিশিয়ে রেখেছিলাম, বাঘটা সেসব অংশ ছোঁয় নি কিন্তু অন্য কাঁধ এবং পা থেকে মাংস খেয়ে কিছুদূর দেহটা তুলে নিয়ে গিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে।
এখানেও মরাটির ওপর নজর রাখার মত কোনো গাছ ধারে কাছে ছিল না। অনেকক্ষণ আলোচনার পর ঠিক হল, ইবটসন পাহাড় থেকে নেমে গ্রামের কাছে যে আমগাছটা আছে সেখানে মাচান বানিয়ে বসে রাতটা কাটাবে আর আমি গ্রামের যে রাস্তাটিতে চিতাটির পায়ের ছাপ দেখেছিলাম সেখানে মরাটি থেকে চারশো’ গজ দূরে অপেক্ষা করব।
যে গাছটি আমি বসার জন্য বেছে নিলাম সেটি ছিল একটা রডোডেনড্রন গাছ। বহু বছর আগে গাছটির জমি থেকে পনেরো ফুট উপরের অংশ ছেঁটে ফেলা হয়েছিল; সেখান থেকে নতুন ডালপালা গজিয়েছে। এখানেই আমি লুকিয়ে বসে থাকার মত সুবিধাজনক জায়গা পেয়ে গেলাম।
আমার সামনেই খাড়া পাহাড়টা জঙ্গলে ভর্তি ; নীচে ফার্ন জাতীয় কিছু গাছের সঙ্গে রয়েছে বেঁটে ধরণের বাঁশঝাড়। পাহাড়ের গায়েই পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত একটা বহু ব্যবহৃত পায়ে চলা পথ চলে গেছে, আমার গাছটা ছিল এই পথটি থেকে দশ ফুট নীচে।
গাছের উপরে আমার বসার আসন থেকে এই পথটির দশ গজ মত জায়গা স্পষ্ট নজরে আসে। পথটি আমার বা দিকে একটা খাদ পেরিয়ে একই উচ্চতায় অন্য পারে চলে গেছে। আমার ডান দিকে তিনশ’ গজ দূরে লোকটির দেহ পড়েছিল। খাদটিতে কোন জল ছিল না কিন্তু ত্রিশ গজ নীচে এবং আমার গাছটির গোড়া থেকে কয়েক গজ দূরে কয়েকটা ছোট ছোট জলাশয় ছিল। এটা থেকে ঝর্ণা আকারে জল নেমে গিয়ে গ্রামের লোকদের পানীয় জল ও চাষের প্রয়োজন মেটাত। গ্রাম থেকে তিনশ’ গজ দূরে পাহাড়ের উপর যে বাড়ির সামনে গাইয়া মারা পড়েছে সেখান থেকে একটা রাস্তা নেমে এসে যে দশ গজ রাস্তাটি আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম বলে আগে বলেছি তার সঙ্গে সমকোণে মিশেছে।
পরিষ্কার চাঁদের আলো থাকায় টর্চের কোন প্রয়োজন ছিল না। চিতাটি আমার সামনের রাস্তা দিয়েই যাক বা সেই বাড়ির সামনে দিয়ে নীচের রাস্তায় নেমে আসুক, আমি কুড়ি থেকে চল্লিশ ফুট দূর থেকে গুলি করার একটা সহজ সুযোগ পাব।
আমি ইবটসনের সঙ্গে পাহাড়ের নীচে কিছুটা নেমে বিদায় জানিয়ে সূর্যাস্তের আগেই গাছটিতে চড়ে বসলাম। কয়েক মিনিট পরে তিনটি ফেজেন্ট পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে এলো এবং ঝর্ণায় জল খেয়ে আবার একই রাস্তায় ফিরে গেল। দু’বারই তারা আমার গাছের নীচ দিয়েই যাতায়াত করেছে, কিন্তু তারা আমায় দেখতে পায় নি। এ থেকেই বুঝলাম আমার লুকোনোর জায়গাটি সঠিক হয়েছে।
রাত্রির প্রথমটা চুপচাপই কেটে গেল; রাত আটটা নাগাদ মরাটির দিক থেকে একটা কাকর ডাকতে শুরু করল। চিতাটি এসেছে এবং আমি নিশ্চিত জানতাম, যে দু’টো রাস্তার দিকে আমি নজর রেখেছি তার কোনোটি দিয়েই সে মরাটির কাছে যায় নি। কিছুক্ষণ ডেকে কাকরটা চুপ করে গেল, এর পর আবার আগের মতই চুপচাপ। দশটা নাগাদ কাকরটা আবার ডাকতে শুরু করল। চিতাটা দীর্ঘ দু’ঘণ্টা ধরে মরাটির কাছে বসে বেশ ভালই মাংস খেয়েছে এবং মাংসের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ বিষও নিশ্চয়ই তার শরীরে ঢুকেছে। এবারে মাংসের মধ্যে গুঁজে রাখা বিষের মাত্রাও বেশ ভালই ছিল।