প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

এপ্রিল ১৫, ২০১৫

 

পুরনো অ্যালবাম

কেয়া মুখোপাধ্যায়


ক’দিন আগে অফিসে গিয়ে দেখি আমার ডেস্কে একটা সবুজ পটে রাখা পার্পল অর্কিড। দুটো স্টেমের ওপর অনেকগুলো ফুল। ভীষণ উজ্জ্বল, এলিগ্যান্ট। সঙ্গে অর্কিডের দেখভাল করার ছোট্ট বুকলেট। দুই সহকর্মীর তরফে জন্মদিনের উপহার। পার্পল অর্কিডগুলো দেখতে দেখতে ফিল্মের মন্তাজ শটের মত পর পর অনেক টুকরো ছবি ভেসে এল মনে। কয়েকবছর আগেকার।

মাস্টার্স-এর পর আমরা তখন রিসার্চ স্কলার। বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োটেকনোলজি- এরকম আলাদা আলাদা সব বিষয়ে মাস্টার্স করে আর তারপর নানা পরীক্ষা দিয়ে টিয়ে একই ইন্সটিট্যুটে মোটামুটি একই সময়ে রিসার্চ শুরু করেছিলাম আমরা কয়েকজন। বড় ইন্সটিট্যুট, অনেক ল্যাব। বেসিক আর ক্লিনিক্যাল রিসার্চের নামী দামী কিছু বিজ্ঞানী আর ডাক্তার সেখানে। তবে সেসব নিয়ে আমাদের খুব একটা মাথা ব্যাথা ছিল না। সিনিয়র, জুনিয়র রিসার্চ স্কলার মিলিয়ে দারুণ আড্ডা, হাহা হিহি, একসঙ্গে চা, চপ থেকে ফুচকা, জন্মদিনে দল বেঁধে খেতে যাওয়া, মাঝে মধ্যে সিনেমা, টুকটাক বেড়ানো- দিব্য চলছিল এইসব। এর বাইরেও আরো কিছু ছিল। শীতের বিকেলের নরম আলোয় নীচের উঠোনে ব্যাডমিন্টন আর লেক-এ ক্রিকেট, দোলের আগের সন্ধ্যেয় ক্যান্টিনে রঙিন ফাগের ইতিউতি ওড়া, টেবিল চাপড়ে তুমুল গান, কখনো সখনো আবিরের অনুরাগে আর হঠাৎ ছোঁয়ায় ‘হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়’, কোন দুজনের একান্তে একটু নিরালায় কথা বলা ইত্যাদি ইত্যাদি- ওই যেমন হয় আর কি।

ও হ্যাঁ- সঙ্গে গবেষণাও চলছিল জমিয়ে। উঁহু, একটু ভুল হল। আসলে অন্য সবকিছু চলছিল জমিয়ে আর গবেষণা মানে তো ৯৫% ফেলিওর। বড় বড় মানুষরা সেই কবেই বলে গেছেন। সব গবেষণা, বিশেষ করে মেডিক্যাল রিসার্চ গড়গড়িয়ে চললে তো আর দুঃখ ছিল না। তখন কি আর এত রোগ থাকত, না এত অসুস্থ মানুষ? তবে এটাও ঠিক ওই মাত্র ৫% সাফল্যের মধ্যেও দুর্দান্ত ভাল কাজ কিছু অবশ্যই হত। এখানে ওখানে সেসব কিছু সমাদরও পেত।

