প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

এপ্রিল ১৫, ২০১৬

 

পুরনো অ্যালবাম

কেয়া মুখোপাধ্যায়


(১৮)

(আগের অংশ) মিউজিয়ামে দেখা সারি সারি আশ্চর্য ছবিগুলো যেন এক একটা জানলা। কোন জানলায় চোখ রাখলে নরম ভোর, কোনটায় মায়াবি বিকেল আবার কোনটায় বিষণ্ণতা। এক একটা জানলা মনে থেকে যায় তার রঙ নিয়ে। খুব কর্মব্যস্ত, সমস্যাসঙ্কুল দিনে সেরকম কুহক-সবুজ কি কোমল চন্দনরঙ মনে শান্তির প্রলেপ দেয়। ছবির জানলায় তুলি হাতে আনমনে চেয়ে থাকা এক একজন শিল্পীও ওভাবেই মনে থেকে যান।

আর সকলের মত আমারও ছোটবেলা জুড়ে ছিল অজস্র রূপকথা। সেই মায়াবি জগত আর তার চরিত্ররা ভিড় করে থাকত মাথায়। প্যাস্টেল কি জলরঙে ভর করে তারা নেমে আসত ছবি আঁকার খাতায়। কল্পনার আকাশে অবাধ স্বপ্ন-উড়ানের দিন সেসব। রঙতুলি ছিল আমার অবকাশের সঙ্গী। গভীর সখ্য গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। কিন্তু ভালবাসাটুকু রয়ে গেছে। তাই চোখ আর মন দিয়ে অনুভবের চেষ্টা। এক একটা অন্যরকম দিন শুধু নিজের সঙ্গে কাটাতে গেলে, হারিয়ে যেতে চাইলে আর্ট মিউজিয়ামের জুড়ি নেই। একটা নীরব স্রোতের মত মিশে যাওয়া ভ্যান গখ, গগ্যাঁ, মোনে, রেনোয়াঁয়। মনে মনে গল্প করা ছবির সঙ্গে।  ম্যুজে ডি’অরসে আমাকে বিহ্বল করে দিল।

‘নিশির শিশির ঝরে কি আমারে হেরিয়া?
প্রভাত-আলোকে পুলক আমারে ঘেরিয়া,
এ কি সত্য?’

দু’তিনটে স্মারক কুড়িয়ে ঘোরের মধ্যেই এগিয়ে যাই ফেরার পথের দিকে। অবিরল ভালো লাগা নিয়ে বেরিয়ে আসি বাইরে।
- এরপর কোথায়?
- আগে কিছু খাওয়া।

ছবির রাজ্যে এতক্ষণ খিদে তেষ্টা বেমালুম ভুলে ছিলাম আমরা। রিনি মনে করিয়ে দিতেই হুড়মুড়িয়ে খিদে পেল। নোত্‌র দাম গির্জার কাছেই সঁ মিশেলে ব্রিজের সামনে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ। বাইরে চেয়ার টেবল পাতা। খাওয়া আর পথ চলতি মানুষের মিছিল দেখা। বেশ লাগে। আমাদের সকলের পছন্দ আলাদা। তাতে অসুবিধে ছিল না। কিন্তু পাঁচজনের মধ্যে দুজনের পারস্পরিক ইকোয়েশনটা কিঞ্চিৎ গোলমেলে ছিল তখন। তাই প্রতিবারই খাবার অর্ডার করা নিয়ে এক চূড়ান্ত ডিসঅর্ডার দেখা দিত।

