আমরা এবার রাগসঙ্গীতের
খুঁটিনাটিতে ঢুকব। তবে শিক্ষার্থী হিসাবে নয়; মু±ধ
পর্যটক হিসাবে। আমি খুব বেশী হলে একজন পথপ্রদর্শক
যে আগে কিছুটা ঘুরে গেছে; শিক্ষক নয়। আমার মু±ধ দর্শনজনিত
অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব।
এর আগে আমরা
কয়েকটি রাগে কি কি স্বর লাগে দেখেছি। কিন্তু তাতে
রাগের উপাদানটাই খালি জানা গেল; রাগের চেহারা জানা
গেল না। পৃথিবীর সব মানুষের মূল উপাদান একই, কিন্তু
উপাদানের তারতম্যর জন্য চেহারার তফাত্। এর উপর আছে
ব্যক্তিত্ব আর মেজাজের তফাত্। রাগের বেলায়ও ঠিক তাই।
ধরুন না কেন গত আসরে দেওয়া হয়েছে দরবারী কানাড়া রাগে
কি কি স্বর লাগে, যা হল:
স র জ্ঞ ম প দ ণ
আরও কয়েকটি রাগে
একই স্বর সমষ্টি ব্যবহার করা হয়, যথা - আড়ানা। দরবারী
কানাড়া রাগের উদাহরণ আগেই দিয়েছি; এখন আড়ানা রাগের
উদাহরণ দিচ্ছি।
আড়ানা
'বাণী
তব ধায়' (রবীন্দ্রসঙ্গীত), ' মম মন্দিরে এলে কে
তুমি ' (শচীন দেববর্মণে র গাওয়া), ' এরি এরি হঁসু
বোল ' (' বসন্তবাহার ' ছায়াছবিতে আমীর খান- র গাওয়া),
'ঝনক
ঝনক পায়ল বাজে' ('ঝনক ঝনক পায়ল বাজে' ছায়াছবিতে
আমীর খান- র গাওয়া)
তফাত্ কোথায়
এবং কি ভাবে হল? এ রহস্য উদ্ধার করতে গেলে কয়েকটি
ব্যাপার আগে জেনে নিতে হবে। শিকারী বিড়াল চিনি গোঁফে;
পাড়ার গোবরা মাতালকে সন্ধ্যার অন্ধকারেও পিছন থেকেই
চেনা যায় তার এলোমেলো চলনে। ঠিক তেমনই রাগ চিনি তার
কয়েকটি বিশেষ চলনে।
প্রথমেই আসে
রাগের আরোহণ ও অবরোহণে স্বরের ব্যবহার কি ভাবে হচ্ছে।
আপনি সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করেন কি একই ভাবে? অথবা
আপনি যে ভাবে করেন, অন্য কেউ বা কেউ কেউ কি একই ভাবে
করেন? তফাত্ হয়। রাগের আরোহণ আর অবরোহণের বেলাও তাই।
আরোহণ হচ্ছে নীচের স্বর থেকে উপর দিকে যাওয়া- উদারা
থেকে মুদারা, মুদারা থেকে তারা। অবরোহণ হচ্ছে ঠিক
উলটা পথে- তারা থেকে মুদারা, মুদারা থেকে উদারা। আশা
করি উদারা, মুদারা এবং তারা এই তিন সপ্তকের কথা ভুলে
যান নি। তা আপনি যেমন বাড়ীর সব কটি ধাপ সব সময় ব্যবহার
করেন না, রাগের আরোহণ অবরোহণ প্রায় তাই। এখন দেখে
নেব দরবারী কানাড়া ও আড়ানা, দুটি রাগের মধ্যে আরোহণ
এবং অবরোহণে কি তফাত্ আছে।
রাগ আরোহণ অবরোহণ
বাদী
আড়ানা স র ম প ণ ম প স* র* ণ স* দ ণ প ম প জ্ঞ ম স
র স স*
দরবারী কানাড়া স র জ্ঞ ম প দ ণ স* স* দ ণ প জ্ঞ ম
র স র
ঐ দেখুন, আবার
একটা নতুন ব্যাপার জুড়ে দিয়েছি - বাদী । বাদী হল সেই
স্বরটি যে স্বর খুব বেশী ব্যবহার হচ্ছে; শিল্পী ঘুরে
ফিরে ঐ স্বরেই আসছেন, রাগের আলাপ, বিস্তার, তান সবই
ঐ স্বরকে ঘিরেই হছে; যেন নেতা। নেতার আবার উপনেতা
(সহজ ভাষায় চামচা) থাকে, রাজার থাকে পারিষদ, প্রধান
মন্ত্রী, ইত্যাদি। বাদী স্বরের থাকে সম্বাদী, অনুবাদী,
বিবাদী ইত্যাদি। এই ব্যাপারে পরে আলোচনা করব।
আর একটি ব্যাপার
হল রাগের বিশেষ পরিচয় চিহ্ন যাকে রাগের 'পকড়' বলে।
ঠিক যেমন ব্যাংক আপনার চেকের বদলে টাকা দেবার সময়
আপনার সইটা ব্যাংকে রাখা আপনার নমুনা সই- এর সঙ্গে
মিলিয়ে নিয়ে টাকা দেয়। পকড় হচ্ছে রাগের সিগনেচার।
এই পকড় হচ্ছে রাগে ব্যবহৃত স্বরের টুকরো টুকরো গুচ্ছ,
ঠিক যেমন মণি মুক্তায় গাঁথা মালার ছোট ছোট ভাগ, যা
একটি নিদ্র্দিষ্ট বিন্যাস বা ছাঁদে থাকে। আপনি যদি
ঠিক সুরে গান বা বাজান 'ন র গা র ন# র স', দেখবেন
(মানে শুনবেন) য়ামন রাগের রূপটি ফুটে উঠল। এখন দরবারী
কানাড়া ও আড়ানা এই দুটি রাগের পকড়গুলি দেখা যাক:
দরবারী
কানাড়া
জ্ঞ ম র স; ন#
স র দ#, ন# প# স
আড়ানা
স* দ ণ প ম প
স* জ্ঞ ম প জ্ঞ ম স র স
(আশা করি * এবং
# এই চিহ্ন দুটি ভুলে যান নি; ভুলে গেলে, রাগসঙ্গীত
প্রবেশিকা (১) দেখুন)
একবার গুন্গুন্
করে উপরের স্বরগুলি গান, অথবা হারমনিয়মে বাজান। তার
পর নীচে লেখা দুটি গান আবার শুনুন:
'ঝনক
ঝনক তোরি বাজে পায়লিয়া'
'ঝনক
ঝনক পায়ল বাজে'
গানগুলি শুনুন
আর মনে মনে বিচার করুন দুটি রাগের মধ্যে কি কি তফাত্
হচ্ছে। আগামী কিস্তিতে এই নিয়ে আরও কিছু আলোচনা করব।
এখন 'ছুটির বাঁশি বাজলো'।
পরের অংশের জন্য দেখুন: রাগ সঙ্গীত প্রবেশিকা (৪)
(চলবে)