আমরা ভাল কিছু করলে সবচেয়ে খুশি হতেন আমাদের মেন্টর, আমাদের স্যর। এই মেন্টর কথাটার ঠিক পছন্দসই বাংলা পেলাম না। আবার রিসার্চ গাইড বললেও তাঁকে কিছুই বোঝা যাবে না। যাঁরা তাঁর কাছে কয়েকবছর কাটিয়েছি, শুধু তাঁরাই জানি তিনি ঠিক কী। গবেষণার কাজই নয়, আমাদের জীবনেও তাঁর ভূমিকা অসামান্য। সর্ব অর্থে একজন পথ প্রদর্শক, বন্ধুও। খুব ব্যস্ত মানুষ। সকালে আমাদের সঙ্গে কথা হল আর সন্ধ্যেয় হয়তো অন্য দেশে। কিন্তু না থেকেও প্রতিটি ছাত্রের সুবিধে, অসুবিধে, কোথায় কাজ আটকে গেল, কী করা যাবে- খুঁটিনাটি সব খোঁজ রাখতেন। রোজ দেখা না হলেও ইমেলে যোগাযোগ হত। একটা ঘটনা বললে একটু আন্দাজ পাওয়া যাবে। সবুজ লন ঘিরে বাঁধানো জায়গার দুপাশে গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা। সেদিন কী একটা কারণে অনিন্দ্য তাড়াতাড়ি কাটতে চায়, মানে দুপুর নাগাদ। স্যর এসেছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না। স্যরের অফিসে ঢুকে দেখা যায়, তবে ভাল দেখায় না। তাছাড়াও বোঝার একটা উপায় আছে। চেনা নীল গাড়িটা পার্ক করা আছে কিনা দেখতে হবে শুধু। দোতলার ল্যাবের কাচের জানলা দিয়ে কান্নিক মেরে অনিন্দ্য খোঁজার চেষ্টা করছে ডব্লিউ বি এন... (হ্যাঁ, নম্বর প্লেট মুখস্থ ছিল আমাদের) আছে কিনা, এমন সময় কাঁধে মৃদু টোকা। চমকে পেছন ফিরতেই স্যর হেসে বললেন,
“আয়াম হিয়ার। গাড়িটা আনিনি। কি, একটু আগে চলে যেতে হবে আজ, তাই তো?”
“হ্যাঁ। মানে না, না, কোথাও যেতে হবে না...মানে...”
“ইটস ওকে। যখন যেতে হবে চলে যেও। কাজ বাকি থাকলে টেল এনি অফ ইয়োর ফ্রেন্ডস টু কমপ্লিট।”
এখনো আমরা ভাবি, স্যর বুঝতেন কী করে! স্যরের ফিলোজফি ছিল জোর করে ঘন্টা ধরে কাউকে আটকে রেখে যা কাজ হবে, তার থেকে সে মনের খুশিতে যেটুকু করবে- সেটা অনেক দামী আর জরুরি।