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার সামনের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চাঁদের আলো এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে আমি দূরে ঘাসের ডগা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। রাত দু’টোর সময় চিতাটিকে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে নেমে আসতে শুনলাম। উপরের এবং নীচের দু’টো রাস্তার উপরেই শুকনো পাতা ছড়িয়ে রাখা ছিল যাতে চিতাটা এলে আমি বুঝতে পারি। সে অতি নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে শুকনো পাতা মাড়িয়ে হাঁটছিল, এতে আমার আশা হল হয় ত আমি চিতাটিকে গুলি করার সুযোগ পাব।
রাস্তার বাঁকের কাছে এসে চিতাটা খানিকক্ষণ দাঁড়াল, পরে রাস্তা ছেড়ে নীচু জমিটার মধ্য দিয়ে হেঁটে এসে নীচের রাস্তায় এসে আবার চুপ করে রইল।
আমি হাঁটুর ওপর রাইফেলটা রেখে দু’হাত দিয়ে সেটা ধরে একটুও নড়াচড়া না করে কয়েক ঘণ্টা বসে আছি। আমার স্থির বিশ্বাস ছিল চিতাটা সে রাস্তা ধরেই আসছে, আমি তার সামনে আসার অপেক্ষায় রইলাম। রাইফেলটা কাঁধে ঠেকিয়ে তাকে গুলি করার জন্য যেটুকু নড়াচড়া করতে হবে তাতে কোন অসুবিধা নেই। আমি রাস্তাটার দিকে নজর রাখছি, প্রতি সেকেন্ডে আশা করছি ডালের ফাঁক দিয়ে মাথাটা দেখতে পাব। মানসিক চাপ যখন তুঙ্গে তখন আমি চিতাটিকে লাফিয়ে পড়ে পাহাড়ের কোণাকুণি ভাবে আমার গাছের দিকে এগোতে শুনলাম। মুহূর্তের চিন্তায় আমার মনে হল, সে কোন রহস্যজনক ভাবে আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে এবং পুরানো শিকারের কাছে ফিরে না গিয়ে সে নতুন একজন মানুষ মারার চেষ্টা করছে। পরে বুঝলাম তার রাস্তা ছেড়ে আসার উদ্দেশ্য আমাকে মারা নয়, কারণ সে আমার গাছের নীচ দিয়ে না দাঁড়িয়েই চলে গেল এবং জলের কাছে গিয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে সশব্দে জল খেতে লাগল।
চিতাবাঘের ধরণ ধারণ আমি যতটা জানি তাতে তার জল খাবার রকম থেকে আমার স্থির বিশ্বাস হল যে যথেষ্ট পরিমাণ বিষ নিশ্চয়ই তার পেটে গিয়েছে। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় বুঝতে পারলাম না সায়ানাইড কতক্ষণে তার কাজ শুরু করবে। চিতাটার জল খাওয়া শেষ হবার মিনিট দশেক পরে আমি যখন মনে মনে ভাবছি সেটা ঝর্ণার ধারে মরে পড়ে আছে তখন শুনতে পেলাম খাদের অনেকটা দূরে সে পাহাড়ের উপর উঠছে। উপরের রাস্তাটা ধরে পাহাড়ের গা দিয়ে ওপারে চলে যাবার পর আর কোন শব্দই পাওয়া গেল না।
চিতাটা যখন পথটা ধরে নীচে নামছে, ঢালু জায়গাটার কাছে গিয়েছে, পাহাড় বেয়ে নেমে আমার গাছের নীচ দিয়ে যাচ্ছে, জল খাচ্ছে অথবা খাদের ওপারে চলে যাচ্ছে, কোন সময়েই আমি তাকে দেখতে পাই নি। এটা হঠাৎ হয়েছে না কি সে ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছে জানি না, পরিষ্কার চাঁদের আলো থাকা সত্ত্বেও সে সব সময়েই আমার দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে।
চিতাটিকে আর গুলি করার কোন সম্ভাবনাই নেই। অবশ্য নৈনিতালের ডাক্তার বিষের কার্যকরিতা সম্বন্ধে আমাকে যা বলেছিল তা যদি সত্যি হয় তবে গুলি করার আর কোন প্রয়োজনই হবে না।
পথের দিকটায় নজর দিয়ে এবং কান সজাগ রেখে আমি বাকি রাতটা জেগেই কাটালাম। দিনের আলো ফুটলে ইবটসন ফিরে এলো; এক কাপ চা খেয়ে আমি তাকে রাতের ঘটনা বর্ণনা করলাম।
