প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

রাগ সঙ্গীত প্রবেশিকা ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪

আগের সংখ্যায় ( রাগসঙ্গীত প্রবেশিকা ৭) দুটি ত্রুটি থেকে গেছে।
গোরখকল্যাণ রাগের অবরোহণটি হবে স* ণ ধ প ম র ণ# ধ# স।
খাম্বাজ রাগের চলনের সঠিক রূপটি হবে গ ম প ধ ন স* ন স* ধ স* ণ ধ প ম গ; গ ম গ র স
এই দুটি ভুলের জন্য লেখক লজ্জিত।

রাগসঙ্গীতোদ্যানে ঢোকার আগে আরও একটি বিষয় জানিয়ে রাখি। ভারতীয় সঙ্গীত, বিশেষ করে রাগসঙ্গীত, শ্রুতিভিত্তিক। গুরু শিষ্য পরম্পরায় চালিত এবং বাহিত হয়। কাজেই লিখে জানানর চেয়ে নমুনা শোনাতে পারলে অনেক বেশী ফলপ্রসূ হবে জেনে আমি কিছু প্রচলিত গানের, যার অনেকগুলিই সাধারণ শ্রোতারও শুনে থাকার কথা, উদাহরণ দিয়েছি। এইগুলি বিভিন্ন Internet Website থেকে সংগৃহিত। এ ছাড়াও প্রামাণ্য আরোহণ, অবরোহণ তথা চলন (পকড়) সংগ্রহ করতে হয়েছে। কতকগুলি এই রকম উত্‍‌সের কথা সবিনয়ে সকৃতজ্ঞ উল্লেখ না করলে শান্তি নেই। বিশেষ করে সেই সব উত্স যারা শুধু তথ্য ও তত্ব বিতরণের জন্য কাজটি করেছে।
ইণ্ডিয়া টোব্যাকো সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমি-- রাগগুলির আরোহণ, অবরোহণ এবং চলনের জন্য।
বন্ধুবর সুমিত রায় (অবশ্যই বেশ কয়েকটি গানের জন্য, তার চেয়েও বড় কথা আমাকে সদা উত্সাহ দিয়ে যাচ্ছে, এবং অপাত্রে ভরসা রেখে যাচ্ছে); বন্ধুবর গৌতম চৌধুরী (আমাকে সলিল চৌধুরী সৃষ্ট গানের ভাণ্ডারের খবর দিয়েছেন); সাউথ এসিয়া উইমেনস ফোরাম, বিশেষ করে সুধী রাজন পরিকর (অসাধারণ ভাণ্ডার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপরে)।

স্থায়ীর স্থায়িত্ব:

উদাহরণ সমেত রাগ পরিচিতিতে ফিরে যাবার আগে আরও একটি কথা বলে রাখি। একটি গান কি রাগের উপরে রচিত, তা চেনার উপায় কি। পুরো দস্তুর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত (অর্থাত্ খেয়াল, ধ্রুপদ, তড়ানা ইত্যাদি), এমন কি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মধ্যে যেগুলিকে লঘু পর্যায়ের বলে ধরা হয় (যথা ঠুমরি, দাদরা, কাজরী, গজল প্রভৃতি) এই সব রচনায় রাগটি আগে থেকে নিদ্র্দিষ্ট করে দেওয়া থাকে; তা সে সঙ্গীত সভায় ঘোষণা করেই হোক বা রেকর্ড সঙ্গীতের কভারেই হোক। সাধারণ জনপ্রিয় গানে (যেমন আমি উদাহরণ দিয়ে যাচ্ছি) রাগটির পরিচিতি নিতে হয় গানটির স্থায়ী স্তবক থেকে। স্থায়ী (অর্থাত্ প্রথম স্তবকটি) অংশে রাগটির রূপ ধরা থাকে। এই কারণে দেখবেন যে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশনের সময়ে শিল্পী ঘুরে ঘুরে স্থায়ীতে ফিরে আসছেন। এই তত্বের কচকচিতে এখন বেশী যাব না। তবে ভবিষ্যতে আরও একটু বিস্তৃত ভাবে বলার চেষ্টা করব, যদি আমার এলেমে কুলায়।