ধরা যাক সুমনা মেনু কার্ডের ছবি দেখে কিছু একটা পছন্দ করল। সেটা হয়তো একটা অ্যাপেটাইজার বা স্টার্টার। ওদিকে সৌর সোজাসুজি মেইন ডিশ অর্ডার করতে চায়। তখন যা ঘটে মোটামুটি এরকম।
- তুই শুধু মেইন ডিশ নিবি? অ্যাপেটাইজার খাবি না?
- নাঃ। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। তার চেয়েও বড় কথা সময় নষ্ট।
- আমি যদি নিই, আমার থেকে একটু খাবি তো?
- কেন? তোর থেকে খেতে যাব কেন? আমার ইচ্ছে হলে তো আমি নিজেই অর্ডার করতাম। করিনি, মানে আমার ইচ্ছে নেই। ব্যস!
- অ্যাপেটাইজার নিলে কী এমন সময় নষ্ট হবে? আর অ্যাপেটাইজারের দাম বেশি না।
- দাম যদি নাও ধরি, আলবাত সময় নষ্ট। একি তোর বাড়ির ডাল-ভাত-চিকেন? হাত দিয়ে হাপুস হুপুস করে খেয়ে নিবি দশ মিনিটে? কাঁটা চামচ ছুরি সামলে, টুং-টাং ছন্দে শব্দ তুলে খুব আআআস্তে করে খেতে হবে। মাঝে মাঝে ন্যাপকিনে মুখ মুছতে হবে। হাআল্কা করে। এত আদিখ্যেতা আমার পোষাবে না। আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে সেইনের ধারে গিয়ে ছবি তুলব।

এরপরের ঘটনাপ্রবাহে প্রথমে সুমনার মুখটা থমথমে হবে। সৌর আমাদের বাকিদের বলবে, ‘চল, অর্ডার করে দিই’। এতক্ষণের এই অণুনাটিকার ক্লান্ত সাক্ষী আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্ডার করব। দেখা যাবে সুমনা তখনও নীরব। তারপর হতভম্ব অথচ সুভদ্র ওয়েটার খুব বিনীতভাবে সুমনাকে ভাঙা ইংরেজিতে বা চোস্ত ফ্রেঞ্চে অর্ডার করার অনুরোধ করবে। সুমনাও তখন গম্ভীর মুখে ছবি দেখে কিছু একটা অর্ডার করে দেবে। কিছুতেই অ্যাপেটাইজার অর্ডার করবে না। এবং সকলের ডিশ এসে পৌঁছলে দেখা যাবে সুমনার খাবারটি অতি অখাদ্য। তাই ও আমাদের ডিশে ভাগ বসাবে। এসব আমাদের সীন বাই সীন মুখস্থ। তাই অন্যরকম কিছু ঘটলেই শুধু অবাক হতাম আমরা।

নোত্‌র দাম ক্যাথেড্রাল

মনে আছে ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া সুন্দরী জিপসি মেয়ে এসমেরালদাকে? আর তাকে ভালোবেসে ফেলা বিকট চেহারার হতভাগ্য কুঁজো কোয়াসিমোদোর কথা? নানা ঘটনাচক্রে মিথ্যে খুনের অভিযোগে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল এসমেরালদার। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচাতে পারেনি কোয়াসিমোদো।
একটু আগেই রেণু রেণু বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল। খাওয়ার শেষে বৃষ্টিমেখে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম নোত্‌র দাম ক্যাথেড্রাল (Notre Dame Cathedral)-এর সামনে। রোমান, গথিক আর ফরাসি স্থাপত্যশিল্প ও ভাস্কর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন এই নোত্‌র দাম দ্য পারি। বৃষ্টিভেজা নোত্‌র দাম গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে ছোটবেলায় পড়া ভিক্টর হ্যুগোর চরিত্রদুটির কথাই মনে পড়ল। এসমেরালদা আর কোয়াসিমোদো। মনে পড়ল গল্পের শেষটুকুও। করুণ, নিষ্ঠুর পরিণতি!

Looking at Esmerelda hanging off in the distence and Frollo's wrangled corpse down below, Quasimodo cries out:
''There is everything I ever loved!''
Quasimodo is never seen again. Years later when a gravedigger stumbles across La Esmerelda's remains, he finds the skeleton of a hunchback curled around her.