সেবার আমাদের পাঁচ মক্কেলকে ডাকলেন স্যর। সৌরীশ, অনিন্দ্য, সুমনা, রিনি আর আমি। বললেন, কমাস পরে ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিয়ন অফ মাইক্রোবায়োলজিক্যাল সোসাইটির বিরাট কনফারেন্স। আমরা সবাই যেন একটা করে পেপারের অ্যাবস্ট্রাক্ট (সামারি) জমা দিই। স্যর ডাকলে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যে বা যারা যেত, তাদের থেকেও জানার আগ্রহ বেশি থাকত বাকিদের। সেবারে আবার পাঁচজনের তলব একসঙ্গে। তাই বাকিদের কৌতূহলের শেষ নেই। সেই দলের পান্ডা তনুশ্রীদি। বিশ্বভারতীর মাস্টার্স নিয়ে ভারি গর্ব তার, পা সবসময়ে মাটি থেকে দু ইঞ্চি ওপরে।  কলকাতা কি যাদবপুর থেকে পাশ করা আমাদের নেহাতই অর্বাচীন ভাবে, চায়ের দোকানে গিয়ে সিনিয়র জুনিয়র নির্বিশেষে যে কোন একটি ছেলের পাশে বেঞ্চিতে বসে তার কাঁধে কনুইয়ের ভর দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় একটার পর একটা রিঙ বানায় আর হিউম্যান জেনোম প্রোজেক্ট নিয়ে তার ফান্ডা ঝাড়ে। অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চায়ের দোকানের বৌদির দুধ-চা প্রায়ই উপচে পড়ে উনুনে।
এহেন তনুশ্রীদির সামনে পড়লাম বেরিয়েই।
“কনফারেন্সটা কোথায় রে?”
“প্যারিস।”
“অ্যাঁ! প্যারিস! তোদের এই সবকটাকে, মানে এই রাবণের গুষ্টিকে প্যারিস পাঠাবে নাকি? কেসটা কী?”
অনিন্দ্য খ্যা খ্যা করে হেসে বলল,
“তুমিও যেমন! পাগল নাকি! একি তিব্বত যাওয়া! কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হল।”
তনুশ্রীদি ভুরু কুঁচকে তাকাল। আমি বললুম,
“অ্যাবস্ট্রাক্ট জমা দেওয়া মানেই কি আর পেপার প্রেজেন্ট করা? আগে সিলেক্টেড হোক। আর তারপর স্যরই প্রেজেন্ট করবেন।”
তনুশ্রীদি ‘হুম’ বলে তখনকার মত চলে গেল আর অ্যাবস্ট্র্যাক্ট তৈরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমরা। কদিন পর দেখে টেখে দিয়ে স্যর বললেন,
“সবাই ওয়েবসাইটে গিয়ে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আপলোড করে ফ্যালো আর সেই সঙ্গে ট্র্যাভেল অ্যাওয়ার্ড ও অ্যাপ্লাই করে দাও।”
তা সেও করে দিলুম। সারা দুনিয়া থেকে কত্ত লোক অ্যাপ্লাই করবে। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া কি অতই সোজা!
সকালে ক্যান্টিনের চা আর বিকেলে চপ, পেঁয়াজি কি লেকের ফুচকা খেয়ে দিব্যি কেটে গেল মাস দুই। তারপর একদিন সন্ধ্যের মুখে দেখি একখানা ইমেল। “ইয়োয় অ্যাবস্ট্রাক্ট হ্যাজ বিন অ্যাক্সেপ্টেড ফর প্রেজেন্টেশন...” ইত্যাদি প্রভৃতি। দুজনের ওরাল প্রেজেন্টেশন আর বাকি তিনজনের পোস্টার। দুজন ট্র্যাভেল অ্যাওয়ার্ডও পেল। ট্র্যাভেল অ্যাওয়ার্ড –এ অবশ্য একজনের সব খরচ কুলোবে না। প্যারিস বলে কথা! পৃথিবীর সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ শহরগুলোর একটা। তাহলে?
স্যর বললেন, সবাই যাবে। পাঁচ জনই। জাপানের এক ফাউন্ডেশন, যাদের সঙ্গে কোলাবোরেশন চলছে, তারা দায়িত্ব নেবে। আমাদের পাঁচজনকে একটা বাজেট তৈরি করে দিতে হবে শুধু। এয়ারফেয়ার, হোটেল, আর প্রতিদিনের খরচের।

সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না! আমরা সবাই যাব? সব্বাই? পাঁচজনেই? তুমুল মজার হৈ হৈ দিন কাটাব একসঙ্গে? আর সেটাও কিনা প্যারিসে!!

(২)

