ভ্রমণ কাহিনী
মে ৩০, ২০১৫
পুরনো অ্যালবাম
কেয়া মুখোপাধ্যায়
(৭)
(আগের অংশ)
“Remember Barbara
It rained all day on Brest that day
And you walked smiling
Flushed enraptured streaming-wet
In the rain
Remember Barbara
It rained all day on Brest that day
And I ran into you in Siam Street
You were smiling
And I smiled too
Remember Barbara
You whom I didn't know
You who didn't know me
Remember
Remember that day still
Don't forget…”
(Jacques Prevert/Lawrence Ferlinghetti-র অনুবাদ)
নীচে সূর্যাস্তের রঙ মেখে বয়ে চলা সেইন নদী। হঠাৎ বিকেলের নরম রোদ্দুর মেখে নামল ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। অবজার্ভেটরি ডেক-এ দাঁড়িয়ে সৌর খুব নীচু গলায় তখন উচ্চারণ করছিল জাঁক ফেভের-এর (Jacques Prévert) কবিতা,
“Rappelle-toi Barbara
Il pleuvait sans cesse sur Brest ce jour-là
Et tu marchais souriante
Épanouie ravie ruisselante
Sous la pluie…”
‘মনে পড়ে, বারবারা,
ব্রেস্ত শহরে সেদিন অঝোর ধারে বৃষ্টি
আর তুমি হেঁটে আসছিলে রাস্তা দিয়ে, হাসিমুখে...’
দুপুর পেরিয়ে বিকেলের নরম রোদ্দুর বৃষ্টি মেখে একটু একটু করে মিশে যাচ্ছিল গাঢ় নীলচে রঙা সন্ধেয়। কবিতাটা শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে হয়, কে এই বারবারা? না, এই বারবারা কবির কোন মানসপ্রেমিকা নন। এই বারবারা এক সাধারণ মেয়ে। ফ্রান্সের উপকূলের সুন্দর ছোট্ট শহর ব্রেস্ত-এ ছিল তার বাড়ি। আর ছিল এক তরুণ প্রেমিক। বৃষ্টি পড়ত শহরে, সাগরের ঢেউয়ের ওপর, বৃষ্টি ঝরত বারবারার খুশিতে উচ্ছল গাল আর চিবুক ছুঁয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজল। সেই তরুণকে যেতে হল যুদ্ধে। প্রথমে শহরটার দখল নিল মিত্রশক্তি। তারপর এল জার্মানবাহিনী। জার্মানদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে বুঝতে পেরে মিত্রশক্তি শহরটার যা কিছু ভাল, তার রাস্তাঘাট, ব্রিজ- সব উড়িয়ে দিল বোমা দিয়ে। যুদ্ধ বড় ভয়ানক। সুন্দর একটা শহর রাতারাতি যেন ভূতুড়ে, পরিত্যক্ত হয়ে গেল। প্রথমে যুদ্ধ সরিয়ে নিল বারবারার ভালবাসার মানুষকে, আর তারপর শেষ করে দিল তার প্রিয় শহরটাকে। যুদ্ধের পরে কিছুই কি আর রইল!
“Oh Barbara
It's rained all day on Brest today
As it was raining before
But it isn't the same anymore
And everything is wrecked
It's a rain of mourning terrible and desolate
Nor is it still a storm
Of iron and steel and blood
But simply clouds
That die like dogs
Dogs that disappear
In the downpour drowning Brest
And float away to rot
A long way off
A long long way from Brest
Of which there's nothing left.”
রূপসী পারীর রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। কাফেগুলোতে অগুন্তি পথচলতি মানুষের ভিড়। এ আলোর শহর। শিক্ষার বিকাশ আর জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে যেমন বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল এই শহর, তেমনি রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতি লাগানোর ক্ষেত্রেও পৃথিবীর প্রথম শহর প্যারিস। তাই এ শহর ‘City of light’।
সেইন নদী ছুঁয়ে আসা হাওয়া শিস দিয়ে যাচ্ছিল আইফেল টাওয়ারের লোহার স্তম্ভের ফাঁক দিয়ে বয়ে গিয়ে। দিনের বেলায় কাছ থেকে দেখা নেহাতই জবরজং চেহারার ধাতব টাওয়ার রাতের ঝলমলে আলোয় সেজে উঠে মোহিনী। তবু, অত আলোর মাঝে দাঁড়িয়েও, যুদ্ধ আর ধ্বংসের পরিণতির অনুভব-ঘেরা এই কবিতায় মন বড় বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।
