সাহিত্য

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৬
রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)
দীপক সেনগুপ্ত
২২। অন্ধকারে ছোড়া গুলি
(আগের অংশ)
ভারতবর্ষে মানুষের খাবার গ্রহণের সময় ব্যক্তির রুচি ও বছরের সময়ের উপর নির্ভর করে। সাধারণ ভাবে প্রধান তিনটি খাবার সময় হল-প্রাতরাশ ৮টা থেকে ৯টা, মধ্যাহ্ন ভোজন ১টা থেকে ২টো এবং রাতের খাবার ৮টা থেকে ৯টা। রুদ্রপ্রয়াগে আমি যে সময়টা ছিলাম, আমার খাবার সময় ছিল অত্যন্ত অনিয়মিত। সাধারণ যে মতটা চালু আছে যে নিয়মিত সুষম আহার স্বাস্থ্য রক্ষার পক্ষে উপযোগী সেটা আমার ক্ষেত্রে খাটে না। কোন নিয়ম না মেনেই এবং যা খুশি খেয়েও আমি যথেষ্ট শক্তপোক্ত ছিলাম। রাত ৮টায় মণ্ড জাতীয় কিছু, সকালে সুপ এবং দিনের বেলা সব মিলিয়ে মিশিয়ে কিছু একটা খেয়ে বা একেবারে কিছু না খেয়ে আমার স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হয় নি, শুধু ওজনটা কিছু কমে গিয়েছিল।
আগের দিন প্রাতরাশের পর আমি আর কিছুই খাই নি। যেহেতু রাতটা আমি বাইরে কাটাব সেজন্য ভৈঁসোয়ারা থেকে ফিরে সাদামাটা কিছু খেয়ে এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলাম এবং স্নান সেরে গোলাবরাই গ্রামের দিকে রওনা হলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী নিবাসের মালিক ‘পণ্ডিত’কে জানিয়ে দেওয়া যে মানুষখেকোটা এই এলাকাতেই রয়েছে।
আমি যখন রুদ্রপ্রয়াগে প্রথম আসি তখনই ‘পণ্ডিতে’র সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল এবং তার বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে আমি তার সঙ্গে দুটো কথা না বলে যেতাম না। কারণ, মানুষখেকো এবং তীর্থযাত্রীদের সম্বন্ধে তার বহু গল্প জানা ছিল এবং যে দু’জন মানুষখেকোটার সঙ্গে মুখোমুখি লড়েছিল তার মধ্যে একজন ছিল সেই মহিলা যার একটা বাহু ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং অন্য জন হল এই ‘পণ্ডিত’।
‘পণ্ডিতে’র একটা গল্প ছিল এক মহিলা সম্বন্ধে। মহিলাটি ছিল ‘পণ্ডিতে’র বন্ধু এবং রাস্তার নীচের গ্রামে সে থাকত। একদিন রুদ্রপ্রয়াগের বাজার থেকে সন্ধ্যা নাগাদ মহিলাটি গোলাবরাই ফিরল এবং সন্ধ্যার আগে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছতে পারবে না দেখে ‘পণ্ডিতে’র যাত্রী নিবাসে আশ্রয় চাইল। ‘পণ্ডিত’ এতে রাজি হয়ে যাত্রীদের কিনে আনা জিনিস যে ভাঁড়ার ঘরে থাকত তার দরজার সামনে তাকে শুতে বলল। ‘পণ্ডিতে’র যুক্তি ছিল সে ক্ষেত্রে মহিলাটির একদিকে ভাঁড়ার ঘর এবং অন্য দিকে প্রায় পঞ্চাশ জন যাত্রী থাকায় তার সুরক্ষা মজবুত হবে।
যাত্রী নিবাসের ছাদটা ছিল ঘাসে ছাওয়া এবং রাস্তার দিকটা খোলা। ভাঁড়ার ঘরটা ছিল মাঝামাঝি জায়গায়, তবে যেহেতু সেটা পাহাড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে তৈরি করা হয়েছিল অতএব মেঝেতে জায়গা কম পড়ে নি। কাজেই মহিলাটি যখন ভাঁড়ারের দরজার সামনে শুয়ে পড়ল তখন তার এবং রাস্তার মাঝখানে সারি সারি তীর্থযাত্রীরা শুয়ে ছিল। রাত্রিবেলা কোন এক সময় যাত্রীদের মধ্যেই একজন মহিলা চীৎকার করে জানাল যে তাকে বিছা কামড়েছে। কোন আলো সেখানে ছিল না। দেশলাই জ্বেলে মহিলার পা পরীক্ষা করে দেখা গেল একটু আঁচড়ের দাগ রয়েছে এবং সামান্য রক্তও বেরিয়েছে। সবাই মহিলাকে অযথা চীৎকার করার জন্য বিরক্তি প্রকাশ করল কারণ বিছা কামড়ালে কখনও রক্ত বেরোয় না। যাত্রীরা একটু পরেই চুপ করে গিয়ে যে যার ঘুমিয়ে পড়ল।
আমগাছের উপরের দিকের পাহাড়ের গায়ে ছিল ‘পণ্ডিতে’র বাড়ি। সকালবেলা সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাত্রীদের ঘরের সামনের রাস্তায় পাহাড়ি মেয়েদের একটা শাড়ি পড়ে থাকতে দেখল, শাড়িতে রক্তও লেগে রয়েছে। পণ্ডিত তার বন্ধুকে তার মতে সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গাটাই বেছে দিয়েছিল। মহিলাটির পাশে পঞ্চাশ জন বা আরও বেশি যাত্রী শুয়ে ছিল। তাদের মধ্যে ঢুকে সবাইকে কাটিয়ে চিতাটি যখন মহিলাকে মেরে রাস্তায় ফিরে আসছিল তখন হঠাৎই অন্য একজন মহিলার পায়ে আঁচড় লেগে যায়। সব যাত্রীদের ছেড়ে চিতাটা কেন সেই মহিলাকেই শিকার হিসাবে বেছে নিল সে সম্বন্ধে ‘পণ্ডিতে’র ব্যাখ্যা হল সবার মধ্যে একমাত্র মহিলাটিই রঙিন শাড়ি পড়েছিল। কিন্তু এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না কারণ চিতাবাঘ ঘ্রাণ শক্তি কাজে লাগিয়েই তার শিকার ধরে। আমার মনে হয় সেদিন আশ্রয় নেওয়া সব যাত্রীদের মধ্যে একমাত্র পাহাড়ি মহিলাটির গা থেকেই পরিচিত গন্ধ বেরচ্ছিল। অথবা এমন কি হতে পারে যে, কপাল দোষে সবার মধ্যে সেই মহিলাটিরই ফাঁকা জায়গায় রাত কাটানোর চিন্তায় মনে সবচেয়ে বেশি ভয় ঢুকেছিল এবং সেই ভয়টাই মানুষখেকোটাকে আকর্ষণ করে এনেছে ?