“খুব বেশি দামি হোটেলে থাকার দরকার নেই।”
বাজেট করতে বসে প্রথমেই ঘোষণা করল সৌর।
“তার মানে? সস্তার হাবিজাবি হোটেলে থাকব নাকি? ইম্পসিবল! ভাল হোটেল ছাড়া থাকব না আমি। ব্যস।”
রিনি বলে দিল স্পষ্ট।
“ব্যস। তাহলে নিজেরা ঠিক কর তোমাদের হোটেল। আমি সাধারণ হোটেলেই সন্তুষ্ট। সেরকম হলে আমি নয় আলাদা থাকব আর যদি অনি আমার সঙ্গে থাকতে চায় তো ভাল। কিরে অনি -তুই কী চাস?”
অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে সৌর বলল।
কী একটা ক্যালকুলেশনে ডুবে ছিল অনি। হাঁকডাক শুনে মুখ তুলে বলল,
“আমি ধর্মেও আছি, জিরাফেও। একটা হলেই হল। আর হোটেল নিয়ে অত ভেবে কী হবে? প্যারিসে গিয়ে কি হোটেলের ঘরে ঢুকে বসে থাকব?”
“এই, ঠিক এই কথাটা এদের বোঝাবে কে?”
অনিকে সঙ্গে পেয়ে এবার গলার জোর বাড়ল সৌর-র।
সুমনা আর আমার দিকে ফিরে রিনি বলল,
“কিরে সেই থেকে আমিই তো বলে যাচ্ছি একা। তোরা কিছু বল! একটা স্টার-ওলা হোটেল ছাড়া কি থাকা যায় নাকি? ঠিক আছে, ফাইভ কি ফোর স্টার না হোক, অন্তত তিনটে স্টার?”
কেউ কিছু বলছে না! সবাইকে দেখে নিয়ে রিনি আবার বলল,
“আচ্ছা বাবা, নে- একটু কমিয়ে দিলাম। অ্যাট লিস্ট একটা টু স্টার হোটেল তো দেখবি, নাকি?”
সুমনা নির্বিকার, কিছু বলছে না। বলবেও না। আসলে সৌর হল সুমনার ব্যথা। তাই মনে মনে বিলক্ষণ রিনির দলে হলেও মুখ ফুটে সেটা কিছুতেই বলবে না সুমনা।
এইসব ঘটনাগুলো আমার আশেপাশেই ঘটছিল। দেখছিলাম, শুনছিলাম আবার শুনছিলাম না-ও। আমি তখন মনে মনে চলেই গেছি সেই ছবির দেশে, কবিতার দেশে। আগের রাতেই আবার পড়া শুরু করেছিলাম ভীষণ প্রিয় বইটা। কিছু ছবি, অসামান্য কিছু অনুবাদ কবিতা আর অন্তরঙ্গ লেখার শৈলীতে মুগ্ধ আমি ফরাসী দেশটা যে কতবার ঘুরে বেড়িয়েছি সুনীলের হাত ধরে এ বই পড়তে পড়তে! পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যার অন্তরাত্মায় ছবি আর কবিতা। কে যেন বলেছিলেন, প্রত্যেক শিল্পীর দুটো মাতৃভূমি। একটা তার নিজের দেশ, আর একটা ফ্রান্স। বইটার পাতায় পাতায় গোটা ফরাসী দেশটার শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সুনীল আমাকে। পড়তে পড়তে ভালবেসে ফেলেছি মার্গরিটকেও। সেই দেশের বিখ্যাত শহরটিতে যাবার এমন একটা অযাচিত সুযোগ যে হঠাৎ এসে আমার দরজায় কড়া নাড়বে ভাবিইনি কোনদিন!
ফরাসী ভাষা জানি না। টড হল আর মারী জোন্স-এর ইংরেজী অনুবাদে পড়েছি মাত্র একতিরিশ বছর বেঁচে থাকা সেই ফরাসী কবির ভালবাসার কবিতা-

“Virgin you respond splendidly
To the obscure verdict
With which my heart softly
Weights your heart
And if I am tormented
By your metamorphosis
It is because I must love
Your love before you.”

কিন্তু René Guy Cadou-র (রেনে গী কাদু) এই কবিতাকে ভালবেসেছি সুনীলের বাংলা অনুবাদ পড়ে-

“কুমারী, উত্তর দাও তুমি
যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার
আমার হৃদয় মৃদু ঝোঁকে
চাপ দেয় তোমার হৃদয়ে
যদি দেখি কখনো  তোমার
রূপান্তরে কোনো অস্থিরতা
তবে সেই অস্থিরতা এই :
তোমাকে প্রেমের আগে আমি
তোমার প্রেমকে ভালোবাসি।”

