অশ্রুনদীর
সুদূর পারে ঘাট দেখা যায়, তোমার দ্বারে ।।
নিজের হাতে নিজে বাঁধা ঘরে আধা, বাইরে আধা --
এবার ভাসাই সন্ধ্যাহাওয়ায় আপনারে ।।
অপূর্ব এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটির
কথা ও সুরের মিলনে দিন শেষের ভাবটি ফুটে ওঠে। বেলা
গড়িয়ে যায়। পূর্ব দিগন্তে সন্ধ্যার আভাস। পশ্চিম দিগন্ত
সূর্য অস্ত যাবার রাঙা আলোয় ভরা। গোচারণ থেকে ফেরা
গাভীদের খুরের আঘাতে গোধূলির সৃষ্টি। সন্ধ্যার কিছু
পূর্বে এই বিশেষ সময়টির যে কয়টি রাগ আছে তার মধ্যে
পূরবী (রাগসঙ্গীত প্রবেশিকা ৮ দেখুন) এবং পটদীপ (রাগসঙ্গীত
প্রবেশিকা ৯ দেখুন) এই দুটি রাগের পরিচিতি দেওয়া হয়েছে।
আরও কয়েকটি রাগ দেখা যাক। এই সময়ের রাগের বৈশিষ্ট
তীব্র মধ্যমের (হ্ম) ব্যবহারে, যদিও ব্যতিক্রম আছে।
স্বাভাবিক মধ্যম- ও লাগতে পারে, যেমনটি হয় পূরবীর
বেলায়। ঋষভ সচরাচর কোমল। ধৈবত স্বাভাবিক বা কোমল দুই
হতে পরে।
ধানি:
শুরু করি এই
রাগটি দিয়ে। স্বরের ব্যবহার এই রকম:
আরোহণের সময় ণ # স জ্ঞ ম প ণ স *
অবরোহণে স * ণ প জ্ঞ র স ণ # স জ্ঞ র স।
স্বরের চলন জ্ঞ ম প ণ প ম জ্ঞ , ণ # স জ্ঞ র স, প
# ণ # স জ্ঞ
উদাহরণের শুরুতেই
আসে কিশোর কুমারের গাওয়া শর্মিলী ছায়াছবির গান 'খিলতে
হ্যয় গুল য়হাঁ' । এর পরে উল্লেখ করব হিন্দী ছায়াছবি
'হম দোনো' (১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়েছিল, দেব আনন্দ দুটি
ভুমিকায় ছিলেন) থেকে লতা মনগেশকরের গাওয়া 'প্রভু
তেরো নাম'গানটি ।
শেষে পণ্ডিত সীতারাম ব্যাসের কণ্ঠে । রাগটিতে ভীমপলশ্রী
রাগের কিছুটা ছায়া পড়ে (রাগসঙ্গীত প্রবেশিকা ৯ দেখুন);
তফাতের মধ্যে ভীমপলশ্রীতে ধৈবত (স্বাভাবিক) লাগে,
এখানে তা অনুপস্থিত, আর ঋষভের ব্যবহার অল্প। তবে সব
চেয়ে কানে লাগবে মধ্যমের ব্যবহার; ভীমপলশ্রীতে মধ্যম
(স্বাভাবিক) দাপটের সঙ্গে আছে নেতার মতন (বাদী), আর
এখানে গান্ধারের (কোমল) প্রতাপ বেশী, বাদী। মূল কাঠামো
কিন্তু এক। এই কাঠামোর ব্যাপারে পরে আলোচনা করা যাবে।
মারোয়া:
শুরু করি উস্তাদ
আমীর খানের গাওয়া এই শাস্ত্রীয় গানটি দিয়ে 'গুরু
বিনা জ্ঞান' - মারোয়া রাগের একটি অতি শ্রুতিমধুর
নিদর্শন। খান সাহেব এই রাগটিতে ষড়জ নিয়ে যেন লুকোচুরি
খেলেছেন। এই প্রসঙ্গে মারোয়া রাগটির ভাবমূর্তির বড়
সুন্দর একটি বর্ণনা উস্তাদ আমীর খান সাহেব দিয়েছিলেন
(খুব সম্ভবত দেশ পত্রিকায় লেখাটি ছিল)। দিন শেষ হয়ে
সূর্য ঢলেছে। ঘরে একলা মেয়েটির বাবা এখনও চাষের ক্ষেত
থেকে ফেরেনি। রাস্তায় কোনও আওয়াজ হলেই মেয়েটি ছুটে
গিয়ে দরজা খুলছে, এই বুঝি বাবা এল; কিন্তু না তার
বাবা এখনো আসে নি। এই করে করে শেষে একবার সত্যিই তার
বাবা আসে। সে এক পরম প্রশান্তি। মারোয়া রাগে ষড়জের
প্রয়োগও অনেকটা সেই রকম। স্বর ব্যবহার এইরকম: আরোহণে
ন* ঋ গ হ্ম ধ ন ঋ* স*;
অবরোহণের সময়ে স* ন ধ হ্ম গ ন# ঋ স ;
চলন ঋ গ হ্ম ধ হ্ম গ, গ ঋ ন# ধ# ন* ঋ স ।
দেখুন, ঋষভ থেকে সোজা পথে না নেমে এই স্বর, ঐ স্বর
ঘুরে তবে ষড়জে বসল।
আরও একটি গানের
উল্লেখ করব, 'সাজ ঔর আওয়াজ' ছায়া ছবি থেকে লতা মনগেশকরের