এই ঘটনার কিছুকাল পরেই ‘পণ্ডিতে’র সঙ্গে মানুষখেকোটার মুখোমুখি ‘সাক্ষাৎ’ হয়েছিল। সঠিক তারিখ জানতে হলে রুদ্রপ্রয়াগের হাসপাতালে নথির খোঁজ করতে হবে, তবে এই গল্পের ক্ষেত্রে তারিখটা বড় বিষয় নয়; শুধু এটুকু জানলেই হবে যে সেটা ছিল ১৯২১ সালে গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমের দিনগুলির মধ্যে একটি এবং আমার সঙ্গে ‘পণ্ডিতে’র প্রথম পরিচয়ের চার বছর আগের ঘটনা। একদিন সন্ধ্যার পরে দশজন তীর্থযাত্রী ক্লান্ত শরীরে পায়ে ক্ষত নিয়ে মাদ্রাজ থেকে গোলাবরাইতে এসে হাজির হল। তারা সে রাতটা যাত্রী নিবাসে কাটাতে চায়। ‘পণ্ডিতে’র ভয় ছিল যদি কিছু দুর্ঘটনা ঘটে তবে তার যাত্রী নিবাসের বদনাম ছড়িয়ে পড়বে। সেজন্য সে যাত্রীদের আরও দু’মাইল এগিয়ে রুদ্রপ্রয়াগে যেতে বলল কারণ সেখানে তারা সুরক্ষিত আশ্রয় পাবে। কিন্তু যাত্রীরা এত ক্লান্ত ছিল তার কোন কথাই কেউ শুনল না। বাধ্য হয়ে ‘পণ্ডিত’ তার ঘরে যাত্রীদের আশ্রয় দিতে রাজি হল। আমি আগেই বলেছি যে ঘরটা ছিল আমগাছ থেকে পঞ্চাশ গজ উপরে পাহাড়ের গায়ে।
ভৈঁসোয়ারাতে যে রকম নক্সায় বাড়ি তৈরি হয় ‘পণ্ডিতে’র বাড়িটা ছিল সে ভাবেই তৈরি। জ্বালানী রাখার জন্য একটা কম উচ্চতার একতলা এবং উপরে বাস করার জন্য দোতলা। পাথরের সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ উঠেই একটা সরু বারান্দা এবং সামনেই দরজা।
সে রাতে ‘পণ্ডিত’ ও তার দশজন অতিথি সন্ধ্যার পরেই খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরের দরজা বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। ঘরটায় হাওয়া চলাচলের কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং ভিতরটায় ছিল অসহ্য গরম। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ‘পণ্ডিত’ রাতের কোন এক সময় দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো এবং হাত দুটো ছড়িয়ে ছাদের নীচে বারান্দার থাম দু’টো ধরে বুক ভরে রাতের বাতাস টেনে নিল। ঠিক সেই সময়েই তার মনে হল তার গলাটা কেউ যেন যাঁতাকলের মত চেপে ধরেছে। থাম দু’টো শক্ত করে ধরে দু’পা দিয়ে সজোরে একটা লাথি মেরে চিতাটার কামড় থেকে নিজের গলাটা ছাড়িয়ে নিল সে, চিতাটাও সিঁড়ির ওপরে গিয়ে পড়ল। পাছে অজ্ঞান হয়ে যায় এই ভয়ে সে সরে গিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াতেই চিতাটা লাফিয়ে উঠে ‘পণ্ডিতে’র বা হাতটা কামড়ে ধরল। চিতার ওজনে মাংসের কিছু অংশ কব্জির কাছে ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো। ঘাড়ের কাছে কামড়ে বড় ফুটো হয়ে যাওয়ায় শ্বাস প্রশ্বাসের তীব্র আওয়াজ শুনে ভিতরের যাত্রীরা চিতাটা দ্বিতীয়বার লাফিয়ে ওঠার আগেই তাকে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাকি রাতটা ‘পণ্ডিত’ অত্যন্ত কষ্ট করে শ্বাস নিয়েছিল, রক্তপাতও হয়েছিল প্রচুর। চিতাটা বাইরে গর্জন করে দরজাটায় যখন আঁচড় কাটছিল, যাত্রীরা ঘরের ভীতরে তখন ভয়ার্ত চীৎকার করে চলেছে।
পরের দিন আলো ফুটলে ‘পণ্ডিত’কে কালিকমলী হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হল। সুখের বিষয় সে অনেক আগেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে তিন মাস তাকে গলায় রূপোর নল লাগিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। প্রায় ছ’মাস পরে সে গোলাবরাইতে তার নিজের বাড়িতে ফেরে। তার তখন ভগ্ন স্বাস্থ্য, চুলগুলিও সব সাদা হয়ে গেছে। পাঁচ বছর বাদে তার যে ফটো তোলা হয়েছিল তখন তার ক্ষতের দাগ অনেকটা মিলিয়ে গেলেও মুখে ও ঘাড়ের কাছে চিতার দাঁতের দাগ এবং বা হাতে থাবার দাগ পরিষ্কার দেখা যেত।
আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ‘পণ্ডিত’ মানুষখেকোটাকে সব সময় শয়তান বা দুরাত্মা নামে অভিহিত করছিল। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল শয়তানটা যে কারো রূপ ধরে আবির্ভূত হতে পারে না আমার ঘটনাটা ঘটে যাবার পরে তার কি প্রমাণ আপনি দিতে পারবেন? আমিও তার কাছে কৌতুক করে মানুষখেকোটাকে দুরাত্মা বলেই সম্বোধন করছিলাম।
সেই সন্ধ্যায় আমি গোলাবরাই পৌঁছে ভৈঁসোয়ারায় আমার নিষ্ফল প্রয়াসের কথা ‘পণ্ডিত’কে বললাম। তাকে সতর্ক থাকতে বলে তার নিবাসে আশ্রয় নেওয়া যাত্রীদেরও সতর্কবার্তা পৌঁছে দিতে বললাম, কারণ পাহাড়ের বহু জায়গা ঘুরে দুরাত্মাটা আবার এই এলাকায় চলে এসেছে।
সে রাতটা এবং পরের তিন রাত আমি খড়ের গাদার উপর চড়ে রাস্তার উপর দৃষ্টি দিয়ে বসে রইলাম; চতুর্থ দিনে ইবটসন পাউরি থেকে ফিরে এলো।