উফ! কি অসম্ভব প্রেমময় কবিতা!
“এই যে ম্যাডাম, আপনি কি এই জগতে আছেন? এইখানে বিরাজ করছেন না পারী শহরে চলে গেছেন ইতিমধ্যেই?”
সৌর-র কথায় আর টেবিল ঠোকার চোটে ছবি আর কবিতা থেকে আমি ধড়মড়িয়ে সটান বাস্তবে।
“হ্যাঁ, শুনছি তো। যা হোক ঠিক করে ফ্যাল না কিছু। একটা ডিসেন্ট হোটেল হলেই হল। আর এয়ারপোর্ট-এর কাছে কিংবা কনভেনশন সেন্টারের কাছে। রিভিঊ পড়ে দ্যাখ না বাবা একটু।”
এইসব বলে কোনরকমে কাটাতে চাইলাম। আসলে হোটেল নিয়ে আমারও তত মাথা ব্যথা ছিল না। দেখতে হবে শহরটাকে, হোটেলে তো থাকা শুধু  রাত্তিরটুকুর জন্যে। কিন্তু কাটানো গেল না। কারণ সৌর তখন হাত-মুখ নেড়ে আমাকে লেকচার দিতে শুরু করেছে।  আর তার যোগ্য স্যাঙাত অনি।
“শুনুন ম্যাডাম। ‘ডিসেন্ট’-টা খুব রিলেটিভ টার্ম, বুঝলেন কিনা? আমার কাছে যা ডিসেন্ট, তা আপনাদের কাছে- মানে এই নারীকূলের কাছে রীতিমত হতকুচ্ছিত মনে হতে পারে। তাই না? যেমন ধরুন, রিনি-র কাছে ডিসেন্ট মানে হল ফোর স্টার। কিছুতেই তার কমে উনি নামতে চাইছিলেন না। খুব কষ্টে সৃষ্টে এখন দুয়ে নেমেছেন। তাই আপনি এখন পারী শহর এর দিবাস্বপ্ন থেকে দয়া করে নেমে আসুন। এই ডেস্কটপ-এ বসে কিছু খুঁজে বের করুন। আমি ক্ষ্যামা দিলুম।”
আবার খোঁজ খোঁজ। তার মধ্যেই হঠাৎ অনি জিজ্ঞেস করে বসল,
“তুই যেন কটা স্টার চাস রিনি? গোটা তিনেকে চলবে?”
“পেয়েছিস? চালিয়ে নেব তাতেই।”
“হুম। ফ্যান্সি মার্কেটের কাছে পাওয়া যায়। চমৎকার দেখতে। কিনে পকেটে করে নিয়ে যাব, হোটেলে তোর ঘরে লাগিয়ে দেব, ঝলমল করবে। সোনালী স্টার না রুপোলি- কী রঙের চাই শুধু বল!”
রীতিমত লেগ-পুলিং হচ্ছে বুঝে রিনি রেগে মেগে উঠে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তনুশ্রীদিকে ঢুকতে দেখে ফিরে এল আবার।
“হ্যাঃ! ক’ঘন্টাতে একটা আস্তানা ঠিক করতে পারল না, এরা যাবে প্যারিস!! লোকটারও (অর্থাৎ স্যর-এর আর কি) মাথা খারাপ। এদেরকে পাঠাচ্ছে! কম্পিউটারটা ছাড় এবার।”
শেষমেশ তনুশ্রীদির তাড়া খেয়ে একটা হোটেল ঠিক হল। ওই আর কি- টু স্টার। ইমেল টিমেল পাঠানো হয়ে গেল। তারপর টিকিট। আইটিসি-র ট্র্যাভেল এজেন্টকে স্যর-এর রেফারেন্স দিয়ে ভাল দামে টিকিটেরও খোঁজ পাওয়া গেল- তাই এয়ারওয়েজ-এর। বাকি রইল ভিসা, তার দায়িত্বও ট্র্যাভেল এজেন্ট-এর।
সব মিলিয়ে ধুন্ধুমার হিসেবপত্তর করে দুরন্ত একখান বাজেট নামিয়ে ফেললুম আমরা। আর কাউকে কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস না করে, কারোর সঙ্গে একবারও পরামর্শ না করে। এর ফল পরে হাতে নাতে পাওয়া যাবে। কিন্তু তখন আমরা এক একজন ফিন্যান্স এক্সপার্ট। অন্যদেরও বাজেট তৈরি করে দিতে পারি, হুঁ হুঁ বাবা! নেহাত কেউ ডাকছে না- এই যা দুঃখু!