বড় করুণ, নিষ্ঠুর পরিণতি! এখানেই কোথাও…!

শুধু আমার নয়, আমাদের সব্বারই একসঙ্গে মনে পড়েছিল The Hunchback of Notre Dame। আসলে ফরাসি দেশ মানে আমাদের ছোটবেলার মগ্নতায় মিশে থাকা জুলে ভার্নে, আলেকজান্দ্রা দুমা, ভিক্টর হ্যুগো। স্লাইড শো-র মত পর পর মনে ভেসে আসে টুকরো টুকরো ছবি, গল্পের চরিত্ররা।

প্রাচীন গির্জা নোত্‌র দাম ক্যাথেড্রাল

প্যারিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর প্রাচীন গির্জা নোত্‌র দাম ক্যাথেড্রাল। এর কাজ শুরু হয়েছিল রাজা সপ্তম লুই আর পোপ তৃতীয় আলেকজান্ডারের আমলে। ১১ শতকে। ১১৬৩ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১২৩০ সালে প্রথম পর্যায় শেষ হয়। এরপরও নানা সময়ে নতুন কিছু কিছু অংশ সংযোজিত হয়ে আজকের রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর নাকি প্রায় ১৩ লক্ষ লোক আসেন এখানে।

আমাদের সামনে লম্বা লাইন। কারো কোনও ব্যস্ততা নেই। নেই কোনো হট্টগোল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢুকলাম ক্যাথেড্রাল-এর ভেতরে। আশ্চর্য শান্ত পরিবেশ। বৈদ্যুতিক আলো নেই। মোমবাতির নরম আলোর দীপ্তি। তাতেই যতটুকু দেখা যায়। কারুকার্যময় জানালা। বিভিন্ন সেন্টদের ছবি আর নানা কাহিনি খোদাই করা জানলায়। সূর্যের আলো যখন জানলার ফাঁক দিয়ে আসে, সে এক অপূর্ব দৃশ্য! সামনে খুব চেনা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি। সুন্দর মনে কাঠের তৈরি সাধারণ বেঞ্চ। সেখানে বসেই নীরব, একাগ্র প্রার্থনায় নিমগ্ন অনেকে। চঞ্চল মনও শান্ত হয়ে আসে নিমেষে।

ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি

আজ লিখতে লিখতে মনে পড়ল, কয়েকমাস আগে সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় ভাষা হারিয়েছিল প্যারিস। গুলি, বিস্ফোরণ, গ্রেনেড হামলা। প্যারিস রক্তস্নাত। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ছবির দেশ…কবিতার দেশ, সারা বিশ্ব। তারপর থেমে গিয়েছিল এই নোতর দাম গির্জার ঘন ঘন ঘণ্টাধ্বনি! শোকের অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল আইফেল টাওয়ার। বন্ধ ল্যুভর মিউজিয়াম। প্রাণোচ্ছল তরুণ-তরুণীদের কথকতা ছিল না শঁজেলিজে সড়কজুড়ে। সেইন নদীর তীরে উচ্ছল প্রেমিক যুগলদের হাসির শব্দ বদলে গিয়েছিল সদা সতর্ক ফরাসি সেনা আর পুলিশের ভারি বুটের আওয়াজে। শার্লি হেবদোর দপ্তরে হামলার পরও শিল্পের প্রতি সম্মান জানিয়ে পেন বা পেন্সিল তুলে ধরেছিলেন সাধারণ মানুষ। সেও এই নোত্‌র দাম গির্জারই সামনে।

গির্জার আশ্চর্য নৈশব্দ্যের পর বাইরে বেরিয়েই হাজার কন্ঠের কলতান। নরম সবুজ ঘাসের গালিচায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অসংখ্য মানুষ। পায়ে চলা ছোট্ট ব্রিজের ওপর থেকে সেইনের বুকে ডাইভিং করছে কিছু ছেলেমেয়ে। সৌর খুব উৎসাহ নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই সুমনার মুখ অন্ধকার। জানা গেল লাইসেন্স ছাড়া হবে না।