গাওয়া গান 'পায়লিয়া
বাবরি মোরি'।
উপরের দুটি রাগেই
স্বাভাবিক ধৈবতের ব্যবহার দেখা যচ্ছে। এবারে দুটি
রাগ দেখব যাতে ধৈবত কোমল।
পুরিয়া ধানেশ্রী:
আরও একটি এই
সময়ের রাগ। ঋষভ ও ধৈবত কোমল, মধ্যম তীব্র; বাকী স্বরগুলি
স্বাভাবিক। প্রয়োগরীতি দেখুন:
আরোহণ ন# ঋ গ হ্ম দ ন স*
অবরোহণ স* ন দ প হ্ম গ ঋ স*
চলন ন# ঋ গ হ্ম ঋ গ প, হ্ম দ প হ্ম গ হ্ম ঋ গ, দ হ্ম
গ ঋ স।
শুরুতেই শুনুন 'বৈজু বাওরা' ছায়াছবি থেকে উস্তাদ আমীর
খানের কণ্ঠে 'তোরি
জয় জয়'। ১৯৬২ সনে মুক্তি পাওয়া হিন্দি ছায়াছবি
'সুরত ঔর সীরত' থেকে আশা ভোঁসলের গাওয়া গান 'প্রেম
লগন মন মে'।
শ্রী:
স্বরসমষ্টি পুরিয়া
ধানেশ্রীর মতই, কিন্তু ব্যবহারের তফাতে রাগের রূপটি
কেমন বদলে যায় দেখুন।
আরোহণ স ঋ হ্ম প ন স*
অবরোহণে স* ন দ প হ্ম গ ঋ স
চলন ঋ ঋ প, প হ্ম প দ হ্ম গ, ঋ ঋ প ঋ গ ঋ স
পণ্ডিত ডি ভি
পলুশকারের এই গানটি খুবই পুরাতন এবং অতি শ্রুতিমধুর
'হরিকে
চরণ কমল'। শ্রী রাগের আর একটি অপূর্ব নিদর্শন
রবীন্দ্রসঙ্গীত 'কার
মিলন চাও'
রাত্রি এসে যেথায় মেশে ..
ভোর চারটে থেকে
ভোর ছটা, অর্থাত্ যাকে আমরা ঊষা বলি, যেন গোধূলির
ঠিক বিপরীত রূপ, আলোকের রকমে নয়, আলোক পরিবর্তনের
ক্রমে। এই সময়ের রাগেও গোধূলির সময়ের রাগের চেনা স্বরগুলি
দেখা যায়। অর্থাত্ তীব্র মধ্যম (হ্ম) এবং কোমল ঋষভ
(ঋ) এই দুটি স্বর প্রযুক্ত হয় ঊষাকালীন রাগে। কয়েকটি
রাগ নিয়ে দেখা যাক। ( এই প্রসঙ্গে বলে রাখি শাস্ত্রীয়
সঙ্গীত জগতে ঊষা এবং গোধূলি এই দুটি সময় সন্ধিপ্রকাশ
নমে পরিচিত)।
ভাটিয়ার:
স্বর লাগে স
ঋ গ ম হ্ম প ধ ন
আরোহণের সময় স ম প ধ ন ঋ* স*
অবরোহণে স* ন ধ প ম প গ প গ ঋ স
সাধারণ চলন স ধ ধ ন প, প ম ম প গ, প গ ঋ স
এখানে প্রশ্ন
উঠবে আরোহণ, অবরোহণ বা চলন কোথাও তো তীব্র মধ্যমের
(হ্ম) ব্যবহার দেখা গেল না, তা হলে তীব্র মধ্যম লাগল
কোথায়। লাগে একটি বিশেষ চলনে যখন স্বাভাবিক মধ্যম
থেকে পঞ্চম ছুঁয়ে ধৈবত যাবে তখন তীব্র মধ্যমে ভর করে;
যেমন প ম প হ্ম দ স* ন ঋ* ন দ প ম, এই চলনটি এর পরে
গানে পাবেন।
উস্তাদ আমীর খানের কণ্ঠে শুনুন ভাটিয়ারের
শাস্ত্রীয় রূপ। একই রাগে পণ্ডিত
অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে শুনুন রাগপ্রধান গান 'আজি
দুখনিশি'। মান্না দের গাওয়া এই গানটিও একটি সুন্দর
নিদর্শন 'এ
কি অপূর্ব প্রেম'।
ললিত:
স্বর সমষ্টি
ভাটিয়ারের মতনই, কেবল ধৈবত কোমল (দ)। আর একটি বিশেষত্ব
অবরোহণের সময় দুই রকম মধ্যমই পর পর লাগে।
আরোহণে ন# ঋ গ হ্ম দ ন স*
অবরোণে স* ন দ হ্ম ম গ হ্ম গ ঋ স
চলন ন# ঋ গ ম, দ হ্ম দ হ্ম ম গ, ঋ গ ঋ গ হ্ম গ ঋ স।
পণ্ডিত ভীষ্মদেব
চট্টোপাধ্যায়ের একটি শাস্ত্রীয় গান শুনুন 'পিউ
পিউ রটত'। পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর
রাগপ্রধান গান শুনুন 'মা
মা বলে' । সব শেষে লতা মনগেশকর ও মান্না দের কণ্ঠে
শুনুন হিন্দী ছায়াছবি 'চাচা জিন্দাবাদ'- র গান 'প্রিতম
দরশ'।
রাগ ললিতের আরও
একটি গঠন আছে কোমল ধৈবতের বদলে শুদ্ধ ধৈবত দিয়ে। তবে
খুব প্রচলিত নয়।
(চলবে)