ইবটসন সব সময়েই আমার কাছে একটা নতুন জীবনের বার্তা বয়ে আনত। স্থানীয় অনেকের মতই সে বিশ্বাস করত মানুষখেকোটা যে কাল মারা যায় নি এজন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সেটা নিশ্চয়ই আগামীকাল কি পরশু মারা পড়বে। ইবটসনকে আমার অনেক কিছু বলার ছিল। যদিও আমি তার সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ রাখছিলাম, আমার লেখা চিঠি থেকে তথ্য নিয়ে সে সরকারকে জানাত এবং সংবাদ মাধ্যমও সে খবর পেত; তবুও সব কিছু ত চিঠিতে লেখা যায় না কাজেই সে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল বিশদ ভাবে সব কিছু শোনবার জন্য। ইবটসনেরও আমাকে বহু বিষয় জানাবার ছিল যেমন মানুষখেকোটি সম্বন্ধে সংবাদপত্রের উৎকণ্ঠিত প্রচার, সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতের সব শিকারির কাছে মানুষখেকোটিকে মারার জন্য আবেদন পাঠান। শিকারিদের কাছে সাহায্য চেয়ে খবর প্রকাশের উত্তরে একজন মাত্র শিকারির কাছ থেকে কিছু প্রশ্ন ও একটি প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছে। সে জানিয়েছে যদি যাতায়াত থাকা খাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা তার মনের মত হয় তবে সে গোলাবরাই যাবার কথা ভেবে দেখতে পারে। তার অপর প্রস্তাব - মানুষখেকোটি মারার সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী উপায় হল একটা ছাগলের সমস্ত শরীরে আর্সেনিক মাখিয়ে তার মুখটা সেলাই করে দেওয়া যাতে সে নিজের শরীর না চাটতে পারে এবং সেই ছাগলটা মানুষখেকোটার নজরে পড়ে এমন একটা জায়গায় বেঁধে রাখা। তাহলেই চিতাটা ছাগলটাকে খাবে এবং তার শরীরে বিষ ঢুকে যাবে।
সেদিন আমরা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছি, আমার ব্যর্থতার চুল চেরা বিশ্লেষণ হয়েছে, মধ্যাহ্ন আহারের সময় আমি ইবটসনকে জানালাম যে চিতাটার অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে-রুদ্রপ্রয়াগ থেকে গোলাবরাইয়ের রাস্তায় পাঁচদিনে অন্তত: একবার সে যাবেই এবং তাকে বুঝিয়ে বললাম যে আগামী দশটা রাত আমি এই রাস্তাটাতেই পাহারা দেব। এই সময়ে চিতাটা নিশ্চিতভাবে একবার এই রাস্তা দিয়ে যাবে এবং আমি তাকে গুলি করার সুযোগ পাব। ইবটসন অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার প্রস্তাবে রাজি হল কারণ, আমি বহু রাত পাহারায় বসেছি, আরও দশটা রাত জেগে পাহারা দিলে সেটা আমার পক্ষে অতিরিক্ত চাপের কারণ হবে। আমি কিন্তু আমার মতেই স্থির রইলাম; ইবটসনকে জানালাম যদি এই সময়ের মধ্যে চিতাটাকে মারতে না পারি তবে নৈনিতাল ফিরে যাব এবং নতুন কারো জন্য জায়গা ছেড়ে দেব।
সেই সন্ধ্যায় ইবটসন আমার সঙ্গে গোলাবরাইতে গিয়ে আমগাছের উপর মাচান তৈরি করতে সাহায্য করল। আমগাছটা ছিল যাত্রী নিবাস থেকে একশ’ গজ দূরে এবং ‘পণ্ডিতে’র বাড়ির পঞ্চাশ গজ নীচে। গাছের ঠিক নীচে রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় কাঠের শক্ত খুঁটি পুঁতে একটা ছাগলের গলায় ঘণ্টা পড়িয়ে তার সঙ্গে বেঁধে রাখলাম। চাঁদটা ছিল প্রায় পূর্ণচন্দ্র, তা সত্ত্বেও গঙ্গার গভীর উপত্যকাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য আলো পড়েছিল। যাই হোক, যদি অন্ধকারের মধ্যেও চিতাটা আসে তবে ছাগলটাই আমাকে সতর্ক করবে।
আমাদের প্রস্তুতি যখন সব শেষ হয়ে গেছে, ইবটসন বাংলোয় ফিরে গেল; যাবার সময় বলে গেল পরদিন সকালেই সে দু’জন লোককে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি যখন গাছের নীচে একটা পাথরের উপর বসে ধূমপান করতে করতে রাত্রির আগমনের অপেক্ষায় ছিলাম, ‘পণ্ডিত’ এসে আমার পাশে বসল, সে ছিল ভক্ত মানুষ এবং ধূমপান করত না। সন্ধ্যার একটু আগে সে আমাদের মাচানটা তৈরি করতে দেখেছে; এবার সে আমাকে বিছানায় আরাম করে না ঘুমিয়ে এই মাচানটায় বসে থাকতে বারণ করল। আমি তাকে জানালাম সে রাত ত বটেই, আরো ন’টা রাত আমি সেখানে বসব কারণ, আমি যদি অশুভ আত্মাটাকে মারতে নাও পারি তবে অন্তত: তার বাড়িটা ও তীর্থযাত্রীদের তো শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারব। সে রাতে আমার উপরের পাহাড়ে একটা কাকর ডাকল, তারপর বাকি রাতটা চুপচাপ। পরের দিন সকালে আমার দু’জন লোক এসে পৌঁছলে তাদের হাতে রাইফেল ও কম্বলটা দিয়ে রাস্তায় চিতাটার কোন পায়ের ছাপ পড়েছে কিনা দেখতে দেখতে ইন্সপেকশন বাংলোর দিকে চললাম।
পরের ন’দিন আমার কর্মসূচীর কোন পরিবর্তন হল না। বাংলো থেকে সন্ধ্যার আগে লোক দু’টির সঙ্গে এসে মাচানে উঠে বসা এবং লোক দু’টোকে ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দেওয়া যাতে তারা সন্ধ্যার আগেই বাংলোয় পৌঁছতে পারে। তাদের উপর কঠোর আদেশ ছিল কোনমতেই যেন তারা সকালে আলো ফোটার আগে বাংলো ছেড়ে না বেরোয়। প্রতিদিন সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা এসে পৌঁছত এবং আমি তাদের সঙ্গে বাংলোয় ফিরে যেতাম।
দশ রাতের মধ্যে আমি সেই যে কাকরের ডাক শুনেছিলাম তার পরে আর কোন শব্দ শুনিনি। মানুষখেকোটা যে সে তল্লাটেই আছে তার যথেষ্ট প্রমাণ ছিল; সেই দশ রাতের মধ্যে সে দু’বার দরজা ভেঙে একটা ছাগল ও দ্বিতীয়বার একটা ভেড়াকে মেরেছে। আমি খুব কষ্ট করে মরা দু’টির সন্ধান পেয়েছিলাম কারণ তাদের বহু দূরে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে দু’টি অবশ্য আমার কোন কাজে এলো না কারণ দু’টোকেই চিতাটা সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলেছিল। আর একবার একটা দরজাও চিতাটা ভেঙেছিল তবে সৌভাগ্যক্রমে বাড়ির লোকেরা ভিতরের একটা ঘরে ছিল। বাইরের দরজাটা ভাঙতে পারলেও ভিতরের দরজাটা ছিল খুবই শক্ত।