নোত্‌র দাম ক্যাথেড্রালের ভেতরে

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম পন্ট দ্য ইনভালিদ-এর কাছে। এর আর এক নাম তৃতীয় আলেকজান্ডার ব্রিজ। ১৯০০ সালের বিশ্বসম্মেলনের সময় তৈরি এই ব্রিজটাই প্যারিসের সবচেয়ে সুন্দর ব্রিজ। রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে জার তৃতীয় আলেকজান্ডারের নামে নাম রাখা হয়েছিল এই ব্রিজের। ব্রিজের দু’প্রান্তে স্তম্ভের ওপরে বসানো ব্রোঞ্জের নানা সুদৃশ্য মূর্তি। নদী পেরিয়ে দক্ষিণে গেলে প্রাসাদ - গ্রান্দে (বড়) আর পেতিত (ছোট) প্যালেস। এগুলোর নির্মাণও বিশ্বসম্মেলনের সময়ে। পেতিত প্রাসাদটাই এখন প্যারিসের মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস। মিউজিয়ামে না ঢুকে এগোতে লাগলাম নদীর উত্তরদিকে, শঁজেলিজে ধরে।

প্যারিসের ঐতিহ্যপূর্ণ রাজপথ শঁজেলিজে-তেই ‘আর্ক দ্যে ত্রিয়ঁফ’ বা ‘বিজয়তোরণ’। বিজয়-স্মারক হিসেবে নেপোলিয়ন তৈরি করেছিলেন এই তোরণ। বর্ষবরণের রাতে আলো আর আতশবাজিতে আলো-ঝলমল, রঙিন হয়ে ওঠে আর্ক দ্যে ত্রিয়ঁফ । এবার হাঁটা শঁজেলিজে থেকে লা কনকর্ড স্ক্যোয়ারের দিকে। পথের দু’দিকে সুবিশাল আউটলেট নিয়ে হাজির শ্যানেল, দিওর, ইভস সাঁ লোর, ল’রিয়াল, সেফোরা, কার্তিয়ে, মঁ ব্লাঁ। সৌন্দর্য, স্টাইল আর ঐতিহ্যের শেষকথা। এ রাস্তায় যেন জাদু আছে! এক একটা দোকান পেরিয়ে যাই আর হাওয়ার ভেসে আসে এক একটা সুগন্ধি| নরম হাওয়ায় ভর করে ছ ফুলের সুগন্ধ|চলার গতি এখানে থামতে বাধ্য। মনে হবেই কী উপহার কিনি প্রিয়জনের জন্যে?


‘আর্ক দ্যে ত্রিয়ঁফ’ বা ‘বিজয়তোরণ’

ঘড়ি বলছে সন্ধে। আকাশে তখনো অঢেল বৃষ্টিধোয়া কমলা রোদ্দুর। সেইন নদীর তীর দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম পায়ে পায়ে। সেইন নদীকে বলা হয় প্যারিসের হৃদয়তরঙ্গ। সুদৃশ্য প্রমোদতরণীতে সেই হৃদয়তরঙ্গে ভেসে চলেছে সুবেশা প্রেমিক-প্রেমিকারা। সন্ধেয় ব্রিজের মাথায় জ্বলে ওঠা আলোয় ঝলমল করছে সোনালি দেবদূত মূর্তি। আকাশে নীল-কমলা আলোর বন্যায় ভাসছে আইফেল টাওয়ার। ক্যামেরায় বন্দী হয় সন্ধের অপরূপা পারী। হাজার মানুষের ভিড়ে একেবারে একান্ত নিজের একটা দ্বীপ তৈরী করে নিতে পারলেই মনে মনে ভেসে আসবে গান,

‘…And when you speak, angels sing from above
Everyday words seem to turn into love songs
Give your heart and soul to me
And life will always be la vie en rose.’

 

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।