মুলতানি, মিঞা কি তোড়ি:

গত দুই কিস্তি রাতের রাগে ঘুরেছি। এবার একটু কান বদলাবার ইচ্ছে। রাগসঙ্গীত প্রবেশিকা (৩) পর্যায়ে দরবারী কাণাড়া ও আড়াণা এই দুটি রাগ, যে দুটি কি না একই স্বর সমষ্টির উপর গঠিত, কি রকম ভিন্ন শোনায় দেখিয়েছিলাম। এখন আরও দুটি রাগ নেব - মুলতানি (মুলতান- ও বলা হয়ে থাকে) ও মিঞা কি তোড়ি (সাধারণ ভাবে তোড়ি বলা হয়ে থাকে) যা কি না একই স্বর সমষ্টির ভিত্তিতে গঠিত। স্বরগুলি হল স ঋ জ্ঞ হ্ম প দ ন। কিন্তু শুনে দেখুন কত তফাত্। প্রথমেই কয়েকটি গান শুনুন-

মুলতানি

রবীন্দ্রসঙ্গীত- ' যাবার বেলায় শেষ কথাটি যাও বলে'; ' নাই রস নাই'।
বিষ্ণুপুর ঘরাণার সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায় (ইনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন) গীত একটি ধ্রুপদ শুনুন 'শিব শংকর '।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম নরেন-কে (যিনি উত্তরজীবনে স্বামী বিবেকানন্দ হয়েছিলেন) দেখেন একটি উপাসনা সভায়, খুব সম্ভব ঠাকুরের ভক্ত রাম দত্তের বাড়ীতে। সেখানে নরেন গেয়েছিলেন 'যাবে কী হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে'। মুলতানি রাগে গাঁথা এই গানটি রচনা করেছেন বেচারাম চট্টোপধ্যায়। গানটি শুনুন দ্বিজেন মুখোপাধ্যাযের কণ্ঠে। সব শেষে শুনুন উস্তাদ আমীর খানের গাওয়া 'দয়া করো এ গিরিধর গোপাল ' শবাব (১৯৫৪) ছায়াছবিতে।

মিঞা কি তোড়ি

মান্না দের গাওয়া 'রাত জাগা দুটি চোখ';
মান্না দের- ই গাওয়া 'জাগো রে প্রভাত আয়া' সন্ত জ্ঞানেশ্বর (১৯৬৪) ছায়াছবিতে।
লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া একটি গান 'খুদা এ বরতর' তাজমহল (১৯৬৩) ছায়াছবিতে।

শুনলেন ত, কত তফাত্। এমন কি রাগ দুটি পরিবেশনের সময় ও ভিন্ন: মুলতানের ক্ষেত্রে গোধূলি আর মিঞা কি তোড়ির ক্ষেত্রে সকাল আটটা থেকে দশটার মধ্যে। এবারে আসি স্বর ব্যবহারের দিকে যদিও আগেই বলেছি স্বর সমষ্টি একই:

আরও খেয়াল করবেন, পঞ্চম ( প )স্বরটির ব্যবহার; মিঞা কি তোড়ির ক্ষেত্রে কিছুটা যেন নিস্প্রভ, পঞ্চম ছুঁয়েই নেমে আসছে আরোহণ করছে না। কিন্তু মুলতান রাগের ক্ষেত্রে আরোহণ ও অবরোহণ দুই সময়েই লাগছে।

তরীতে পা দিই নি:

আরও একটি রাগ আছে গুর্জরী তোড়ি, উপরের রাগ দুটির সম গোত্রের ( রাগের গোত্র, যাকে সঙ্গীত ব্যাকরণে ঠাট বলা হয়; এই গোত্র বা ঠাটের ব্যাপারে পরে কিছু আলোচনা করা যাবে)। তবে ঐ যে বললাম উপরে, তোড়িতে প দিই নি। আরোহণ বা অবরোহণ কোথাও পঞ্চম লাগে না। কাঠামো দাঁড়ালো
স্বর লাগছে স ঋ জ্ঞ হ্ম দ ন
আরোহণের সময় স ঋ জ্ঞ হ্ম দ ন স*
অবরোহণের সময় স* ন দ হ্ম জ্ঞ ঋ ঋ স
চলন স ঋ জ্ঞ ঋ, ঋ জ্ঞ দ ঋ জ্ঞ ঋ স
পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তীর গাওয়া একটি গান আছে ' ফুলে ফুলে কী কথা ';
লতা মঙ্গেশকরেরই গাওয়া একটি গান 'যা রে যা পথিকবা'গানের কথা ও মূল সুর প্রসিদ্ধ সদারঙ্গ- র রচনা (ব্যাকরণে বন্দিশ বলে)। গানটি হিন্দি ছায়াছবি লেকিন(১৯৯১)- এ আছে।

গুর্জরী তোড়ি রাগটিকে শুদ্ধ তোড়িও বলা হয়ে থাকে। তোড়ি নামে অনেক ভিন্ন ভিন্ন রাগ আছে যেমন উপরে লেখা ছাড়াও ভূপালী তোড়ি, বাহাদুরি তোড়ি, আশাবরী তোড়ি ( কোমল ঋষভ আশাবরীও বলা হয়ে থাকে)। কথিত আছে, বিখ্যাত মিঞা তানসেনের আগে অন্তত দশটি তোড়ির প্রচলন ছিল। একবার কোনও এক কারণে ঋণ নেওয়ার জন্য তানসেন মহাজনের কাছে সব কটি তোড়ি বাঁধা রাখেন, অর্থাত্ রাগগুলি পরিবেশনের অধিকার হারান। পরে সম্রাট আকবরের দরবারে তানসেনের বিরুদ্ধ গোষ্ঠী সম্রাটের দরবারে তানসেনকে তোড়ি রাগ পরিবেশন করতে বলেন, হেয় করার জন্য। তানসেন সেখানেই তোড়ির একটি নতুন রূপ রচনা করে পরিবেশন করেন যা পরে মিঞা কি তোড়ি বা তোড়ি নামে পরিচিত হয়েছে তানসেনের সম্মানে।

এবারে আরও দুটি রাগ নেব যাদের স্বরসমষ্টি এক - স ঋ গ ম হ্ম প দ এবং ন।
রাগ দুটি হল পূরবী ( হিন্দীতে পূর্বী বলা হয়) ও বসন্ত
আগে রাগ দুটির স্বর ব্যবহার বিশ্লেষণ করে নেওয়া যাক।

পূরবীর ক্ষেত্রে খেয়াল করবেন উদারার স্বাভাবিক নিষাদ ( ন# ) থেকে উঠছে। আবার বসন্তের ক্ষেত্রে কোমল ধৈবত ( দ ) থেকে উঠছে। স্বাভাবিক মধ্যম ( ম ) ছুঁলে স্বর নীচের দিকে যাচ্ছে, দুটি রাগের ক্ষেত্রেই। স্বাভাবিক মধ্যম যেন একটু দুর্বল, টেকে না। পরিবেশনের সময়ের দিক থেকে পূরবী হচ্ছে গোধূলির রাগ (অর্থাত্ বিকেল পাঁচটা থেকে ছটা) আর বসন্ত হল সন্ধ্যাশেষের আর রাত্রি শুরুর রাগ অর্থাত্ রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে।
এবার কয়েকটি গান শোনা যাক।

পূরবী:

আগেই বলে রাখি রবীন্দ্রনাথ অল্পবিস্তর স্বাভাবিক ধৈবত ( ধ ) ব্যবহার করেছেন। গানের মাধুর্য বা রাগটির মেজাজ তাতে নষ্ট হয় নি। আমরা এটাকে ঋষির প্রয়োগ বলে ধরে নিতে পারি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে এই গানগুলি শুনবেন।
' তুমি ত সেই যাবেই চলে', “ বীণা বাজাও হে;
আর আছে মীরা (১৯৭৯) ছায়াছবিতে বাণী জয়রামের গাওয়া 'করুণ শুনো মোরি'

বসন্ত:

প্রথমে শুনুন চন্দ্রমুখী ছায়াছবিতে মান্না দের গাওয়া 'মন ভাবন সঙ্গীত';
এবারে শুনুন হিন্দী বসন্তবাহার (১৯৫৬) ছায়াছবিতে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গাওয়া 'কেতকি গুলাব জুহি'

পরজ:

পরজ আর একটি রাগ যাতে একই স্বর ব্যবহার হচ্ছে, তবে রাগটির খুব বেশী প্রচলন নেই।
আরোহণের সময়: ন# স গ হ্ম দ ন স*
অবরোহণ: স* ন দ প গ ম গ হ্ম গ ঋ স
চলন: হ্ম দ স* ন দ প গ ম গ
রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে আছে 'গভীর রজনী নামিল';
'ডাকো মোরে আজি' এ গানটিও পরজে, তবে এখনই শোনাতে পারছি না।
যাঁরা রাণী রাসমণি ছবিটি দেখেছেন, ১৯৫৫ সালে ছবিটি এসেছিল, তাঁরা হয়ত ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গাওয়া 'গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি' গানটির কথা মনে করতে পারবেন। কিছুটা একই সুরে পান্নালাল ভট্টাচার্যর গাওয়া এই গানটি আছে 'ও মা কালী চিরকালই'। দুটি গানেই একটু স্বাভাবিক ধৈবতের ব্যবহার আছে।

দুবার সঙ্গীত রচনাতে শাস্ত্রের গণ্ডি লঙঘন করার কথা উল্লেখ করেছি। এই ব্যাপারে একটি শোনা কথা বলব। এখনকার এক বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কটাক্ষ করে বলেছিলেন যে 'গুরুদেব ত বিহাগে কোমল গান্ধার লাগিয়েছেন'। মজার ব্যাপার হল এই স্বর বিচ্যুতি সত্বেও রাগটিকে বিহাগ বলে চিনে নিতে শিল্পীর কোনও অসুবিধা বা ভুল হয় নি।
তবে এখন ঠিক করেছি যতদূর সম্ভব উদাহরনের মধ্যে কিছু প্রসিদ্ধ উচ্চাঙ্গ কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীর গাওয়া গানও আপনাদের ভেট দেব। উপরের ছটি রাগের মধ্যে মুলতানি ও বসন্ত রাগদুটির উদাহরনে উপরেই দেওয়া হয়ে গিয়েছে যথাক্রমে উস্তাদ আমীর খন ও পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর কণ্ঠে। বাকি চারটি রাগ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে শুনুন:
মিঞা কি তোড়ী: উস্তাদ সালামত আলি খানের কণ্ঠে
গুর্জরী তোড়ী: পন্ডিত যশোরাজের কন্ঠে ; তবে উপরে দেওয়া তারাপদ চক্রবর্তীর গাওয়া 'ফুলে ফুলে কী কথা' গানটিও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর পরিবেশনের মধ্যে ধরতে হবে।
পুরবী: উস্তাদ ফৈযজ খানের কণ্ঠে
পরজ: উস্তাদ বড়ে গুলাম আলীর কন্ঠে

বিদায়সন্ধ্যা আসিল ঐ, নমষ্কার।

(চলবে)

পুষ্পেন্দু মুখোপাধ্যায়

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।