শুধু যুদ্ধ নয়, দীর্ঘ সময় ধরে ইতিহাসের নানা পট পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আইফেল টাওয়ার। ফরাসি বিপ্লবের একশ’ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বমেলা। মেলায় প্রবেশের প্রধান ফটক হিসেবে তখনই তৈরি হয়েছিল আইফেল টাওয়ার। গুস্তাভ আইফেলের তৈরি এই টাওয়ারের কাঠামো দেখে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা বলেছিলেন, এর আয়ু বড়জোর বছর বিশেক। তার বেশি টিঁকবে না। তাই বিশ বছর পর এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে শহরবাসীরা চাইলে এটি ভেঙে ফেলতে পারবেন। বিশ বছর অবধি অপেক্ষা করতে হল না। বিতর্ক শুরু হল অনেক আগেই। আকাশছোঁয়া এই স্থাপত্যটিকে কিছুতেই পছন্দ করতে পারছিলেন না অনেকে। নামীদামি শিল্পী আর লেখকরা এর বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। তাঁরা ভেবেই পাচ্ছেন না যে এমন একটা “কুৎসিত” স্থাপত্য প্যারিসে থাকে কি করে! প্রখ্যাত ফরাসি লেখক মঁপাসা নাকি আইফেল টাওয়ারকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। বলতেন, এ তো এক বাতিল জঞ্জাল! অথচ রোজ তিনি খেতে আসতেন আইফেল টাওয়ারের রেস্তোরাঁতে। কারণ জানতে চাওয়ায় মঁপাসা বলেছিলেন,
‘প্যারিসে ওই একটি জায়গাই আছে যেখান থেকে আকাশে উদ্ধত মাথা তোলা আইফেল টাওয়ার দেখা যায় না, তাই রোজ আসি’।
চাপে পড়ে কর্তৃপক্ষ যখন প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন যে টাওয়ারটি ধংস করে ফেলা হবে, তখন গুস্তাভ আইফেল একটা বুদ্ধি বের করলেন। সুউচ্চ টাওয়ারটির সাহায্যে সম্ভব ছিল বাতাসের গতিবেগ আর আবহাওয়া নির্ণয় করা। গুস্তাভ আইফেল টাওয়ারটিকে আবহাওয়া-গবেষণাগারে পরিণত করলেন।
এরকম আরও নানা গল্প আছে আইফেল টাওয়ার নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্স অধিকার করলেন হিটলার। ক্ষুব্ধ ফরাসিরা টাওয়ারের লিফটের কেবল্ কেটে দেন, যাতে আইফেল টাওয়ারে চড়তে গেলে হিটলারকে অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হয়। আইফেল টাওয়ারে না চড়ে, শুধু সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেই সন্তুষ্ট থাকতে হল হিটলারকে। তাই ফরাসিরা বলেন, হিটলার ফ্রান্স জয় করলেও আইফেল টাওয়ার জয় করতে পারেননি। শোনা যায়, হিটলার নাকি আইফেল টাওয়ার-সহ গোটা প্যারিস শহর ধ্বংস করার নির্দেশ দেন়। তাঁকে তখন বোঝান় হয়েছিল যে টাওয়ারটা থাকলে যুদ্ধচলাকালীন রেডিও-বার্তা (radio transmission) পাঠাতে সুবিধা হবে। এ ভাবেই এভাবেই বার বার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে আইফেল টাওয়ার।
সুন্দরী পারীর প্রেমে পড়েননি এমন মানুষ বিরল। এ শহর ভালবাসার শহর, আজও পৃথিবীর সবচেয়ে রোম্যান্টিক শহর। এ শহরের ৭৫ মাইল অবধি দেখা যায় টাওয়ারের ওপরের অবজার্ভেটরি ডেক থেকে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে নেমে আসার আগে নিরুচ্চারে বলে এলাম, আবার দেখা হবে! টাওয়ারের সামনের আলো ঝলমলে ব্যস্ত পথে তখন একদল ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে আইফেল টাওয়ারের ছোট্ট রেপ্লিকা হাতে। বিক্রি করার আশায় টুরিস্টদের পিছু নেয় ওরা। এশীয় ছেলেপুলে, পুলিশের ভয়ে সন্ত্রস্ত সবসময়। লুকিয়ে পড়ে তাদের দেখলেই। ট্যুরিস্টরা বেশিরভাগই মুখ ফিরিয়ে চলে যান। কখনো কেউ কিনলে ওদের মুখটা যেন একটুখানি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
***************
‘ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা – নির্ঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেম। এই রাস্তাটুকু আমরা যেন একটি কাব্য পড়তে পড়তে গিয়েছিলেম।’
১৮৭৮ সালে ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ড যাবার পথে একদিনের জন্য প্যারিসে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখনই লিখেছিলেন ফরাসি দেশে আসার এই বর্ণনা। শহর দেখে মুগ্ধ কিশোরটি আরও লিখেছিলেন -
