প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২১)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩) (২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

বদ্রিকাশ্রমে

২৯ মে, শুক্রবার। - মনের মধ্যে একটা ইচ্ছা ছিল, খুব ভোরে বের হয়ে পড়তে হবে, তাই রাত থাকতেই ঘুম ভেঙে গেল। তখনই আমরা যাত্রার আয়োজন করে নিলুম। আজ আমাদের যাত্রার অবসান। আনন্দে, উৎসাহে এবং সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা নিরাশায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। কোন কবি লিখেছেন, "আশা যার নাই তার কিসের বিষাদ" - আমার কোন বিষাদ ছিল না, কিন্তু যোগী-ঋষিগণ যে সুখের আস্বাদনে বিমুগ্ধ, আমার সে সুখ কোথায়? - আজ হিমালয়ের তুষারমণ্ডিত স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের শস্যশ্যামলা, নদনদী শোভিত, সমতল মাতৃভূমির দিকে চক্ষু ফিরিয়ে মনে মনে ভাবলুম, কোথা সুখ, কোথা তুমি? মাতা বঙ্গভূমি, তোমাকে ত্যাগ করে আজ ভূতলে অতুল তীর্থ বদরিকাশ্রমে দাঁড়িয়ে আছি। সুখের সন্ধানেই এতদূর এসেছি; সুখ নাই মিলুক শান্তি কই? হায়, মনে সে পবিত্রতা নেই, প্রাণের সে একাগ্রতা নেই, কিসে হৃদয়ে শান্তি পাব? এত পরিশ্রম, জীবনের এই কঠোর ব্রত সমস্তই নিäফল হলো।

আমাদের আগে আগে কয়েকজন সাধু অগ্রসর হচ্ছিলেন; তাঁদের আনন্দ, তাঁদের প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখে আমার হিংসা হতে লাগলো। বদরিনারায়ণের উপর পূর্ণ বিশ্বাসে সোৎসাহে তাঁরা অগ্রসর হচ্ছেন, বিশ্বাস-রত্ন অপহৃত হতভাগ্য আমি তাঁদের সেই সুখস্বর্গচ্যুত! সত্য বটে, জীবনে একদিন এমন সুখ ছিল, যার তুলনায় অন্য সুখ কামনা করতুম না; কিন্তু তা হারিয়েছি বলেই কক্ষচ্যুত গ্রহের মত দেশে দেশে ঘুরে আজ এই গিরিরাজ্যে অনন্ত হিমানীর মধ্যে প্রাণের যাতনা বিসর্জন দিতে এসেছি। দেবতায় ভক্তি নেই, চির প্রেমময়ের মঙ্গলময়ত্বেও বিশ্বাস নেই; তবু আশা, যদি প্রাণ শীতল হয়। জানি ধর্মরাজ্যে, প্রেমের রাজ্যে, স্বর্গরাজ্যে '্যদি'Y প্রবেশ নিষেধ। তাই আশার মধ্যে নিরাশা, আনন্দের, বৈদান্তিকের উৎসাহ এবং অন্যান্য যাত্রীদের প্রফুল্ল মুখ দেখে হৃদয় প্রসন্ন হয়ে উঠলো; প্রাণের দীনতা ও আশার ক্ষীণতায় এই রকম ধার করা উৎসাহ ও আমোদ ঢেকে খুব স্ফূর্তি করে অগ্রসর হতে লাগলুম।

আমাদের আগে পিছেও যাত্রী যাচ্ছিল; কিন্তু আমরা তিনটিতে একদল। পথে যেতে অনেকগুলি কুঁড়েঘর রাস্তার ধারে নজরে পড়লো। এ সকল ঘর পাহাড়ি লোকের বাঁধা। তারা এ সকল জায়গা থেকে কাঠ দুধ প্রভৃতি নিয়ে বদরিনারায়ণে বিক্রি করে আসে; এতে তাদের বেশ উপার্জন হয়। পাণ্ডুকেশ্বর ছেড়ে আরো এক মাইল উপরে এখনো বাস করবার জো হয় নি, সমস্ত বরফে ঢাকা। এতদিন দূর হতে পর্বতের গায়ে, চূড়ায় বরফের স্তূপ দেখে এসেছি, সময়ে সময়ে বরফের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে বটে, কিন্তু সে অল্প সময়ের জন্য, এবং তাতে বরফের মধ্য দিয়ে চলার অসুবিধা ভোগ করতে হয় নি। আজ দিগন্তবিস্তৃত শ্বেত তুষারের রাজ্য দিয়ে যেতে লাগলুম। ইতিপূর্বে যে পথ দিয়ে চলেছিলুম, কিছুদিন আগে যে সকল জায়গা বরফে ঢাকা ছিল, গ্রীষ্মকাল আসায় তা গলে পথঘাট সব বেরিয়ে পড়েছে; কিন্তু এ স্থানটি অনেক উচ্চ, তাই এখানকার বরফ আজও গলেনি। পায়ের নীচে কতক জায়গায় বরফ কর্দমময় হয়েছে মাত্র। কিন্তু খানিক উপর হতে ঊর্ধতন প্রদেশে যে বরফ আছে, শীতের প্রারম্ভে নারিকেল তৈল যেমন জমে, অনেকটা সে রকম; তা জমাট পাষাণ স্তূপের মত। সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্ত তা সেই এক ভাবেই থাকবে বলে বোধ হয়। শীতের সময় বিষুÎপ্রয়াগ, কোন কোন বার যোশীমঠ পর্যন্ত, বরফের মধ্যে ডুবে থাকে, গ্রীষ্মকালে নীচের বরফ জল হয়ে নদীর স্রোতের বৃদ্ধি করে; সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির একটা নবজীবন, একটা নূতন মাধুরী পরিস্ফুট হয়ে উঠে।