মৃতদেহটা পরখ করে দেখি দু’রাত আগে চিতাটা যে পায়ের মাংস খেয়েছিল এবারও সে সেখান থেকেই খেয়েছে এবং সেখানে আমরা ভাল রকম বিষ মিশিয়ে রেখেছিলাম। এছাড়া সে কাঁধ ও পিঠ থেকেও মাংস খেয়েছে যেখানেও যথেষ্ট পরিমাণ বিষ ছিল।
এবার চিতাটাকে তাহলে খুঁজে বের করা দরকার। ইবটসনের সঙ্গে পাটোয়ারী ফিরে এসেছিল; সে একাজের জন্য লোক যোগাড় করতে লেগে গেল। দুপুরের মধ্যেই সে দু’শ জন লোক নিয়ে ফিরে এলো এবং আমরা পাহাড়ের যে দিকে চিতাটা গিয়েছিল সেদিক থেকে ‘বিট’ শুরু করলাম।
যেখানে চিতাটা জল খেয়ে পিপাসা মিটিয়েছিল সেখান থেকে আধ মাইল দূরে চলার রাস্তার ধারে বড় বড় কয়েকটা পাথরের পাশে একটা গুহা ছিল। গুহাটা পাহাড়ের ভিতর ঢুকে গেছে এবং গুহার মুখটা একটা চিতাবাঘের ঢোকার পক্ষে যথেষ্টই বড় ছিল। এই গুহাটার মুখে মাটির উপর তার আঁচড়ের দাগ দেখলাম। এখানে সে লোকটির পায়ের পাতা, যেটা সে আস্ত গিলেছিল, উগরে রেখে গেছে।
বড় বড় পাথরের টুকরো বয়ে নিয়ে আসার জন্য অনেকেই খুসি হয়ে হাত লাগালো। সেখান থেকে ফেরার আগে গুহার মুখটা এমন ভাবে বন্ধ করে দিলাম যে ভিতরে চিতাটা ঢুকে থাকলে তার পালাবার কোন সম্ভাবনা থাকবে না।
পর দিক সকালে আমি এক ইঞ্চি তারের জাল নিয়ে এসে পাথর গুলি সরিয়ে তাঁবু খাটানোর লোহার খুঁটি দিয়ে গুহার মুখে ভাল করে জাল লাগিয়ে দিলাম। পরের দশ দিন আমি সকালে এবং বিকালে নিয়মিত গুহাটা দেখতে গিয়েছি এবং যেহেতু অলকানন্দার বা দিকের কোন গ্রামে মানুষ মারার কোন খবর শোনা যায় নি, আমার আশার পারদ চড়তে লাগল। প্রত্যেক দিন মনে হত সেবার গিয়ে আমি চিতাটা যে গুহার মধ্যেই মারা পড়েছে তার চিহ্ন বা প্রমাণ নিশ্চিত ভাবে হাতে পাব।
দশ দিনের দিন সকালবেলা আমি যথারীতি গুহাটা দেখতে গিয়েছি। তারের জাল অক্ষত আছে দেখে ফিরে এসেই ইবটসনের কাছে শুনতে পেলাম রুদ্রপ্রয়াগ-বদরিনাথ রাস্তার এক মাইল উপরে, পাঁচ মাইল দূরের একটা গ্রামে আগের রাতে একটা মেয়ে মারা পড়েছে।
বোঝাই গেল আর্সেনিক ও স্ট্রিকনাইন দিয়ে যাকে কিছু করা যায় নি, সায়ানাইডও তার কাছে সম্পূর্ণ পরাজিত। চিতাটা যে সায়ানাইড খেয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহই নেই এবং সেটা যে গুহায় ঢুকেছিল সেটাও সত্যি কারণ গুহায় ঢোকার সময় তার পিঠের লোম গুহার মুখের পাথরে লেগে ছিল।
হতে পারে অতিরিক্ত মাত্রায় বিষ খাওয়ায় চিতাটার কোন ক্ষতি হয় নি এবং গুহার অন্য দিকের খোলা মুখ দিয়ে সেটা বাইরে বেরোবার পথ পেয়ে গিয়ে থাকবে। মাত্র কয়েক মাস চিতা বাঘটার সংস্পর্শে এসে তার যা পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে গাড়োয়ালের লোকেরা, যারা দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রতিনিয়ত তার অত্যাচার সহ্য করেছে, তাদের পক্ষে বাঘটার কোন অলৌকিক শক্তি রয়েছে এবং সেই অশুভ আত্মাকে আগুন ছাড়া আর কোন ভাবে মারা যাবে না এটা বিশ্বাস করাতে আমি এতটুকু আশ্চর্য হই নি।
(চলবে)
লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (
IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে
অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা
করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার
সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।