‘সেই অভ্রভেদী প্রাসাদের অরণ্যের মধ্যে গিয়ে পড়লে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। … একটা হোটেলে গেলেম, তার সমস্ত এমন প্রকান্ড যে ঢিলে কাপড় পরে যেমন সোয়াস্তি হয় না সে হোটেলে থাকতে গেলেও আমার বোধ হয় তেমন অসোয়াস্তি হয়। স্মরণস্তম্ভ, উৎস, বাগান ,প্রাসাদ, পাথরে বাঁধানো রাস্তা, গাড়ী, ঘোড়া,জনকোলাহল প্রভৃতি দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।... কী জমকালো শহর।’
রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার প্যারিস এসেছিলেন বারো বছর পর, ১৮৯০-র ৮ই সেপ্টেম্বর। তখন তিনি ২৯ বছরের যুবক। সে-যাত্রায় ইতালির ব্রিন্দিস বন্দরে জাহাজে করে পৌঁছে ইউরোপের মাটিতে তিনি পা রাখলেন। তারপর রাত সাড়ে এগারোটার ট্রেনে যাত্রা শুরু করে, ট্রেন বদল করে প্যারিস এসে পৌঁছলেন ভোর তিনটায়। পরের দিন পায়ে হেঁটে পারীর সৌন্দর্য দেখতে বেরিয়েছিলেন তিনি। ১৮৮৯-এর বসন্তে ফরাসি বিপ্লবের শততম বার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বমেলা হয়েছিল প্যারিসে। বিশ্বমেলার প্রধান তোরণ হিসেবে নির্মিত আইফেল টাওয়ারও সেবার প্রথম দেখেছিলেন তিনি।
১৯১৩-তে তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। নোবেল বিজয়ী হবার পর আরও কয়েকবার তিনি প্যারিস ভ্রমণে এসেছিলেন। বিশিষ্ট শিল্পী আর শিল্পানুরাগীদের উপস্থিতিতে প্যারিসে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। আসলে ফরাসি শিল্প আর সংস্কৃতির প্রতি কবির ছিল গভীর অনুরাগ। এই অনুরাগ বোধহয় তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার। ঠাকুর পরিবারের ইউরোপীয় সঙ্গীত, বিশেষত ইতালীয় আর ফরাসি সঙ্গীতচর্চার ঐতিহ্যের সূচনা তাঁর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকে। কবির প্রথম প্যারিস ভ্রমণের একশ বিশ বছর পর একটি রাস্তার নাম “র্যু টেগোর” দিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছিল ফরাসি দেশ।
আইফেল টাওয়ারে কেটে গেছে বেশ কয়েক ঘন্টা। কোনও মিউজিয়ামে যাবার মত সময় নেই হাতে। সেগুলো বন্ধ হবার সময় হয়ে এসেছে প্রায়।
‘এবার কোথায়’?
সুমনা জিজ্ঞেস করতেই অনি বলল, ‘আমি কিন্তু এখনই বলে রাখছি, গারোঁ নদীর ধারের ছোট্ট শহর বোর্দু-তে একবার যেতে চাই। আর কেউ না গেলে একাই যাব আমি’।
‘বোঝো! মিউজিয়াম দেখে শেষ করতে পারব না, তার মধ্যে আবার ওয়াইনারি! তাও যদি প্যারিসে হত! সে তো অনেকটা দূরে..’, একটু থামল সৌর, তারপর বলল, ‘তবে সত্যি কথা বলতে কি, আমারও যাবার খুব ইচ্ছে...’ কথাটা শেষ করল না সৌর।
বললাম, ‘সে নাহয় আজ ফিরে গিয়ে ভাল করে সময়ের হিসেব করে প্ল্যান করে ফেলব। এখন চল না, র্যু টেগোর দেখে আসি!’
প্রায় ৩৮০ টা মেট্রো স্টেশন নিয়ে ১০০ বছরের পুরনো প্যারিসের মেট্রো ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাবওয়ে। সারা সপ্তাহের টিকিট কাটা আছে আমাদের। যেখানে খুশি যেতে পারি মেট্রো করে। শুধু দু-তিনবার হয়তো ট্রেন পাল্টাতে হবে।
আর দেশেই হোক কি বিদেশে, কবির স্মৃতি-বিজড়িত জায়গাগুলোর প্রতি আমাদের টান অন্তরের। তাই সকলেই রাজি, র্যু টেগোর দেখতে যাওয়াই ঠিক হল।
১৯৯৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর প্যারিস ১৩এলাকার ‘প্যাসাজ র্যামন্ড’ রাস্তাটির নাম বদলে র্যু টেগোর নামকরণ হয়। এই রাস্তার সংলগ্ন উদ্যানটির নাম বিখ্যাত স্পেনীয় চিত্রশিল্পী জোয়ান মিরোর নামে। সেই উদ্যানেই স্থাপিত হয়েছে কবির আবক্ষ মূর্তি। সেখানে দাঁড়িয়ে বিদেশের মাটিতে যেন আমার চিরচেনা দেশের ছোঁয়া পেলাম। মুহূর্তে রূপসী পারী আমার বড় আপন হয়ে ধরা দিল।
গোপন রহি গভীর প্রাণে, দেশের সঙ্গে বিদেশকে, আপনঘরের সঙ্গে বিশ্বদরবারকে মিলিয়ে দিলেন তিনি বড় অনিবার্যভাবে, আমার রবীন্দ্রনাথ।
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে
আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে
বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে।
কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও
জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি
বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।