পাণ্ডুকেশ্বরের একটু উপরের বরফ এখনও গলেনি, আরও কয়েক দিন পরে জায়গায় জায়গায় গলে পথ দেখিয়ে দেবে; তাতে সমস্ত পথ যে বেশ সুগম হবে তা নয়, তবে এই শ্বেতরাজ্যের মধ্যে পথের একটা মোটামুটি সন্ধান পাওয়া যাবে। মরুভূমির মধ্য দিয়ে চলতে শুনেছি পথভ্রান্ত হতে হয়; আমি তেমন নামজাদা মরুভূমির মধ্যে কখনও পড়ি নি, কিন্তু এই রকম রাজ্যের মধ্যেও পথহারা হবার সম্ভাবনা কম নয়। যে দিকে তাকানো যায় শুধু সাদা, বরফ-মণ্ডিত। কোন দিক দিয়ে কোথায় পথ গেল, একে ত তা ঠিক করে নেওয়াই বড় বিপদের কথা, তার উপর এমন অসংলগ্ন পথ যে, পদে পদে পথভ্রান্তির সম্ভাবনা। অন্য কারও পথের ঠিক থাকে কি না, তা বলতে পারিনে, কিন্তু আমরা তিনটি প্রাণী ত প্রতি মুহূর্তে ভাবতে লাগলুম, এইবার বুঝি পথ হারিয়েছি। এমন কি অন্যান্য চিন্তা দূর হয়ে এই দুর্ভাবনাটাই বেশি হয়ে উঠলো।

স্বামীজি ও অচ্যুতভায়া কথাবার্তা চালাতে লাগলেন। আমার কিন্তু সেদিকে মন ছিল না। আমি তখন ঘোর চিন্তায় অভিভূত হয়ে চলছিলুম। বরফের এই অভিনব রাজ্যে এসে আমি একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে আমার অতীত জীবনের দুই একটি কথা মনে পড়ছিল। শৈশবের সেই কোমল হৃদয়, সরলমন, অকপট বন্ধুত্ব এবং সকলের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ভালবাসা, সে কেমন সুন্দর, কেমন মোহময় ছিল। তখন আমার ক্ষুদ্র গ্রামখানি আমার পৃথিবী ছিল; তার প্রত্যেক বৃক্ষপত্র, উন্মুক্ত ক্ষেত্রে ভারাবনত শস্যশীর্ষ এবং দূর-প্রবাহিত বায়ুতরঙ্গের অবিশ্রান্ত গতি যেন কতই স্নেহ ঢেলে দিত। ক্রমে বড় হয়ে দূরে কলিকাতায় পড়তে গেলুম; পবিত্রচেতা মধুর-হৃদয় কত বন্ধু লাভ হলো; এবং একখানি প্রেমপূর্ণ, নিতান্ত নির্ভরতাপূর্ণ হৃদয় আমার জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তার জীবনের সুখ-দুঃখ মিশিয়ে নিলে। হৃদয়ে কত বল, মনে কত সাহস, প্রাণে কত বিশ্বাস! মনে হতো পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা মানুষের দুখানি হাত সুসম্পন্ন করতে না পারে। জীবনের সেই পূর্ণবসন্ত কোথায়? - বসন্তের জ্যোৎস্নাধৌত রাত্রে আম্রমুকুলের সৌরভে পরিপূর্ণ একটি ক্ষুদ্র উপবন-প্রান্তে প্রণয়ী ও প্রণয়িনীর কোমল মিলন, সেই অভিমান ও আদর, হাসি ও অশ্রু, সে সকল কোথায়? কার্যক্ষেত্রে বিপুল পরিশ্রম, লোকহিতে গভীর একাগ্রতা-সে এক স্বপ্ন বলে মনে হয়। ইহজীবনের মধ্যেই যেন একটা বিরাট ব্যবধান। তারই এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ হা-হুতাশ করছি! তখন একদিনও কি কল্পনা করেছি, আজ যেখানে এসেছি, জীবনে একদিন এমন স্থানে আমার পদধূলি পড়বে? কিন্তু আজ এ অভিনব প্রদেশে, স্বর্গের শূন্য সোপানতলে পদার্পণ করে আমার সুখময় শৈশব ও যৌবনের মধুর স্মৃতি দু'দণ্ডের জন্য মনে পড়ে গেল। আমার চিরনির্বাসিত অশান্ত হৃদয় সেই কুসুমকুঞ্জ বেষ্টিত শান্তিময় আলয়ের কথায় চঞ্চল হয়ে উঠলো; অন্যের অলক্ষিতে দুবিন্দু অশ্রু মুছে গাছপালাবর্জিত দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে তুষারাবৃত অলকানন্দার ধারে ধারে চলতে লাগলুম।