দশটা রাত আমগাছে কাটাবার পর ফিরে এসে আমি ইবটসনের সঙ্গে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আর কোন শিকারি এর মধ্যে চিতাটাকে মারবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে যোগাযোগ করে নি; সরকারের আমন্ত্রণে বা সংবাদপত্রের আবেদনেও কেউ সাড়া দেয় নি। আমার বা ইবটসন কারো পক্ষেই রুদ্রপ্রয়াগে আর থাকা সম্ভব ছিল না। ইবটসন দশ দিন অফিসের বাইরে থাকায় তার অনেক কাজ জমে গিয়েছিল আর আমার আফ্রিকা যাওয়া আমি তিন মাস পিছিয়ে দিয়েছিলাম, আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। আমাদের দু’জনেরই এভাবে মানুষখেকোটার দয়ার উপরে সবাইকে সঁপে দিয়ে গাড়োয়াল ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এই অবস্থায় কি করা যায় ভেবে পেলাম না। একটা সমাধান ছিল, ইবটসনের ছুটির জন্য দরখাস্ত করা এবং আমার আফ্রিকা যাত্রা বাতিল করে দেওয়া। শেষে ঠিক করলাম সে রাতটা বাদ দিয়ে আমরা পরের দিন যা করার করব। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে আমি ইবটসনকে বললাম গাড়োয়ালের শেষ রাতটা আমি আম গাছটাতেই কাটাব।
একাদশ ও শেষ সন্ধ্যায় ইবটসনের সঙ্গে আমি যখন গোলাবরাই গ্রামের দিকে এগোচ্ছিলাম তখন একদল লোককে আমগাছটা থেকে একটু দূরে রাস্তার পাশে নীচের জমিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। লোকগুলো আমাদের দেখে নি এবং আমরা যাবার আগেই তারা যাত্রী নিবাসের দিকে চলতে শুরু করল। তাদের মধ্যে একজন ফিরে তাকানোয় আমি তাকে ইশারায় কাছে আসতে বললাম। প্রশ্ন করে জানলাম তারা সবাই একঘণ্টা ধরে নীচের জমিতে দু’টো বিরাট আকৃতির সাপের যুদ্ধ দেখছিল। জমিটাতে একবছর বা তারও বেশী সময় কোন ফসল ফলে নি, সাপ দু’টোকে শেষ দেখা গিয়েছে জমিটার মাঝখানে একখণ্ড পাথরের কাছে। পাথরটাতে রক্ত লেগে রয়েছে দেখলাম, লোকটা জানাল ওটা সাপের গা থেকেই বেরিয়েছে, কারণ তারা পরস্পরকে কামড়ে ধরায় শরীরের কয়েক জায়গায় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। কাছের ঝোপের ভিতর থেকে একটা লাঠি যোগাড় করে আমি নীচে লাফিয়ে নেমে দেখতে চেষ্টা করলাম পাথরটার কাছে কোন গর্ত আছে কিনা। দেখতে গিয়ে রাস্তার ঠিক পাশের ঝোপে দু’টো সাপকেই দেখতে পেলাম। ইতিমধ্যে ইবটসন একটা শক্ত লাঠি যোগাড় করে এগিয়ে এলো এবং একটা সাপ বেয়ে রাস্তায় ওঠার চেষ্টা করতেই সেটাকে মেরে ফেলল; অন্যটি নীচে একটা গর্তে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল, আমরা চেষ্টা করেও সেটাকে বের করতে পারলাম না। ইবটসন যে সাপটাকে মেরেছিল সেটা ছিল সাত ফুট লম্বা এবং গায়ের রঙ ছিল হালকা, খড়ের মত; গায়ে ছিল বেশ কয়েকটা কামড়ের দাগ। সাধারণ ইঁদুরখেকো সাপ সেটা ছিল না, তার স্পষ্ট বিষদাঁত দেখে বুঝতে পারলাম সেটা ছিল একটা ফণাহীন বিষাক্ত গোখরো। শীতল রক্তের প্রাণীদের সাপের বিষে কিছু হয় না এটা ঠিক নয়, কারণ গোখরো সাপের কামড় খেয়ে একটা ব্যাঙকে কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যেতে দেখেছি। তবে এটা জানিনা একই প্রজাতির সাপের ক্ষেত্রে একের কামড়ে অন্যটি মারা যায় কিনা। যে সাপটা গর্তে ঢুকে গিয়েছে সেটা হয় ত কিছু পরেই মারা যাবে অথবা হতে পারে সেটা বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকবে।
ইবটসন চলে যাবার পর ‘পণ্ডিত’ যাত্রীনিবাসে যাবার পথে এক ভাঁড় দুধ বয়ে নিয়ে আমার গাছের নীচে এলো। সে জানালো প্রায় দেড়শ’ জন যাত্রী তার কাছে থাকবে বলে এসেছে এবং সে এখন নিরুপায়। তখন এত দেরি হয়ে গেছে যে আমার আর কিছু করার ছিল না। আমি ‘পণ্ডিত’কে বললাম, সে গিয়ে যেন যাত্রীদের সবাইকে পাশাপাশি থাকতে বলে এবং কোন কারণেই যেন তারা সন্ধ্যার পরে বাইরে না বেরোয়।
‘পণ্ডিত’ দ্রুত পায়ে তার আশ্রয়ে ফিরে চলল; পরে সে আমাকে জানিয়েছিল যে আমার সাবধানবাণী সে যথাযথভাবেই সবাইকে শুনিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল।
রাস্তার কাছেই আমার গাছটা থেকে একশ’ গজ দূরে মাঠের মধ্যে ঝোপে ঘেরা একটা বেষ্টনীর মধ্যে একপাল ছাগল ও ভেড়া নিয়ে তাদের মালিক (আমার পুরানো বন্ধু সেই মালিক নয়) সন্ধ্যার একটু আগে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা যখন গ্রামের দিকে আসছিলাম এবং ইবটসন যখন বাংলোয় ফিরে যাচ্ছে তখন সেই মালিকের কুকুর দু’টো ভীষণ চীৎকার জুড়ে দিয়েছিল।