(৩)

সবাই মিলে প্যারিস যাচ্ছি- এটা ঠিক হয়ে যাবার পর একটা মজা হল। দু’এক দিন ছাড়াই কোন না কোন কাজে বেরিয়ে পড়তাম দলবেঁধে পাঁচজনে। কোনদিন হয়তো প্যারিসে কিছু ফ্যাক্স করা দরকার। চললুম কাউন্সিল হাউস স্ট্রীট পোস্ট অফিসে। কোনদিন আবার হয়তো পার্ক স্ট্রীটের আইটিসি টাওয়ার-এ। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে। ট্র্যাভেল আওয়ার্ড পেলে রেজিস্ট্রেশন ফ্রী। কিন্তু বাকি তিনজনের রেজিস্ট্রেশন ফী লাগবে। সেটা ইউরো মুদ্রায় পাঠাতে হবে। তারজন্যে চললাম স্টেট ব্যাঙ্কের মেইন ব্র্যাঞ্চে কারেন্সি এক্সচেঞ্জ করতে। এইরকম লেগেই ছিল। ইতিমধ্যেই ট্র্যাভেল আওয়ার্ড বা ফাউন্ডেশন থেকে প্রায় সওয়া লাখ টাকা জমা পড়েছে আমাদের সকলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-এ। তাই নিজেদের বেশ বড়লোক বড়লোক লাগছে। সেটা সেলিব্রেট করতেই যেদিনই আমরা সদলবলে বাইরে বেরোই, কোন না কোন জায়গায় বেশ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হয়। এসপ্ল্যানেড চত্বরে গেলে নিজাম-এর রোল (নিজাম তখনো খোলা ছিল) খেতেই হবে, পার্ক স্ট্রীট মানে আরসালানের বিরিয়ানি এইরকম। আর নানা জায়গায় টুকটাক ফুটপাথের কিছু বিশেষ বিশেষ ডেলিকেসি তো আছেই। নাক-উঁচু লোকরা যতই তুচছ-তাচিছল্য করুন না কেন, কলকাতা শহরজোড়া ফুটপাথের নানা ওপেন-এয়ার রেস্তোরাঁ-র হরেক রকম খাবার না খেলে মজাটা সম্পূর্ণ হয় না কোনদিন। পেটপুরে ফুচকা খাওয়ার পরেও য়ার একটা মুচমুচে ‘ফাউ’ ফুচকা যেমন খুব আনন্দ দেয়, ঠিক সেইরকম। 

আমাদের ভিসা করার দায়িত্ব নিয়েছিল ট্র্যাভেল এজেন্সি। সেঙ্গেন (Schengen) ভিসা চালু হয়ে গেছে অনেকদিন।  পশ্চিম ইউরোপের দেশ লাক্সেমবুর্গ। সেদেশের দক্ষিণ পূর্ব দিকে যেখানে একটা তে-কোণা পয়েন্ট-এ জার্মানী আর ফ্রান্সের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তাদের সীমান্ত, সেইখানেই ছোট্ট মফস্বল শহর সেঙ্গেন। ওদেশের ভাষায় ‘কমিউন।’ এই সেঙ্গেন শহরেই ১৯৮৫ তে ইউরোপীয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি-র পাঁচটা দেশ প্রথম চুক্তি করেছিল, যাতে সেই দেশগুলোর কমন বর্ডারগুলোতে কড়া বর্ডার-কন্ট্রোল ব্যবস্থার অবসান হয় আর এক দেশের ভিসা নিয়ে পাশের দেশেও যাওয়া যায় অনায়াসে। সেই চুক্তিতে রূপ দিতে চালু হল সেঙ্গেন ভিসা। এখন সেঙ্গেন ভিসা থাকলে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের ২২ টি দেশ ছাড়াও ইউরোপের আইসল্যাণ্ড, নরওয়ে এবং সুইজারল্যাণ্ড- এর যে কোনো একটা দেশের ভিসা নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশ বেড়ানো যায় অনায়াসে। আমাদের ইচ্ছে ছিল সেঙ্গেন ভিসা করার। অথচ কলকাতায় ফ্রান্সের কোন কনস্যুলেট নেই, দিল্লি যেতে হবে। তাছাড়া দেখা গেল যে যাত্রায় ফ্রান্স ছাড়া অন্য কোন দেশে গিয়ে বেড়ানোর মত সময় পাওয়া মুশকিল। তাই ফ্রান্সের ভিসারই জন্যেই আবেদন করা হল। সুবিধে এই, সরাসরি উপস্থিত না হয়ে কাগজপত্র পাঠিয়ে দিলেই হবে। আমাদের অ্যাপ্লিকেশনে বিরাট কিছু গোলমাল না থাকলে, ভিসা এসে যাবে দিল্লি থেকে।