পাণ্ডুকেশ্বর ছেড়ে যে সব কুটির দেখতে দেখতে এলুম, সেগুলি বুঝি আমার সুকোমল প্রভাত জীবনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। বাস্তবিক কুটিরগুলি আনন্দপূর্ণ, প্রকৃত সুখের বাসস্থান। পাহাড়িয়ারা এখানে সপরিবারে বাস করছে। সকালে কেহ কাঠ কাটছে, কেহ আঁটি বাঁধছে, কেহ রুটি তৈরি করতে ব্যস্ত, কেহ বা উদরের তৃপ্তিসাধনে নিবিষ্টচিত্ত। পাহাড়ি যুবতীরা কেহ গান গাচ্ছে কেহ ছোট ছোট ছেলেমেয়ের কাছে দাঁড়িয়ে যাত্রীর দল দেখছে; সরল, উন্নতদেহ; প্রফুল্লমুখে কোমল হাসি। যাত্রীর দল দেখে বালিকা, যুবতী এমন কি নিতান্ত শিশুর দলও "জয় বদরিবিশালা কি জয়!" বলে আনন্দধবনি করছে, এবং যাত্রীদের কাছে এসে কেহ বা একটা পয়সা, কেহ বা কিছু সূচ সূতা চাচ্ছে। দেখলুম এরা অনেকেই সূচ সূতার প্রার্থী। বোধ হয় এই দুইটি জিনিসের এরা বেশি ভক্ত। সকল বালক বালিকাই হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ; যুবতীগণের দেহ সবল ও দীর্ঘ। প্রকৃতি যেন নিজহস্তে অতি সহজ ভাবে সমস্ত অঙ্গের পূর্ণতা সম্পাদন করেছেন। বিশেষ তাদের মধ্যে একটা জীবন্ত ভাব দেখলুম, যা আমাদের ম্যালেরিয়াগ্রস্ত বঙ্গদেশের প্লিহাযকৃৎ-প্রপীড়িত অন্তঃপুরে কখনই দৃষ্টিগোচর হয় না! বোধ হলো এ দেশে কোন রকম পীড়ার প্রবেশাধিকার নেই। এমন যে মলিন বস্ত্র ও ছিন্ন কম্বল পরিহিত ছেলেমেয়ের দল, তবু তাদের গোলাপি আভাযুক্ত সুন্দর মুখ দেখলে কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে হয়। কতবার সতৃষ্ণ-নয়নে তাদের মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম। এখানে আর একটু তফাৎ দেখলুম; দেশে থাকতে যখন আমরা রেলের গাড়িতে কি নৌকাযোগে কোথাও যেতুম, প্রায়ই দেখা যেত, পথের দু'পাশে রাখাল বালকেরা পাচনবাড়ি তুলে আমাদের শাসাচ্ছে, কখন বা ছোট হাতের মুষ্টি তুলে, কখন কখন বিকট মুখভঙ্গি করে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে; কিন্তু এ দেশে চাষার ছেলের সে রকম উপসর্গ দেখা গেল না; ছেলেমেয়েগুলি সকলেই কেমন ধীর শান্ত। কেহই কালীঘাটের মত কাহাকেও জড়িয়ে ধরে না, কিম্বা গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চৌরঙ্গীর মোড় পর্যন্ত ছুটে আসে না! কেহ একটি পয়সা চাহিতেও সংকোচবোধ করে; হয় ত মুখের দিকে একটি বার চেয়ে ঘাড় নীচু করলে। যদি তার মনের ভাব বুঝে তার হাতে একটি পয়সা দেও ত উত্তম, না দেও দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাবে। আমাদের বঙ্গভূমি ভিক্ষুকের আর্তনাদের ও কাতর প্রার্থনায় পরিপূর্ণ; তাতে দাতাদিগের কর্ণও বধির করে ফেলে; সুতরাং আমাদের বঙ্গীয় দানশীলগণ যদি এদেশে আসেন, ত এই সব বুভুক্ষু বালক বালিকাদের নীরব প্রার্থনা প্রতিপদেই অনাদৃত হয়! কিন্তু যে সকল সাধু-সন্ন্যাসী এ পথে পদার্পণ করেন, তাঁদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা নিতান্ত কম, এবং তাঁরা গরীবের কাতর প্রার্থনা শুনবার আগেই যথাসাধ্য দান করেন। অতএব দাতার দানে যেমন বিরক্তি নেই, গ্রহীতার ভিক্ষা গ্রহণেও সেইরূপ প্রসন্নতার সম্পূর্ণ অভাব দেখা গেল। যে নিতান্ত ভিখারি, যার পয়সার অত্যন্ত প্রয়োজন, সেও একবারের বেশি দুবার চায় না। তবু আমাদের দেশে দুষ্টুমি-জ্ঞাপক বিশেষণ যোগ করতে হলেই লোকে বলে "পাহাড়ে মেয়ে" "পাহাড়ে শয়তান" ইত্যাদি। এই পাহাড়ের বুকের মধ্যে এসে, পাহাড়ের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে পাহাড়ির প্রতি এ রকম কোপকটাক্ষ অকারণ বলে মনে হলো।