পূর্ণিমা তিথি শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে, উপত্যকাটি ছিল অন্ধকারে ঢাকা। রাত ন’টার কিছু পরে আমি একটা লোককে দেখলাম লন্ঠন হাতে যাত্রীনিবাস থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গেল, এক কি দু’মিনিট বাদে আবার রাস্তা পেরিয়ে নিবাসে ফিরে এসে সে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে পালের মালিকের কুকুর দুটো ভয়ঙ্কর ভাবে ডাকতে শুরু করল। নিশ্চয়ই সে দু’টো চিতাটাকে দেখেই ডাকছে। খুব সম্ভব লন্ঠন হাতে লোকটিকে চিতাটা দেখতে পেয়েছে এবং এবার সে রাস্তা পেরিয়ে যাত্রী নিবাসের দিকেই আসছে।
প্রথমে কুকুর দুটো রাস্তার দিকে মুখ করেই ডাকছিল কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তারা আমার দিকে তাকিয়ে ডাকতে শুরু করল। চিতাটা খুব সম্ভব ঘুমন্ত ছাগলটাকে দেখতে পেয়েছে এবং কি করবে ভাবছে। চিতাটা কুকুর দুটোর দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ায় তারা ডাকা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি জানতাম চিতাটা এসেছে এবং গাছের নীচের ছাগলটাকে তাক করছে। তবে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে চিতাটা ছাগলটাকে ছেড়ে যাত্রীদের একজনকে ধরতে এগোবে না কি ছাগলটাকেই মারতে এসে আমাকে একটা গুলি করার সুযোগ করে দেবে।
প্রতিটি রাতেই আমি এমন ভাবে বসতাম যাতে খুব কম নড়াচড়া করে এবং কম সময়ে গুলি চালাতে পারি। ছাগলটার থেকে আমার মাচানের দূরত্ব ছিল প্রায় কুড়ি ফুট কিন্তু ডালপালার আড়ালে পড়ে সবই ছিল এমন অন্ধকারে ঢাকা যে আমি কষ্ট করেও এই স্বল্প দূরত্বে কিছুই দেখতে পেলাম না, কাজেই আমি কানে শোনার উপরেই নির্ভর করে রইলাম।
আমার ছোট টর্চ লাগানো রাইফেলটা ছাগলটার দিকে তাক করাই ছিল। এই চিতাটাকেই মানুষখেকো ধরে নিয়ে আমি মনে মনে ভাবছিলাম যে সেটা এতক্ষণে যাত্রীদের কাউকে ধরার চেষ্টা করছে কি না; ঠিক সেই সময়ে গাছের নীচে একটা প্রচণ্ড নড়াচড়ার সঙ্গে ছাগলের গলার ঘণ্টাটাও ঘন ঘন বাজতে শুরু করল। টর্চের বোতাম টিপে আমি দেখলাম রাইফেলটা একটা চিতার ঘাড়ের সঙ্গে একই রেখায় তাক করা রয়েছে। রাইফেলটাকে এক ইঞ্চির ভগ্নাংশ টুকুও না সরিয়ে আমি ট্রিগার টিপে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে টর্চটাও নিভে গেল।
সে সময়ে টর্চের ব্যবহার এখনকার মত এত ব্যাপক ছিল না, আমি এর আগে কখনো টর্চ ব্যবহারও করিনি। আমি এটাকে কয়েক মাস ধরে বয়ে বেরিয়েছি ঠিকই কিন্তু কখনও ব্যবহারের প্রয়োজন হয় নি; ব্যাটারির আয়ু সম্বন্ধেও কোন ধারণা ছিল না বা সেটাকে পরীক্ষা করে দেখারও কোন প্রয়োজন মনে করি নি। এবার যখন আমি টর্চের বোতামটা টিপেছিলাম একটা ক্ষীণ আলো দিয়েই সেটা নিভে গিয়েছিল। আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারেই বসে রইলাম, আমার গুলির কি ফল হল সেটা জানার কোন উপায় ছিল না।
গুলির প্রতিধ্বনি সমস্ত উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছিল; ‘পণ্ডিত’ দরজা খুলে জানতে চাইল আমার কোন সাহায্যের প্রয়োজন আছে কি না। আমি তখন কান দু’টো সম্পূর্ণ সজাগ করে চিতাটার কোন সাড়া পাওয়া যায় কি না সেটা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম, কাজেই তার জিজ্ঞাসার কোন উত্তর আমি দিলাম না এবং সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল।
আমি যখন গুলি চালিয়েছিলাম তখন চিতাটা রাস্তার আড়াআড়ি ভাবে ছিল, মাথাটা ছিল আমার দিক থেকে দূরে। আমার অস্পষ্ট ভাবে যতদূর মনে আছে সেটা ছাগলটার উপর লাফিয়ে পড়ে পাহাড়ের ঢালের দিকে চলে যাবার অবস্থায় ছিল এবং ‘পণ্ডিত’ ডাক দেবার ঠিক আগে আমার মনে হয়েছিল আমি একটা ঘরঘর শব্দ শুনেছি, তবে এটা সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই। যাত্রীরা সবাই আমার গুলির শব্দে জেগে উঠেছিল, তারা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ছাগলটা অক্ষতই ছিল এবং তার ঘণ্টার শব্দ শুনে মনে হ’ল প্রতি রাতে তার জন্য যে প্রচুর ঘাস কেটে রাখা হত সেটাই সে ঘুরে ঘুরে খাচ্ছে।
আমি গুলিটা করেছিলাম রাত দশটার সময়। যেহেতু কয়েক ঘণ্টার আগে চাঁদ ওঠার কথা নয় এবং আমার ইতিমধ্যে করার কিছুই ছিল না, আমি আরাম করে বসে ধূমপান করতে করতে কান খাড়া করে রইলাম যদি কিছু শোনা যায় সেই আশায়।
কয়েক ঘণ্টা পরে গঙ্গার ওপারে পাহাড়ের চূড়ায় চাঁদের আলো এসে পড়ল এবং ক্রমে সে আলো উপত্যকায় নেমে এলো। কিছুক্ষণ পর আমার পিছনের পাহাড়ের উপরে চাঁদের দেখা মিলল; সেটা যখন আমার মাথার উপরে চলে এসেছে তখন আমি গাছের একেবারে উপরে উঠে পড়লাম। কিন্তু ছড়ানো ডালপালায় আমার দৃষ্টি আটকে গেল। আবার মাচানের উপর নেমে এসে রাস্তার দিকের ডাল ধরে এগিয়ে চললাম কিন্তু চিতাটা যেদিকে গেছে ভেবেছিলাম সেদিকের কিছুই চোখে পড়ল না। তখন রাত তিনটে। দু’ঘণ্টা পরে চাঁদের আলো মিলিয়ে যেতে শুরু করল। পূব দিকের ফুটে ওঠা আলোয় আশেপাশের সব কিছু যখন দৃষ্টিতে এলো, আমি গাছ থেকে নামলাম এবং ছাগলটা একটা ডাক ছেড়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল।