পার্ক স্ট্রীট-এ ট্র্যাভেল এজেন্সিতে ভিসার কাগজপত্র জমা দিয়ে আর তারপর জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করে সেদিন ইন্সটিট্যুটেই ফিরে যাবার কথা, কিন্তু পার্ক স্ট্রীট আর লোয়ার সারকুলার রোডের ক্রসিং এর কাছে আটকে পড়লাম বিচ্ছিরি ট্র্যাফিক জ্যামে। ট্যক্সিতে বসে ঘামছি আর বিরক্তিতে ঠিক কার মুন্ডুপাত করা যায় ভাবছি, এমন সময় জানলায় একটা মুখ উঁকি দিল, হাতে কয়েকগোছা গোলাপ।
“দিদিরা ফুল নেবেন?”
অমনি অনি ফুট কাটল,
“ঠিক বুঝেছে, দিদিদেরই ফুল গছানো যাবে। ”
রিনি হাত নেড়ে কাটিয়ে দিয়ে নাক কুঁচকে বলল,
“এগুলো কবর থেকে তুলে আনা।”
সুমনা প্রায় আঁতকে উঠল,
“অ্যাঁ!”
সৌর বলল,
“হতেও পারে। আমিও শুনেছি এরকম। কাছেই তো ক্রিশ্চিয়ান বেরিয়াল গ্রাউন্ড। মাইকেল মধুসূদনের সমাধি আছে।”

হঠাৎ খেয়াল চাপল আমার মাথায়! “চল না, দেখে আসি সমাধিটা। অনেকবার যাব ভেবেছি, যাওয়া হয়নি। উনিও তো শেষ জীবনের খানিকটা ফ্রান্সে কাটিয়েছেন।”
এসব ব্যাপারে আমাদের মতের অমিল হবার প্রশ্নই নেই। সিগন্যাল সবুজ হয়ে গাড়ি এগোতে যাচ্ছে, অনি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল,
“সাইড সাইড সাইড শিগগির! কবরস্থান-এ যাব।”
থতমত খেয়ে ড্রাইভার কোনরকমে একদিকে দাঁড় করাতেই নেমে পড়লাম আমরা। ড্রাইভার-এর গজগজ আর শেষ হয় না,
“তব বোলা থা সিআইটি রোড যানা হ্যায়, আব বোল রহে হো কবরস্থান! আজীব হ্যায়।”
এটা একেবারে নির্ভুল অ্যাসেসমেন্ট। আজীব তো বটেই আমরা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ওইসময়টাতে আর কেউ ছিল না ওখানে। সাদা পাথরের আবক্ষ মূর্তি। পাশে লেখা “বঙ্গের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।”

আর মূর্তির নীচে সেই বিখ্যাত লাইনগুলোঃ

“দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!...”