আরও কিছু অগ্রসর হতেই দেখি যে, পাহাড়ের দেবকুটিরের চিহ্ন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চারিদিকে সাদা চিহ্ন ছাড়া আর কিছু দেখবার নেই; কে যেন সমস্ত প্রকৃতিকে দুগ্ধফেননিভ বস্ত্রখণ্ডে মুড়ে রেখেছে। পায়ের নীচে পুরু বরফ তেমন কঠিন নয়; তার মধ্যে কদাচিৎ দুটো একটা জায়গায় বরফ গলাতে পাথরের কৃষ্ণবর্ণ বেরিয়ে পড়েছে। সেইগুলি লক্ষ্য করে পথ চলতে লাগলুম। ইচ্ছা তাড়াতাড়ি চলি,- কিন্তু ভয়ানক কাদার মধ্যে দিয়ে চলতে যেমন জোর পাওয়া যায় না, এক পা তুলতে আর এক পা বসে যায়, আমাদের অবস্থা তদ্রìপ; তবে তফাৎ এই যে, কাদার মধ্য থেকে পা তুলতে ভারি ও আটালো বোধ হয়; বরফে সে রকম কোন উপসর্গ নেই। প্রথমে মনে হল আমরা দইয়ের উপর দিয়ে চলছি; ইচ্ছে হল খানিকটা তুলে গালে ফেলে দিই। কিন্তু স্বামীজির কাছে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেই তিনি এ রকম অশিষ্টাচরণ করার বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি প্রদর্শন করে "প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ" এই চাণক্য-নীতির মর্যাদা রক্ষা করলেন, এবং পাছে বরফ খাওয়া অন্যায় বললে এ যুক্তি তর্কের দিন তাঁর "মিত্রবদাচরেৎ" -এর প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন না করি, এই ভয়ে তিনি বললেন "বরফ খেলে পেটের ব্যারাম হয় !" এই অদ্ভুত মত শুনে আমার হাসি এল; মনে হল আজকাল আমাদের দেশে যুক্তির আধিক্যের মধ্যে বড় একটা নূতনতর জিনিস প্রবেশ ক'রেছে- সেটা হচ্ছে শরীরতত্ব! ছেলেবেলায় শুনতুম, একাদশীতে নিরম্বু উপবাস করলে পুণ্যসঞ্চয় হয়, এখন শুনি একাদশীতে উপবাস করলে শরীরের রস অনেকটা শুষ্ক হয়, সুতরাং জ্বরের আর ভয় থাকে না। আগে শুনতুম কুশাসন পবিত্র জিনিস সুতরাং কোন ধর্মকর্ম উপলক্ষে কুশাসনে বসাই যুক্তিসঙ্গত; এখন শুনতে পাই, কুশাসন অপরিচালক-তাই শরীরজ বিদ্যুতের সঙ্গে ভূমিজ বিদ্যুৎ একীভূত হয়ে শরীরের অনিষ্টসাধন করতে পারে না। এইরূপে টিকি রাখা হতে আচমন করা পর্যন্ত সমস্ত অনুষ্ঠানেরই এমন এক অভিনব ব্যাখ্যা বের হয়েছে, যাতে প্রমাণ করে, দেহরক্ষার চেয়ে আর ধর্ম নেই এবং যা কিছু আমাদের ক্রিয়াকর্ম সকলই এই দেহরক্ষার জন্যে। এতে ফল হয়েছে এই যে, যুক্তিগুলি নিতান্ত উপহাস্যাস্পদ হয়ে পড়েছে। অবশ্যই স্বামীজির প্রদর্শিত উদরাময়ের আশঙ্কা সম্বন্ধে এত কথা খাটে না; তিনি বৃদ্ধ, পরিপাকশক্তির প্রতি হয়ত তাঁর আর তেমন বিশ্বাস নেই এবং "শরীরং ব্যাধিমন্দিরং" এই কথাটার উপর হয় ত অবিচল বিশ্বাস। স্বামীজি আমাকে অনেক অন্যায় কাজ করতে বহুবার নিষেধ করেছেন, এবং তাঁর নিষেধ সত্বেও সেই সকল কাজ করে দু চারবার বেশ ফলভোগও করেছি; কিন্তু বৃদ্ধের অতি সতর্কতা অনুসারে চলাটা সর্বদা আমাদের পুষিয়ে ওঠে না। অতএব স্বামীজির নিষেধ-বাক্যে মনোযোগ না দিয়ে দুই এক তাল বরফ তুলে গালে ফেলে দিলুম; দুর্ভাগ্যবশত তৃপ্তি লাভ করতে পারলুম না। সেই বাল্যকালে যখন কলিকাতায় পড়তুম, তখন বৈশাখের নিদারুণ গ্রীষ্মে গলদঘর্ম হয়ে কখন কখন দুই এক পয়সার বরফ কিনে প্রবল পিপাসার নিবৃত্তি করা যেত। পিপাসা এখনও তেমনই প্রবল আছে, কিন্তু বরফ ত আর তৃপ্তি বোধ হয় না।

এই রকম ভাবে চার পাঁচ মাইল চলার পর আমরা 'হনুমান চটিতে' উপস্থিত হলুম। এর নাম কেন যে 'হনুমান চটি' হলো তা বলতে পারিনে। দোকানদার আজ মোটে চার পাঁচ দিন হলো এসে এখানে দোকান খুলেছে; তার আগে এ চটি বরফে ঢাকা ছিল। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করায়, সেও এই নামের রহস্য ভেদ করতে পারলে না, কিন্তু সে যে জবাব দিলে তাতে হাসি এল। বললেন সে ছেলেমানুষ (বয়স চল্লিশের কাছাকাছি!) তার এ সকল শাস্ত্রকথা জানবার বা বুঝবার সময় হয় নি; বয়োবৃদ্ধ সাধুদের জিজ্ঞাসা করলে ঠিক উত্তর মিলতে পারে। এই চটি পর্ণকুটির নয়। এই দারুণ বরফের রাজ্যে পাতার কুটিরে বাস রক্তমাংসধারীদের পক্ষে অসম্ভব এবং সে রকম সম্ভাবনা উপস্থিত হলে প্রাণ নামক পদার্থটি দেহকে আগেই জবাব দিয়ে বসে থাকে।

চটিতে ছোট পাথরের ঘর, তার একটা বারান্দা বের করা; আর তার পাশেই সম্মুখ দিক খোলা আর একটি ছোট ঘর। শুনলুম, এ ঘর চটিওয়ালার নয়, সে এক দেবতার ঘর। দুচার দিনের মধ্যেই দেবতাটি নিম্নদেশ হতে এখানে এসে তাঁর সিংহাসন দখল করে বসবেন এবং পুণ্যপ্রয়াসী যাত্রীদের আর এক দফা খরচ বাড়বে। এই চটিতে বেশি ঘর না থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানলুম যে, এখানে কোন যাত্রীই থাকতে চায় না। বদরিকাশ্রম এখান থেকে মোটে চার মাইল। বদরিনারায়ণের এত নিকটে এসে কে আরাম বিরাম বা আহারাদি করবে ? আর নারায়ণ দর্শনার্থীর মধ্যেই বা কে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসে এই চার মাইলের জন্যে একখানে বসে থাকবে ? তীর্থযাত্রীদের মধ্যে এমন প্রায়ই দেখা যায় না, যারা মন্দিরের দ্বারে এসে দেবতার শ্রীমুখপঙ্কজ না দেখে সিঁড়ির উপর বসে অপেক্ষা করে। সুতরাং এখানে বেশি দোকান থাকার বিশেষ কোন দরকার নেই; একখানা দোকান , তাই ভাল রকম চলে না। আর এই জন্যেই দোকানি তার দোকানে চাল, ডাল বড় একটা রাখে না, কিছু পেড়া (সন্দেশ) বা পুরি সর্বদা প্রস্তুত রাখে এবং দরকার হলে প্রস্তুত করে দিতে পারে। যাত্রীরা প্রায়ই এখানে ছোলাভাজা পুরি ইত্যাদি জলখাবার কিনে নেয়। আমরাই বা এ সুযোগ ছাড়ি কেন? এই দোকানে টাটকা ভাজা পুরির সুগোল পরিধি দর্শনে বৈদান্তিক ভায়া বিশেষ লোলুপ হয়ে উঠলেন। স্বামীজি বললেন, "চ্যুত, আজ আমাদের মহা আনন্দের দিন; এমন দিন মানুষের ভাগ্যে বড় কম ঘটে, আর অল্পক্ষণ পরেই আমাদের জীবন সার্থক হবে। আজ মনের আনন্দে এখানে আহারাদির আয়োজন কর।" অচ্যুত ভায়াকে এ কথা বলাই বাহুল্য; একে নিজের ষোল আনা ইচ্ছা, তার উপরে স্বামীজির অনুমতি - ভায়া উৎসাহে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। সে দিনের সেই উৎসাহ দেখে মনে হয়েছিল, ভায়া যদি ধর্মকর্মে সর্বদা এমন উৎসাহ প্রকাশ করতেন, তা হলে যতদিন তিনি দণ্ড ছেড়েছেন, তাতে এতদিন তিনি কৃষ্ণ বিষুÎর মধ্যে একজন হতে পারতেন! কিন্তু তাঁর সে দিকে নজর নেই।