ছাগলটা থেকে একটু দূরে রাস্তার ধার ঘেঁষে এক সারি পাথর ছিল। এই পাথরের উপর আমি এক ইঞ্চি চওড়া একটা রক্তের দাগ দেখলাম। যে চিতাটার শরীর থেকে এই রক্ত বেরিয়েছে সে দু’এক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। কাজেই মাংসাশী পশুর রক্তের দাগ অনুসরণ করার সময় যে সব সতর্কতা অবলম্বন করা হয় যেসব কিছুই না করে আমি রাস্তা ছেড়ে নীচে নামলাম। সেই দাগ ধরে পঞ্চাশ গজ এগিয়ে দেখি চিতাটা মরে পড়ে আছে। একটা গর্তের উপর থুতনিটা রেখে হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গীতে সে পড়ে রয়েছে।
মৃত প্রাণীটি সনাক্ত করার মত কোন চিহ্ন আমার জানা ছিল না, তবুও আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে এই চিতাটাই সেই মানুষখেকো। আমার সামনে যেটা পড়ে ছিল সেটা দুরাত্মা নয়। বহু রাত সে আমাকে নজরে রেখেছে, তাকে বাগে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় শয়তানের হাসি হেসেছে, জিব দিয়ে ঠোঁটও চেটেছে, মনে মনে ভেবেছে যে সুযোগ পেলেই অসতর্ক মুহূর্তে আমার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দেবে। আমার সামনে পড়ে আছে একটা বৃদ্ধ চিতাবাঘ। তার অন্য সমগোত্রীয়দের সঙ্গে তফাৎ এটাই যে এর নাক মুখ ছিল একটু ধূসর রঙের এবং কোন ঠোঁটে কোন গোঁফ নেই। ভারতের সর্বাধিক ঘৃণিত ও সবচেয়ে ভীতিজনক এই প্রাণীটির একমাত্র অপরাধ ছিল প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে নয়, মানুষের নিয়মের বিরুদ্ধে; যে মানুষের রক্তপাত সে ঘটিয়েছে সেটা ভয় দেখাবার জন্য নয় নিতান্তই তার বেঁচে থাকার তাগিদে। এখন থুতনিটা গর্তের উপরে রেখে নিমীলিত চক্ষে সে চির নিদ্রায় শায়িত।
যে রাইফেলের গুলিটা চিতাটার ভবলীলা সাঙ্গ করেছে সেটা নামিয়ে রাখছি এমন সময় একটা কাশির শব্দে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি ‘পণ্ডিত’ রাস্তার ধার থেকে আমাকে উঁকি মেরে দেখছে। আমি তাকে ইশারায় ডাকলে সে সবেগে পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে এলো। চিতাটার মাথাটা দেখতে পেয়ে সে একটু থেমে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল ওটা মারা গিয়েছে কি না। আমি যখন তাকে জানালাম যে ওটা মৃত এবং এটাই সেই দুরাত্মা যে পাঁচ বছর আগে তার গলা কামড়ে ধরেছিল ও এটার জন্যই সে কাল রাতে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন সে দু’হাত জোড় করে আমার পায়ে মাথা ঠেকাতে গেল। একটু পরেই উপরে রাস্তা থেকে ডাক এলো –“সাহেব, আপনি কোথায় ?” আমারই একজন লোক উত্তেজিত হয়ে আমাকে ডাকছিল। আমি সাড়া দিলাম, সেই প্রতিধ্বনি গঙ্গার ওপরে ছড়িয়ে পড়ল। এর পরেই চারজনের মাথা দেখতে পেলাম, পর মুহূর্তেই তারা হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলো। একজনের হাতে তখনও লন্ঠন ঝুলছে, সেটা সে নেভাতে ভুলে গিয়েছিল।
গর্তের মুখে চিতাটার শরীরটা তখন শক্ত হয়ে গিয়েছে, কষ্ট করে তাকে টেনে আনতে হল। লোকগুলি সঙ্গে করে একটা শক্ত বাঁশ বয়ে এনেছিল, সেটার সঙ্গে চিতাটাকে বাঁধতে বাঁধতে তারা বলল যে কাল রাতে কেউ ঘুমোতে পারে নি। ইবটসনের জমাদারের ঘড়িতে সাড়ে চারটা বাজতেই তারা একটা লন্ঠন জ্বেলে লাঠি ও দড়ি সঙ্গে নিয়ে আমার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের কেন যেন মনে হয়েছে যে এগুলি আমার কাজে লাগবে। আমি মাচানে নেই, ছাগলটাও অক্ষত রয়েছে এবং পাথরের উপর রক্তের চওড়া দাগ দেখে ধরেই নিয়েছিল যে মানুষখেকোটা আমাকে মেরে ফেলেছে। কি করবে বুঝতে না পেরে চীৎকার করে তারা আমাকে ডেকেছে।
‘পণ্ডিত’কে মাচান থেকে আমার কম্বলটা যোগাড় করতে বলে এবং যে সব যাত্রীরা আশেপাশে ভিড় করেছিল, তাদের কাছে আগের দিন রাত্রের ঘটনা তার মত করে বর্ণনা করতে বলে আমি আমার চারজন লোক ও ছাগলটাকে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেকশন বাংলোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ছাগলটার আঘাত ছিল খুবই সামান্য কারণ, যে মুহূর্তে চিতাটা তার উপর লাফিয়ে পড়তে যাবে সে সময়তেই আমি গুলিটা চালিয়েছি। ছাগলটার আগের দিনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা যে বাকি জীবনটা তাকে ‘হিরো’র আসনে বসাবে এবং তার বিক্রেতার কাছে তাকে ফিরিয়ে দিলে তার মালিক যে তার গলায় একটা সুন্দর বকলস পরিয়ে পয়সা উপার্জন করবে, এত সব ছাগলটার জানার কোন উপায় নেই।
আমি যখন ইবটসনের দরজায় টোকা মারছি তখনো সে ঘুমোচ্ছে। যে মুহূর্তে কাঁচ লাগান দরজার ভিতর দিয়ে আমার দিকে তার চোখ পড়ল, সে লাফিয়ে উঠে এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং সঙ্গের লোকেরা যে চিতাটাকে বারান্দায় নামিয়ে রেখেছিল তার চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। চা আর স্নানের জন্য গরম জল দিতে বলে তার স্টেনোগ্রাফারকে ডেকে পাঠিয়ে সরকারি দপ্তর, সংবাদপত্র, আমার বোন ও জিনকে (ইবটসনের স্ত্রী) দ্রুত টেলিগ্রাম পাঠানোর ব্যবস্থা করল। একটা প্রশ্নও সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে নি কারণ, সে জানত যে চিতাবাঘটা আমি সকালে বয়ে এনেছি সেটাই সেই মানুষখেকো। প্রশ্ন করার প্রয়োজন কি? আগে এরকম একটা ক্ষেত্রে যখন একটা চিতা ‘জিন ট্র্যাপে’ ধরা পড়েছিল, অনেক ধরণের যুক্তি খাড়া করা হলেও আমি কিন্তু বলেছিলাম সেটা মানুষখেকো নয়; এবার কিন্তু আমি কিছুই বলিনি।