সৌন্দর্যে, নান্দনিকতায় অনন্য ফরাসী দেশ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আরাধ্য এক শহর। সে জন্ম দিয়েছে পৃথিবীর অসংখ্য শ্রেষ্ঠ শিল্পী-কবি-লেখককে। আপন করে নিয়ে বিখ্যাতও করেছে অনেককে। কিন্তু বঙ্গের মহাকবির জীবনে তা ঘটেনি। বিলেতে নিজেকে থিতু করতে পারেননি তিনি। অর্থকষ্টে পড়াশোনাও চালানো মুশকিল হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিলেন ফ্রান্সে গিয়ে বসবাস করলে কিছুটা সুরাহা হতে পারে। শেষে বিলেতের পড়াশোনায় ইতি টেনে চলে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের ভার্সাই-তে। কিন্তু সেখানে গিয়েও সমস্যার সমাধান হয়নি। নিদারুণ জীবনসংগ্রামে আড়াই বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ভার্সাইয়ের রু দ্য শাঁতিয়ের নামের রাস্তার ১২ নম্বর বাড়িতে থাকতেন তিনি।

ভার্সাইয়ের ১২ নম্বর রু দ্য শাঁতিয়ের

প্যারিস থেকে ভার্সাই যেতে সময় লাগে আধঘন্টা মত। একসময় এই ভার্সাই ছিল প্যারিসের রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। ফরাসি বিপ্লবের প্রবল অভিঘাতে ১৬শ’ লুইয়ের সময় রাজতন্ত্রের অবসান হয় ফ্রান্সে। রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে বিশাল রাজপ্রাসাদ আজও দাঁড়িয়ে আছে। এখন অবশ্য সেটা রূপান্তরিত হয়েছে মিউজিয়ামে। ঠিক হল, কনফারেন্স শেষ হবার পরের দিনই ভার্সাই যাওয়া হবে। মধুকবির বাসস্থান দেখার ইচ্ছে, সেই সঙ্গে ভার্সাইয়ের প্রাসাদ আর মিউজিয়ামও।

কত কিছু যে দেখার আছে! প্যারিস শহর জুড়ে অগুন্তি মিউজিয়াম, আর সবই বিখ্যাত। প্রতিদিনই আমাদের লিস্টে একটা দুটো করে নতুন জায়গার নাম যোগ হয়। ছবির দেশে কবিতার দেশে পড়তে পড়তে মনে ভেসে ওঠে সেইন নদীর ছবি। কবিতার শহরে, উৎকর্ষের শহরে সেইন নদীর ধারে সেই পথে হয়তো মার্গারিটকে নিয়ে হেঁটেছেন সুনীল আর কখনো ছন্দ-শব্দ দিয়ে, কখনো ছন্দহীন শব্দের অনুভূতিতে, আবার কখনো বা বিমূর্ত ইঙ্গিতময়তায় কবিতায় এঁকেছেন জীবনের ছবি।
সেইসব পথে হেঁটে আমরাও কি একবার জীবন ছুঁয়ে দেখব না?

“…কিসে মাতাল হবে, সুরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা
তোমার পছন্দ। কিন্তু মাতাল হও।
এবং যদি কোনো সময়ে, কোনো প্রাসাদের সিঁড়িতে,
কোনো খানা-খন্দের সবুজ ঘাসের মধ্যে, অথবা
তোমার নিজেরই ঘরের নিরানন্দ নির্জনতায় তুমি
জেগে ওঠো, তোমার নেশা যখন কমতে শুরু করেছে
অথবা কেটেই গেছে, জিজ্ঞেস করো বাতাসকে, ঢেউ,
নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি এমন সব কিছুকে, যারা ওড়ে,
গুঞ্জন করে, গড়ায়, গান গায়, কথা বলে, তাদের
জিজ্ঞেস করো, এখন কিসের সময়,তখন সেই
বাতাস, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি তোমাকে উত্তর
দেবে: ‘এখন মাতাল হবার সময়! সময়ের
নিপীড়িত ক্রীতদাস হবার বদলে মাতাল হও, একটুও
না থেমে। সুরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা তোমার
পছন্দ।”
(শার্ল ব্যোদলেয়ার (Charles Baudelaire) / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদ)

শার্ল ব্যোদলেয়ারের নিজের হাতে লেখা...

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।