দীর্ঘকাল অনাহারে থাকায় এবং পথ পর্যটনে ক্ষুধা অসম্ভব রকম বৃদ্ধি হয়েছিল। যথাবিহিত ক্ষুধাশান্তি করে এবং এক ঘণ্টার জায়গায় তিন ঘণ্টাকাল বিশ্রাম করার পর বদরিনারায়ণের পথে শেষ আড্ডা ত্যাগ করলুম।

একটু অগ্রসর হয়েই সম্মুখে একটা প্রশস্ত দুরারোহ পাহাড় দেখলুম। আগাগোড়া কঠিন বরফরাশিতে আবৃত, যেন বিভূতিভূষিত যোগীশ্রেষ্ঠ; সরল, উন্নত, শুভ্রদেহ, ধৈর্য ও গাম্ভীর্যের যেন অখণ্ড আদর্শ। মস্তক আকাশ স্পর্শ করছে, মধ্যাহ্ন সূর্যের কিরণ তাতে প্রতিফলিত হয়ে কিরীটের ন্যায় শোভা পাচ্ছে। নিম্নে স্তূপে স্তূপে বরফ সঞ্চিত হয়ে পাদদেশ আবৃত করেছে। আমরা যেন বিস্ময় ও ভক্তির পুষ্পাঞ্জলি দেবার জন্যই তাঁর পদতলে এসে দাঁড়ালুম।

কিন্তু আমাদের এই বিস্ময় ও ভক্তি শীগ্রই ভয়ে পরিণত হলো; শুনলুম এই উন্নত পাহাড়ের পরপ্রান্তে বদরিকাশ্রম। এই পাহাড় উল্লঙঘন না করলে আমাদের সেই পুণ্যাশ্রম দেখবার অধিকার নেই; কিন্তু এ পাহাড় অতিক্রম করা বড় সহজ কথা নয়। যাত্রার প্রারম্ভে সন্ন্যাস-গ্রহণের প্রথম উদ্যমেই যদি এমন একটা বিশাল পর্বত আমার অভীষ্ট সাধনের পথ আটকে এই রকমভাবে দাঁড়াতো, তবে এই সন্ন্যাসব্রত-কঠোরতাই যার সাধনার অঙ্গ-তা গ্রহণ করতে সাহস করতুম কি না সন্দেহ। ।

একে ত ক্রমাগত সোজা উপরের দিকে উঠা, প্রতিপদে পা ভেঙে এবং নিশ্বাস আটকে আসে, তার উপর পায়ের নীচে বরফের স্তূপ! যেখানে বরফ একটু গলছে, সেখানে যেন বালিরাশির উপর দিয়ে যাচ্ছি। প্রতি পদক্ষেপেই পা ডুবে যাচ্ছে। আবার যেখানে জমাট কঠিন বরফ, সেখানে ভয়ানক পিছল, একটু অসাবধান হয়ে পা ফেললেই আর কি মুহূর্তের মধ্যে ইহজীবনটা ডিঙিয়ে পরলোকের দ্বারে উপস্থিত হওয়া যায়।
চলতে চলতে পায়ের যাতনা অনেকটা কমে এল দেখলুম। আস্তে আস্তে পা দুখানি অসাড় হয়ে পড়লো; তখন সেই তুষারশীতল স্পর্শ আর কাতর করতে পারলে না। বেশ বেগের সঙ্গেই চলতে লাগলুম। সময়ে সমেয় দুই একদলা বরফ তুলে নিয়ে গোলাকার করে দূরে ছুড়ে ফেলি; দেখতে দেখতে তা ধুলোর মত গুঁড়ো হয়ে যায়।

পা অবশ হয়ে ক্রমে ক্রমে ভারি হয়ে এল, তবু প্রাণশক্তিতে এ পথটুকু চলতে লাগলুম। খানিক পরে পাহাড়ের মাথায় গিয়ে পৌঁছুলুম। বেলা তখন শেষ হয়ে এসেছে।