গত বছরের অক্টোবর মাস থেকেই ইবটসনকে ভারি দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে, কারণ মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ: বাড়তে থাকায় কাউন্সিলারদের নিজ নিজ এলাকার মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হত, সরকারী পদস্থ অফিসার এবং সংবাদপত্রের লোকেরাও কোন ফল না মেলায় চাপ সৃষ্টি করছিল। তার অবস্থাটা হয়েছিল পুলিশের একজন বড় কর্তার মত যে অপরাধীকে চেনে ও জানে কিন্তু তার অপরাধ করা ঠেকাতে পারছে না এবং এজন্য চারিদিক থেকে উত্যক্ত হতে হচ্ছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই সেই ১৯২৬ সালের ২রা মে তারিখে ইবটসন ছিল সবচেয়ে সুখী লোক, কারণ সে শুধু যে বাইরের সবাইকে অপরাধী মারা পড়েছে এটা বলতে পারছে তাই নয়, বাজার থেকে, আশেপাশের গ্রাম থেকে এবং তীর্থযাত্রীরা - যারা দলে দলে এসে ইন্সপেকশন বাংলোয় জড় হচ্ছিল তাদেরও বলতে পারছে যে গত আট বছর ধরে যে শয়তানটার অত্যাচার তাদের সহ্য করতে হয়েছে সেটা এখন মৃত।
একটা বড় পাত্রের সবটুকু চা খেয়ে এবং গরম জলে স্নান করে আমি একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার পায়ে খিল ধরার সমস্যাটা যদি আবার ফিরে আসে এই ভয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ইবটসনের কথামত চলে পা টা এখন কিছুটা ভাল আছে। এবার আমরা দু’জনে মিলে চিতাটাকে মাপজোক করে ওটাকে ভাল করে পরীক্ষা করলাম। যে তথ্য গুলি আমরা পেয়েছি সেগুলি হ’ল –
মাপ : দু’পায়ের মধ্যের দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ৬ ইঞ্চি ; বক্রতা বরাবর দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি। এই মাপ গুলো চিতাটা মারা যাবার ১২ ঘণ্টা পরে নেওয়া।
বর্ণনা : বর্ণ - ফিকে খড়ের রঙ ; চুল – খাটো ও ভঙ্গুর ; গোঁফ – নেই ; দাঁত – ক্ষয়ে যাওয়া এবং বিবর্ণ, একটা শ্বদন্ত ভাঙা ; জিব ও মুখ – কালো রঙ।
ক্ষত : ডান কাঁধে একটা টাটকা গুলির ক্ষত ; পিছনের বা দিকের পায়ের পাতায় একটা পুরানো গুলির চিহ্ন ; এই পায়েরই একটা নখ ও আঙুল নেই ; মাথায় কয়েকটা গভীর ও আংশিক সেরে যাওয়া ক্ষত ; পিছনের ডান পায়ে একটা গভীর কাটার দাগ ও কিছুটা শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত এবং লেজে কয়েকটা আংশিক শুকনো ক্ষত।
জিব ও মুখের কালো রঙের কোন কারণ আমি খুঁজে পাই নি। অনেকের মতে এটা সায়ানাইডের জন্য হয়েছে কিন্তু সেটা সঠিক কিনা বলতে পারব না। শরীরের ক্ষতগুলি অন্য চিতাবাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে হয়েছে, কিছু হয়েছে ‘জিন ট্র্যাপে’র জন্য। আমরা যে লোম ও এক খণ্ড চামড়া পেয়েছিলাম সেগুলি ক্ষত স্থানের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। পিছনের বা পায়ের ক্ষতটা হয়েছিল ১৯২১ সালে সেতুর উপরে সেনা বাহিনীর এক যুবক অফিসারের ছোড়া গুলিতে। চামড়া ছাড়াবার সময় বুকের মধ্যে যে ছররা পাওয়া গিয়েছিল সেটা যে বছর চিতাটা মানুষখেকো হয়, তখনকার ছোড়া গুলিতে হয়েছে বলে একজন খ্রিষ্টান অনেক পরে দাবী করেছিল।
আমি ও ইবটসন চিতাটাকে পরীক্ষা করার পর সেটাকে একটা গাছের ছায়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং সারাদিন ধরে কয়েক হাজার পুরুষ, মহিলা ও ছেলেমেয়েরা মানুষখেকোটাকে দেখতে আসে।
আমাদের পাহাড়ের মানুষরা যখন বিশেষ কোন উদ্দেশ্য - যেমন কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাতে কারো সঙ্গে দেখা করতে যায় তখন সাধারণ রীতি হ’ল তারা কখনো খালি হাতে যায় না, একটা গোলাপ বা গাঁদা অথবা এসব ফুলেরই কিছু পাপড়ি দু’হাত আঁজলা করে উপহার হিসাবে তার সামনে ধরে। সেই ব্যক্তি ডান হাতের আঙুল দিয়ে সেগুলি স্পর্শ করে দিলে আবার হাত আঁজলা করা ভঙ্গীতেই সম্মানিত ব্যক্তির পায়ে নিবেদন করা হয়।
আমি নানা উপলক্ষে কৃতজ্ঞতা জানাতে দেখেছি কিন্তু সেদিন রুদ্রপ্রয়াগে প্রথমে ইন্সপেকশন বাংলোয় ও পরে বাজারে যেরকম দেখেছি সেরকম আগে কখনো দেখিনি।
“ওটা আমার একমাত্র ছেলেকে মেরে ফেলেছে, সাহেব! এখন আমরা বৃদ্ধ হওয়ায় বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে।”
“ওটা আমার পাঁচ সন্তানের মাকে খেয়ে ফেলেছে; সবচেয়ে ছোটটির এখন কয়েক মাস বয়স। বাড়িতে তার যত্ন নেবার বা রান্না করার কেউ নেই।”
“আমার ছেলে সেদিন রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কেউ সাহস করে হাসপাতালে যেতে পারে নি এবং সেজন্যই সে মারা গিয়েছে।”
একটার পর একটা মর্মান্তিক ঘটনা আমি যখন শুনছি, তখন আমার পা দু’টো ফুলে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
২৩। উপসংহার
