প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

রাগ সঙ্গীত প্রবেশিকা ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪
কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে
মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা, মনে মনে ....

আপনাদের পথ দেখাতে গিয়ে একটু বেশী এগিয়েছিলাম (মনে মনে) এবং সুর ও স্বরের বিশাল বাগিচায় বুঁদ হয়েছিলাম। চটকা ভাঙতে ফিরে এলাম, তবে দেরী হয়ে গিযেছে।

আগের দিন আমরা দেখেছি সঙ্গীতে মোট স্বর বা সুর বারোটি: সাতটি শুদ্ধ আর পাঁচটি বিকৃত, অর্থাত্ কোমল বা তীব্র (তীব্র স্বরকে কড়িও বলা হয়ে থাকে)। আরও দেখেছি, সা এবং পা এই দুটি স্বরের কোনও বিকৃত রূপ নেই। দেখেছি হারমোনিয়মে কি ভাবে এই বারোটি স্বর সাজান আছে। শুদ্ধ সাতটি স্বর হারমোনিয়মের আট নম্বর (৮) সাদা রীড থেকে আরম্ভ হয়ে চৌদ্দ (১৪) নম্বর সাদা রীডে, অর্থাত্ পর পর সাতটি সাদা রীডে অবস্থান করছে। আর সব কটি কোমল আর তীব্র স্বর সাদা রীডগুলির মাঝে মাঝে যে কালো রীডগুলি আছে তাতে রয়েছে। এখন থেকে আমরা সাদা আর কালো দুই রকম রীড নিয়েই চলব। আমাদের সপ্তক (মুদারা) আরম্ভ হচ্ছে বাঁ দিক থেকে ১৩ নম্বর রীডে আর শেষ হচ্ছে ২৪ নম্বর রীডে। লিপিচিহ্ন দিয়ে যদি লিখি, তা হলে হারমোনিয়মের তেরো (১৩) নম্বর রীডকে স (উচ্চারণে সা) ধরে বারোটি স্বর (শুদ্ধ ও বিকৃত মিলিয়ে) এই ভাবে অবস্থান করছে পর পর:

রীড ১৩ ১৪ ১৫ ১৬ ১৭ ১৮ ১৯ ২০ ২১ ২২ ২৩ ২৪ ২৫
স্বর স ঋ র জ্ঞ গ ম হ্ম প দ ধ ণ ন স*

এইবার আমরা রাগসঙ্গীতের জগতে প্রবেশ করছি, আমাদের সাথী বারোটি স্বর। বারোটি স্বরের পাঁচ বা তার বেশী স্বরের সমাহারে একটি রাগের সৃষ্টি। এই রকম ভিন্ন ভিন্ন স্বর সমাহারে শতাধিক রাগের সৃষ্টি। এখানে আমরা হিন্দুস্তানী বা উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের কথা বললাম। দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্ণাটকি সঙ্গীত ধরলে রাগের সংখ্যা আরও অনেক দাঁড়ায়। যে কোনও রাগই হোক না কেন এই কটি ব্যাপার ধ্রুব:

অন্তত পাঁচটি স্বর ব্যবহার হবে
ষড়জ (স) লাগবেই
ষড়জ ছাড়া আর চারটি স্বরের মধ্যে পঞ্চম (প) অথবা মধ্যম (ম অথবা হ্ম) ব্যাবহার হবে
আমরা উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের জগতেই ঘুরব। কিছু রাগের পরিচয় নেব; প্রথমেই সূক্ষ্ম বিশেষত্বের ভিতর ঢুকব না, একটু নিরীক্ষা করব কয়েকটি রাগের (যাকে আজকের দিনের চলতি ভাষায় বলে মেপে নেওয়া); দেখব কোন কোন স্বর লাগছে। আর দুটি বা তিনটি গানের উদাহরণ দেব; যতদূর সম্ভব হয় সাধারণ ভাবে পরিচিত গান থেকে; যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, রজনীকান্তের গান প্রভৃতি, আর অবশ্যই ছায়াছবির গান (কারণ ছায়াছবিতে প্রচূর রাগাশ্রয়ী গানের ব্যবহার)। আমার উদ্দেশ্য আপনাদের নিরুত্সাহিত না করে ধীরে ধীরে আপনাদের রাগগুলির সঙ্গে প্রথমে আলাপ করিয়ে দেওয়া। এর জন্য প্রয়োজন রাগাশ্রয়ী গান শোনা। সঙ্গীতে কিছু দখল থাকলে ভালোই; তবে শোনা আর বারবার শোনার কোনও বিকল্প নেই। কান তৈরী হবে শুনেই। ভারতীয় সঙ্গীত শ্রুতির উপরেই দাঁড়িয়ে। (নীচের কিছু কিছু গানে লিঙ্ক দেওয়া আছে, সেগুলিতে ক্লিক করলে গানগুলো শুনতে পারবেন।)


রাগ দরবারী কানাড়া:

স্বর ব্যবহার : স র জ্ঞ ম প দ ণ

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীত - 'বিদায় করেছ যারে নয়ন জলে';
এ ছাড়া ছায়াছবির মধ্যে আছে--'মেরে হুজুর' ছবিতে মান্না দে- র 'ঝনক ঝনক তোরি বাজে পায়লিয়া'; এবং অতি অবশ্যই মহম্মদ রফী- র গাওয়া 'ও দুনিয়া কে রখওয়ালে' ছবির নাম 'বৈজু বাওরা'। এ ছাড়া জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী- র 'আজি নিঝুম রাতে কে'।


রাগ ভৈরব:

স্বর ব্যবহার: স ঋ গ ম প দ ন

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'মন জাগো মঙ্গললোকে', এবং‘স্বপন যদি ভাঙিলে’ 'শুভ্র আসনে বিরাজো'
জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী- র গাওয়া 'বিগলিত করুণারূপিণী গঙ্গে'।