এখানে এসে চেয়ে দেখলুম অপরপাশে খানিকটে নীচে কিছুদূর বিস্তৃত একটা সমতল ক্ষেত্র। দুই পাশে দুটি অভ্রবেদী পাহাড় ধনুকের মত সেই সমতলভূমিকে কোলে নিয়ে রয়েছে। অলকানন্দা দূরে দূরে আকবাঁকা দেহে অতি ধীরগতিতে চলে যাচ্ছে। কোথাও সামান্য স্রোত দেখা যাচ্ছে; অনেক স্থানেই জল দেখবার জো নেই। পাতলা বরফগুলি ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে, তাই দেখে স্রোতের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। কোথাও বা স্রোতের সম্পর্ক মাত্র নেই, আগাগোড়া জমে গিয়েছে, কেবল নদীগর্ভের নিম্নতায় নদীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যাচ্ছে। সেই দুগ্ধফেননিভ বহুদূরবিস্তৃত তুষাররাশির উপর অস্তোন্মুখ তপনের লাল রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে এমন বিচিত্র শোভা হয়েছিল যে, বোধ হলো সে যেন পৃথিবীর শোভা নয়, সে দৃশ্য অলৌকিক! আমি মনে মনে কল্পনা করলুম, শান্তিহারা অধীর হৃদয়ে ঘুরতে ঘুরতে আজ বুঝি বিধাতার আশীর্বাদে দুঃখকোলাহলময় পৃথিবীর অনেক ঊর্ধে বরণীয় স্বর্গরাজ্যের দ্বারে উপনীত হয়েছি। ঐ তুষারমণ্ডিত সন্ধ্যারাগরঞ্জিত অলকানন্দার শোভাময় উপকূল, আমার কাছে সুরনদী মন্দাকিনীর প্রবালে বাঁধানো সুরম্য তীর বলে মনে হয়েছিল। চারিদিকে কেমন শান্তি, কত পবিত্রতা। দুঃখ, কষ্ট, পথশ্রম সব ভুলে গেলুম। এই অসীম যন্ত্রনাময় দগ্ধ জীবনের গুরুভারও যেন লঘু হয়ে গেল। অদূরে নারায়নের তুষারমণ্ডিত মন্দির। সমতলভূমির উপর আর একটি ছোট মন্দির ও কতকগুলি ছোট ছোট পাথরের ঘর। নদীর ধারে যেমন বালির ঘর বেঁধে মেয়েরা খেলা করে; এবং খেলা সাঙ্গ করে তারা বাড়ি চলে গেলে ঘরগুলি সেই নির্জন নদীতীরে পড়ে থাকে, অলকানন্দার তীরে এই শুভ্র সমতল প্রদেশে এই ছোট ঘর ও মন্দির দেখে আমার মনে হলো বুঝি দেববালারা এসে খেলাচ্ছলে এগুলি তৈয়েরি করেছিল, বেলা অবসান হওয়ায় খেলা সাঙ্গ করে তারা বাড়ি ফিরে গিয়েছে।

কিন্তু পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন পদ্য মেলা দুরূঢ়। তুমি সন্ধ্যাবেলায় অফিস থেকে ফিরে তোমার গৃহপ্রান্তস্থ ফুল বনে বসে আকাশের দিকে চেয়ে পূর্ণ চন্দ্রের শুভ্র শ্বেত হাসি দেখছ, আর তোমার হৃদয়ে শত শত মধুর কল্পনার তুফান উঠেছে, এমন সময় তোমার উদরের নীচ ক্ষুধাবৃত্তি তোমাকে স্বর্গ হতে ডেকে বললে, "সেই ন'টার সময় চাট্টি নাকে মুখে গুঁজে অফিসে যাওয়া হয়েছিল, এখন আর একবার উদর-দেবতাকে সন্তুষ্ট করলে হয় না ?" এবং হয় ত তোমার গৃহিণী হাস্যমুখে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, "চাঁদের আলোতে আর পেট ভরে না, এখন রাত্রে কি খাবে বল, ভাত না রুটি ?" - অমনি চাঁদ, বসন্তের বাতাস , ফুলের গন্ধ সব দূর হয়ে গেল। সেই সন্ধ্যার প্রাক্কালে এই রমণীয় স্থানে দাঁড়িয়ে যখন প্রতি মুহূর্তে করুণারূপিনী সরল-হৃদয়া দেববালাগণের আগমন প্রত্যাশা করছি সেই সময় দেখলুম, মোটা ভুঁড়ি-বের করা টিকিওয়ালা পাণ্ডার দল দ্রুতপদে এসে আমাদের আক্রমন করলে। মন্দাকিনী-তীরে দাঁড়িয়ে আছি কল্পনা না করে যদি কল্পনা করতুম কৈলাসশিখরে উপস্থিত হওয়া গেছে, তা হলে এই অনাকাঙ্খিত পাণ্ডাগণকে কৈলাসনাথের অনুচর বলে ভ্রম না হওয়ার অতি অল্পই সম্ভাবনা ছিল।

পাণ্ডাঠাকুরেরা এসে আমার সঙ্গী খাঁটি সন্ন্যাসী দু'জনকে বাদ দিয়ে আমাকে পাঁকড়াও করলে, "হামলোক শুনা কি এই শেঠজি ছদ্মবেশ লেকে আয়া" বলে দু-তিনজন ভারি শোরগোল করে সেই পবিত্র স্থানের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিলে এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ûে" নারায়ণজীর মন্দি"Y ûে" ধবজা" ûে" অলকানন্দা" প্রভৃতি দেখিয়ে আমার পাণ্ডাত্ব গ্রহণের আয়োজন করতে লাগলো। বলা বাহুল্য আমাকে তারা চিনিয়ে না দিলেও ঐ সকল জিনিসের পরিচয় অবগত হতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হতো না। পাণ্ডাদের উৎপাতে আমাকে ব্যতিব্যস্ত দেখে অচ্যুতভায়া হাসতে লাগলেন, অর্থাৎ কিনা তার ঠিক লোককেই পাকড়াও করেছে। আমার ভয় হতে লাগলো, কালিঘাটের পাণ্ডাদের হাতে স্বর্ণলতার নীলকমলের যেমন দুরবস্থা হয়েছিল, আমারও বা পাছে সেই রকম হয়।