আমি আপনাদের যে কাহিনীটা শোনালাম সেটা ঘটেছিল ১৯২৫ থেকে ১৯২৬-এর মধ্যে। ষোল বছর পর মীরাটে একটা যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত থাকাকালীন কর্নেল ফ্লাই একবার একটা আনন্দ অনুষ্ঠানে আহত কিছু মানুষকে সাহায্য করার জন্য আমাকে ও আমার বোনকে আমন্ত্রণ জানালেন। পঞ্চাশ ষাট জন লোক একটা টেনিস কোর্টের চারপাশে জড় হয়ে জলযোগ শেষ করে চা খাবার পর ধূমপান করতে যাচ্ছে এমন সময় আমরা সেখানে গিয়ে হাজির হই। আমি ও আমার বোন কোর্টের চারপাশে ঘুরে তাদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম।
লোকজন যারা এসেছিল, তারা অধিকাংশই এসেছিল মধ্যপ্রাচ্য দেশ থেকে; কেউ এসেছিল ছুটি কাটাতে আবার কাউকে হয় ত বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মিসেস ফ্লাই দেশী কিছু গানের রেকর্ড গ্রামোফোনে বাজাচ্ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের থাকতে অনুরোধ করা হয়েছিল; যেহেতু সেটা শেষ হতে আরো ঘণ্টা দুয়েক বাকি ছিল, আমি আহত লোকদের কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগলাম।
আমি ঘুরতে ঘুরতে বৃত্তের প্রায় অর্ধেক শেষ করেছি, তখন আমার সঙ্গে নীচু চেয়ারে বসা একজন লোকের দেখা হল। দেখলাম তার আঘাতটা বেশ বড় ধরণের এবং চেয়ারের সামনে দু’টো ক্রাচও রাখা ছিল। আমি কাছে যেতে সে কষ্ট করে চেয়ারটা এগিয়ে আমার পায়ে মাথা ঠেকাবার চেষ্টা করল। বেশ কয়েকমাস হাসপাতালে থাকায় তার ওজন খুবই কমে গিয়েছিল, যাতে সে আরাম করে বসতে পারে এজন্য আমি তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। সে বলল –“আমি আপনার বোনের সঙ্গে কথা বলছিলাম, আমাকে গাড়োয়ালবাসী জেনে তিনি আমাকে আপনার কথা বললেন। আপনি যখন মানুষখেকোটা মেরেছেন তখন আমি খুবই ছোট। যেহেতু আমার বাড়িটা ছিল রুদ্রপ্রয়াগ থেকে অনেক দূরে সেজন্য আমি হেঁটে যেতে পারিনি। বাবার শরীরও সেরকম মজবুত ছিল না যে আমাকে বয়ে নিয়ে যাবে, এজন্য আমাকে বাড়িতেই থাকতে হয়েছিল। বাবা ফিরে এসে আমাকে বলেছিল যে সে মানুষখেকোটার সঙ্গে যে সাহেব সেটাকে মেরেছেন তাকেও দেখেছে। বহু লোক জড় হয়েছিল সেটাও বাবা আমাকে বলেছে। সেদিন যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল তা থেকে বাবা তার নিজের অংশটা আমার জন্য বয়ে নিয়ে এসেছিল। সাহেব, এবার আমি অনেক আনন্দ বুকে করে ফিরে গিয়ে বাবাকে বলব যে আমিও নিজের চোখে আপনাকে দেখেছি। প্রতি বছর রুদ্রপ্রয়াগে মানুষখেকোটার মৃত্যু উপলক্ষে যে মেলা হয় সেখানে যদি কেউ আমাকে বয়ে নিয়ে যায়, তবে যার সঙ্গেই দেখা হবে আমি তাকে বলব যে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।”
পূর্ণ বয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পঙ্গু হয়ে ফিরে সে তার নিজের বীরত্বের গল্প না করে বাবাকে আগ্রহের সঙ্গে জানাবে যে বহু বছর আগে যার সঙ্গে সে দেখা করতে পারে নি, এবার নিজের চোখে তাকে দেখেছে - যে লোকটার একমাত্র কৃতিত্ব হল সে এক সময়ে নিখুঁত ও নির্ভুল ভাবে একটা গুলি চালিয়েছিল।
গাড়োয়ালের সরল পরিশ্রমী আদর্শ সেই সন্তান – শুধু গাড়োয়ালের নয় সমস্ত দেশেরই প্রতিনিধি সে। যারা এদের সঙ্গে মিশেছে তারাই এদের প্রকৃত পরিচয় পেয়েছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই উদার হৃদয় মানুষেরাই বিভেদ সৃষ্টিকারী কিছু লোককে একদিন একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে ভারতকে একটা মহান দেশে পরিণত করবে।
চিত্র পরিচয় :

চিত্র – ১ : যে আম গাছে চড়ে জিম করবেট রুদ্রপ্রয়াগের চিতা বাঘটিকে শেষ পর্যন্ত গুলি করে মেরেছিলেন এটি সেই গাছ। ১৯৭৩ সালে প্রথম কেদার-বদরি যাবার পথে রুদ্রপ্রয়াগে এক রাত কাটিয়েছিলাম, তখনই গোলাবরাই গ্রামে গিয়ে ছবিটি তোলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত: এটি ছিল রীলের শেষ ফিল্ম। একটু আলো ঢুকে গিয়ে ছবিটা কিছুটা নষ্ট হয়েছে। গাছের সংলগ্ন সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘Have you read Man Eater of Rudraproyag?’ একটি বন্দুকের ছবিও আঁকা ছিল। সাইনবোর্ডটি এখন আর নেই।

২নং ছবিতে দেখানো হয়েছে পরে যে ফলকটি বসানো হয়েছে সেটি। এটিতে লেখা – ‘On this very spot was killed the man eating leopard of Rudraprayag by Jim Corbett on 2 May 1926.’

চিত্র – ৩ : রুদ্রপ্রয়াগের চিতা বাঘটির ছবি কোথাও ছাপা হয়েছে বলে জানিনা। এই ছবিটি কুমায়ুনের ‘পাওয়ালগড়ের মানুষখেকো’ নামে বিখ্যাত মৃত বাঘটির। পাশে দাঁড়িয়ে জিম করবেট। শিকার কাহিনীটি ‘Man eaters of Kumaon’ বইতে ‘Bachelor of Powalgarh’ নামে বর্ণনা করা হয়েছে ।
− সমাপ্ত −
লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (
IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে
অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা
করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার
সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।