রাগ ভৈরবী:

স্বর ব্যবহার: স ঋ জ্ঞ ম প দ ণ

উদাহরণ: একটি বহু প্রচলিত রাগ। অনেকেই শুনে থাকবেন 'বাবুল মোরা নৈহর ছুটোহি যায়', 'বাজুবন্ধ খুলে যায়', 'মত জা মত জা মত জা যোগী' প্রভৃতি গান।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে আছে 'অন্তর মম বিকশিত করো', 'আনন্দ তুমি স্বামী', ' কেন যামিনী না যেতে জাগালে না' প্রভৃতি (রবীন্দ্রনাথ প্রচুর গান রচনা করেছেন এই রাগে)। আর আছে নিধু বাবুর রচিত 'বিধি দিল যদি বিচ্ছেদ যাতনা' আর অতি অবশ্যই মান্না দে- র গাওয়া 'ফুল গেন্দুয়া না মারো', (ছবির নাম 'দুজ কে চাঁদ' )

রাগ বিহাগ:

স্বর ব্যবহার স র গ ম হ্ম প ধ ন

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীত - 'তিমির বিভাবরী কাটে কেমনে', 'জাগে নাথ জ্যোত্স্নারাতে', 'মহারাজ একি সাজে এলে', 'কে যায় অমৃতধাম যাত্রী' প্রভৃতি
একটি পুরান দিনের গান আছে 'কেন এতো ব্যথা দাও'।


রাগ বাগেশ্রী:

স্বর ব্যবহার স র জ্ঞ ম প ধ ণ

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীত - 'নিশীথ শয়নে ভেবে রাখি মনে', 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি' প্রভৃতি
স্বামী বিবেকানন্দের রচনা 'নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি' ও নজরুলগীতি 'আর লুকাবি কোথায় মা কালী'। এ ছাড়া একটি নজরুলগীতি আছে 'সংসারেরি দোলনাতে মা'।


রাগ য়মন (বাঙ্গলা ভাষায় ইমন বলা হয়):

স্বর ব্যবহার স র গ হ্ম প ধ ন

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীত - 'এ মোহ আবরণ', 'এ মণিহার আমায়', 'এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে'প্রভৃতি।
মান্না দে ও আশা ভোঁসলের একটি গান আছে 'রে মন সুরমে গা' ছবির নাম 'লাল পত্থর'।


রাগ দেস (বাঙ্গলা ভাষায় দেশ বলা হয়):

স্বর ব্যবহার স র গ ম প ধ ণ ন

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীত 'এসো শ্যামল সুন্দর', 'এ ভারতে রাখো' প্রভৃতি।
গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়- র গাওয়া 'পথ ছাড়ো ওগো শ্যাম'; নজরুলগীতি 'বলরে জবা বল'এবং 'পিয়া পিয়া পিয়া পাপিয়া পুকারে' ।


রাগ ভাটিয়ার:

স্বর ব্যবহার স ঋ গ ম হ্ম প ধ ন

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীত 'হৃদয় নন্দন বনে'
বানী কোনার- র গাওয়া, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের রচনা, একটি গান আছে 'আজি দুখ নিশি ভোর' । এ ছাড়া মান্না দে- র গাওয়া গান 'এ কি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়'।


রাগ পূর্বী (বাঙ্গলা ভাষায় পূরবী বলা হয়):

স্বর ব্যবহার স ঋ গ ম হ্ম প দ ন

উদাহরণ: রবীন্দ্রসঙ্গীত 'নিভৃত প্রাণের দেবতা',
'আজি এ আনন্দ সন্ধ্যা' এবং 'অশ্রুনদীর সুদূর পারে'
ধনঞ্জয় ভট্টচার্য- র গাওয়া 'দিবা অবসান হোলো' (কথা- অমৃতলাল গুপ্ত)।


রাগ তোড়ী (মিঞা কি তোড়ী- ও বলা হয়):

স্বর ব্যবহার স ঋ জ্ঞ হ্ম প দ ন

উদাহরণ: মান্না দের গাওয়া 'রাত জাগ দুটি চোখ' ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া 'কোথা যেন ভাসে'। রবীন্দ্রসঙ্গীত 'রজনীর শেষ তারা'

একঘেয়ে লাগছে বোধ হয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ ঠিকই বলেছেন, 'পাঁজিতে লেখে বিশ আড়া জল, কিন্তু টিপলে এক ফোঁটাও বেরোয় না'। তার চেয়ে এইখানে ইতি দিয়ে গানগুলি সংগ্রহ করুন আর বার বার শুনুন। আপনার কান সুরে বসে যাবে। তবে একটা কথা বলে রাখি- যে গানগুলি উল্লেখ করেছি, সেগুলি থেকে রাগগুলির আভাস পাওয়া যাবে; একেবারে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এদের বোধ হয় বলা যাবে না। সব সঙ্গীতকারই রাগাশ্রয়ী গানে বৈচিত্র আনতে রাগ নির্দিষ্ট স্বরের গণ্ডী পেরোন, শাস্ত্রে বলা নেই এমন স্বরও লাগান, তবে রাগের মর্যাদা রেখেই।এমনকি প্রতিষ্ঠিত খেয়াল গায়কেরাও ঠুংরী, দাদরা ইত্যাদি পরিবেশনের সময় সুরের হের ফের কিছুটা করেন এবং তাতে গানের মাধুর্য বাড়েই ।

পরের অংশের জন্য দেখুন: রাগ সঙ্গীত প্রবেশিকা ()

পুষ্পেন্দু মুখোপাধ্যায়

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।