যাহোক, আমার মত লোটা-কম্বলধারী অর্ধগৃহী ও অর্থ সন্ন্যাসীকে একজন বড়দরের শেঠজি বলে অনুমান করাতে তাদের বিচার বিবেচনাশক্তিকে তারিফ করতে হয়। উপক্রমণিকাতেই পাণ্ডাদের এই রকম অত্যাচার দেখে আমার বড়ই ভয় হলো, না জানি পুরপ্রবেশ করলে আরো কি ঘটবে। কিন্তু সে চিন্তা করে কোন ফল নেই ভেবে, পাণ্ডাদের অনেক আশা ভরসা দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা কইতে কইতে অগ্রসর হলুম, তারাও বদরিনারায়ণের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে নানারকম দুর্বোধ্য শ্লোক আউড়ে যেতে লাগলো; তার এক লাইনও যদি আমি বুঝতে পেরে থাকি! কিন্তু তাতে তাদের ক্ষতি কি, তারা খুব উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে কলরব করতে করতে যেতে লাগলো। এদের মধ্যে একজন পাণ্ডা ভারি চালাক, সে আমার নির্জলা তোষামোদ আরম্ভ করল, বলল, "ারে শেঠজি!! আপকো বদন দেখকে মালুম হুয়া আপ বহুত বড়া আদমি, এইসা আদমি নারায়ণ দর্শন করনেকো ওয়াস্তে কভি নেহি আয়া।" আর একজন গল্প জুড়ে দিল, সে গল্পের কতখানি সত্য, কতটা তার কল্পনাপ্রসূত, তা অবশ্য আমি ঠিক করে উঠতে পারি নে, - আর সে জন্যে আমার কিছু আগ্রহও ছিল না। কিন্তু সে যা বললে তার মোদ্দাটা এখানে একটু লেখা যেতে পারে। সে বললে, কয়েক বছর আগে এখানে এক যুবক সাধুর শুভাগমন হয়েছিল। তার আকার প্রকার এবং অবয়বাদি সমস্ত অবিকল আমারই মত কেবল সে ব্যক্তি আমার চেয়ে কিছু লম্বা ও গৌরবর্ণ, আমার চেয়ে কিছু মোটা এবং দাড়িগোঁফ খানিক বড়, বয়সেও আমার চেয়ে কিছু কম বা বেশি হতে পারে; সুতরাং বলা বাহুল্য আমার সঙ্গে সেই গল্পোক্ত ভদ্রলোকের সবই মিলে গেল! আমারই মতন তাঁর গায়ে একখানি কম্বল ছিল সেখানি মূল্যবান বিলিতি কম্বল। কত লোক কত সময়ে কত ভাবে এখানে আসে, কে তার হিসাব রাখে ? তবে যারা জাঁকজমকে অনেক লোকজন সঙ্গে নিয়ে আসে তাদেরই কাছে লোকের কিছু গতিবিধি হয়। উপরি উক্ত লোকটির সঙ্গে কোন লোকজন ছিল না; সুতরাং তার দিকে সাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় নি; বিশেষ সে লোকটি এসে কোন দোকানে কোন পাণ্ডার ঘরে আশ্রয় নেয় নি। নারায়ণ মন্দিরের পাশে একটি খোলা জায়গায় বসে থাকতো, কদাচ এক-আধবার কোথাও উঠে যেত। তাকে এই রকম নিতান্ত অনাথের ন্যায় দীনবেশে অন্যের অনাহূতভাবে বসে থাকতে দেখে মহান্ত মহাশয়ের তার প্রতি দয়া হলো। তিনি তাকে ডেকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন, কিন্তু সে কোন কথার ভাল একটা জবাব দিলে না, সাধু-সন্ন্যাসীরা যেমন সকল অনুসন্ধান উড়িয়ে দিতে চান এও সেইরকম ভাব দেখালে। যাহোক সঙ্গে খাবার সংস্থান নেই অথচ বদরিনারায়ণে এসে একজন সাধু অনাহারে মারা পড়বে, ইহা অনুচিত মনে করে, মহান্ত মহাশয় দুবেলা তাকে ঠাকুরের প্রসাদ খেতে দিতেন। সে কোনদিন প্রসাদ খেত, কোন দিন স্পর্শও করতো না, যেমন প্রসাদ তেমনি পড়ে থাকতো। লোকটির আর একটু বিশেষত্ব ছিল-দিবসে অধিকাংশ সময়েই কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকত, নীরবে পড়ে থাকতেই ভালবাসত; এবং কেহ আলাপ করতে গেলে বরং একটু বিরক্তিই প্রকাশ করতো।

এই ভাবে দশ পনেরো দিন যায়। নারায়ণ দর্শন করে যে সকল যাত্রী ফিরে যায়, তারা সকলেই কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার সেই সুন্দর যুবক সন্ন্যাসীর দিকে চেয়ে চলে যায়। কেহ বা তার সেখানে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে-কিন্তু কোনো সদুত্তর পায় না। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা পেয়াদা, সিপাহি, চাকরবাকর সঙ্গে খুব জমকালো পোশাকআাঁটা, অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত চার পাঁচজন শেঠ এসে বদরিকাশ্রমে উপস্থিত হলো। তারা এখানে কাকেও কিছু না বলে, চারিদিকে কার যেন অনুসন্ধান করে ফিরতে লাগলো। শেঠজিদের এই ব্যবহারে নারায়ণের এই পাণ্ডারা কিঞ্চিৎ ভীত ও বিস্মিত হয়ে পড়লো, এবং ব্যাপার কি জানবার জন্যে তাদের পিছে যাত্রীর ভিড় জমে গেল। যাহোক তারা খুঁজতে খুঁজতে মন্দিরদ্বারে এসে দেখে, একজন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। এ ব্যক্তি আর কেহ নয়, পূর্বকথিত সন্ন্যাসী। কম্বল মুড়ি দিয়ে থাকে দেখে একজন "কোন হ্যায় রে!" বলে সজোরে তাকে ধাক্কা মারলে। ধাক্কা খেয়ে সন্ন্যাসী মুখাবরণ উন্মুক্ত করে উঠে বসতেই সেই জামাজোড়া পরিহিত লোকগুলি তাঁর সম্মুখে নতজানু হয়ে বসে পড়লো, ও বললে, "কসুর মাপ কিজিয়ে, মহারাজ, আপ হিঁয়া, হামলোক তামাম দেশ ঢুড়কে হিঁয়া আয়া।" যে সকল পাণ্ডা এই ব্যাপার দেখছিল, তারা একেবারে অবাক! তাদের অপরাধ কি? সে বেচারিদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমন একটি সন্ন্যাসী-মহারাজ কখন দৃষ্ট হয় নি। পৌরাণিক গল্পে বা উপন্যাসে কখন কখন এরকম লোকের কথা শুনেছে বটে; কিন্তু এই কলিযুগের শ্রেষ্ঠভাগে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা তারা কি রকম করে বিশ্বাস করবে? এদিকে মহারাজের ছদ্মবেশ যখন প্রকাশিত হয়ে পড়লো, তখন "চুপ চুপ, গোল মৎ করো" রবে চারিদকে গোল বেড়ে গেল, সুতরাং মহারাজ আর আত্মগোপন করতে পারলেন না। শেষে অনেক দান-ধ্যান হলো, ব্রাহ্মণ লোকেরাও বহুতর জিনিস লাভ করলেন, অবশেষে মহারাজ স্বস্থানে প্রস্থান করেন। পাণ্ডাজির গল্প শেষ হতে না হতে আর একজন পাণ্ডা আর এক গল্প আরম্ভ করলে; তার গল্পটাও এই রকমই, তবে প্রভেদের মধ্যে এই যে, এতে যেমন মহারাজের অমাত্যগণ এসে তাঁকে নিয়ে চললেন, তাতে সে রকম কেহ আসেনি, মহারানি স্বয়ং এসেছিলেন; কিন্তু তিনি মহারাজের মৃতদেহ ভিন্ন তাঁকে জীবিত দেখতে পান নি, সুতরাং এখানে শ্রাদ্ধ দানধ্যানাদি সমাপ্ত করে, হরকোপানলে মদনভস্ম হলে রতি যেমন শূণ্য প্রাণে পতির মৃতদেহ ত্যাগ করে বিলাপ করতে করতে সুরপুরে ফিরে গিয়েছিলেন, রানি তেমনি স্বরাজ্যে ফিরে গেলেন। পাণ্ডা ও ব্রাহ্মণেরা যে এই রকম করে মধ্যে মধ্যে চর্ব্যচোষ্য আহার ও প্রচুর দক্ষিণা লাভ করে, তারা তা আমাকে জানাতে ত্রুটি করলেন না। আমি ত তাদের কথায় এই বুঝলুম যে, "তুমি একজন ছদ্মবেশী মহারাজা, আমরা নারায়ণের কৃপাবলে তোমায় চিনেছি, আর গোপন করতে পারবে না, এখন আমাদের কি দেবে তা দেও।"

আমি কিন্তু এদের অতিস্তুতিবাদে ভারি বিপন্ন হয়ে পড়েছিলুম। আমার সেই অপরিচ্ছন্ন ঝাঁকড়া চুল, ছিন্নবস্ত্র ও জীর্ণ কম্বলের মধ্যে হতে তারা কি-রূপে যে রাজা-রাজড়ার গন্ধ আবিষ্কার করলে, তা আমি অনুমান করতে পারলুম না। তার চেয়ে বরং স্বামীজির তেজোময় শরীর, আভূমিচুম্বিত দাড়ি, গৈরিক বসন, গৈরিক আলখাল্লা এবং গৈরিক থানের প্রকাণ্ড পাগড়িতে আবৃত মস্তক দেখলে তার মধ্যে একটা মহারাজ সংগুপ্ত, এমন বিবেচনা করা নিতান্ত অসঙ্গত হতো না। যাহোক ক্রমে যখন আমরা বদরিকাশ্রমের অত্যন্ত কাছে এলুম, তখন ধীরে ধীরে পাণ্ডার দল পুষ্ট হতে লাগলো এবং তারা নিজেদের বাহাদুরি দেখিয়ে আমাকে কাড়াকাড়ি করবার উপক্রম করলেন। ক্রমে তাদের মধ্যে মুখোমুখি ছেড়ে শেষে হাতাহাতি হয় দেখে আমার ভারি ভয় হলো। আমি তখন উপায়ান্তর না দেখে আমরা মুষ্টিযোগ ত্যাগ করলুম, বললুম আমার পাণ্ডা লছমীনারায়ণ। জানতুম লছমীনারায়ণ বয়সে প্রায় সকল পাণ্ডা অপেক্ষা ছোট হলেও সম্মানে, অর্থগৌরবে অন্য সকল পাণ্ডাকে ছাড়িয়ে উঠেছিল। লছমীনারায়ণ মহাধর্মাশ্রমের আখড়াধারী, এ সাগরে সেই কর্ণধার; সুতরাং তার নাম বলবামাত্র অন্যান্য পাণ্ডাদের উৎসাহ একেবারে নিবে গেল। তখন তার অন্য উপায় না দেখে, 'ব্রাহ্মণ আশীর্বাদ করবে, তাতে মঙ্গল হবে', ইত্যাকার ধূয়া ধরে কিঞ্চিৎ আদায়ের চেষ্টা দেখতে লাগলো। নিরাশ করা বড় ভাল দেখায় না মনে করে মিষ্টবাক্যে তাদের কিঞ্চিৎ আশা দিয়ে পুরী প্রবেশ করলুম।

(চলবে)

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.