প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

মার্চ ১৫, ২০১৬

 

পুরনো অ্যালবাম

কেয়া মুখোপাধ্যায়


(১৬)

(আগের অংশ) মৃদু আলোর মায়াবি পরিবেশ গ্যালারিতে। সামনের ক্যানভাসে উজ্জ্বল দুটো চোখ, চেনা মুখ। আবহ। অদ্ভুত নিরাসক্তি দৃষ্টি। আপাদমস্তক ভর করে রয়েছে যেন অব্যক্ত ঔদাস্য। ফরাসি শিল্পী ইউজিন অঁরি পল গগ্যাঁর আত্মপ্রতিকৃতি।

গগ্যাঁর জীবনের শেষ আট বছর কেটেছিল ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ায়। মানুষের সভ্যতার নকল জীবন অসহনীয় মনে হয়েছিল তাঁর। সুন্দরী পারীর আলো ঝলমল রাত, কফি কিংবা মদের পেয়ালায় তুফান তুলে বন্ধুদের সঙ্গে শিল্প নিয়ে তুমুল আলোচনা - সব তুচ্ছ তখন। আরও বড় এক সত্য কিংবা ভালবাসার খোঁজে অথবা না-আঁকা সেরা ছবিটা ক্যানভাসে ধরতে শেষবারের মতো যখন স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি দিলেন পলিনেশিয়ায়, তখন বয়স সাতচল্লিশ।

তাহিতি-বাসের সময়ে আঁকা তাঁর ছবি বিশ্ববন্দিত। সুদূর তাহিতির সমাজ প্রাচীন। মানুষগুলো বড় অকৃত্রিম। ক্রমশ নিজের জীবনাচরণে আর অভ্যাসে তাদেরই মত হয়ে উঠেছিলেন গগ্যাঁ।

D'où Venons Nous / Que Sommes Nous / Où Allons Nous. ফরাসীতে লেখা শব্দগুলো, যতিচিহ্ন-হীন। ক্যানভাসের ওপরের ডানদিকে সই, P. Gauguin / 1897। পৃথিবী-বিখ্যাত এই মাস্টারপিসেরও জন্ম তাহিতিতে, Where Do We Come From? What Are We? Where Are We Going? মানবজীবনের সে এক অসামান্য ছবি। প্রকৃতির অপার সৃষ্টিরহস্য থেকে জীবনের সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ছুঁয়ে অসীম-অনন্তের সৌন্দর্য ভাস্বর সেই ক্যানভাসে।

গগ্যাঁ আর ভ্যান গখ। তাঁরা কি বন্ধু না পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী? বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল হয়তো। কিন্তু সে এক অস্বচ্ছন্দ, অস্বস্তিকর বন্ধুত্ব। তবে বন্ধুত্ব যেমনই হোক, ১৮৮৮ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্ল-এর হলুদ বাড়িতে এই এই দুই শিল্পী যেসব ছবি এঁকেছিলেন, তা দিয়েই বিশ শতকের চিত্রশিল্পের জগতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা।

গগ্যাঁর ছবি আঁকা শুরু পঁচিশ বছরের আশেপাশে। ১৮৭০ সাল পর্যন্তও তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল ইমপ্রেশনিস্ট স্টাইলেই বিশ্বস্ত থাকার। ক্যামিল পিসারো তখন তাঁর কাছে ঈশ্বরপ্রতিম। ১৮৭৬ সালে প্রথম আলাপ পিসারোর সঙ্গে। গগ্যাঁর ছবি ভাল লেগেছিল পিসারোর।

১৮৭৯-এর এক প্রদর্শনীতে স্থান পেল গগ্যাঁর ছবি।

গগ্যাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলি বৈচিত্র্যময়। কখনো নাবিকের চাকরি, কখনো শেয়ার বেচাকেনার দালালি। একসময় স্ত্রী-সন্তানদের ত্যাগ করে জীবিকার খোঁজে ফ্রান্সের মার্টিনিকে। সেখানেই নতুন জীবনের শুরু।
১৮৮৭ তে প্যারিসের আর্ট গ্যালারিতে প্রথম দেখা হল পল গগ্যাঁ আর ভ্যান গখের। পল গগ্যাঁর বয়স তখন ঊনচল্লিশ। ভ্যান গখের চৌত্রিশ। গগ্যাঁর ছবির কাব্যময়তার ভক্ত ভ্যান গখ। ভ্যান গখের ছবির আবেগঘন তীব্রতায় মুগ্ধ গগ্যাঁ।

১৮৮৭ র শেষ দিকে ছবি বিনিময় করলেন তাঁরা। সূর্যমুখীর শিল্পী তাঁর সূর্যমুখী ফুলের অনুশীলনের দুটো ছবি দিলেন গগ্যাঁকে। গগ্যাঁ ভ্যান গখকে দিলেন মার্টিনিকের নদীতীরে এক মহিলার সঙ্গে একটি বালক আর গরুসমেত এক ল্যান্ডস্কেপের ছবি।

১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঝলমলে রোদে ছবি আঁকার জন্য দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্ল-এ চলে এলেন ভ্যান গখ। তারপর তাঁর ক্যানভাসে যেন ঘটে গেল বিপ্লব। সে এক স্বপ্নের মত সময়। তাঁর কথায়,

‘আশ্চর্য সহজ, স্বচ্ছন্দ এক সময় গেছে আমার। চারপাশে প্রকৃতি তখন এত অপরূপা ছিল, নিজের সম্বন্ধে প্রায় সব বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। স্বপ্নের মতো একেকটা ছবি এসেছে আমার কাছে।’

তীব্র, উজ্জ্বল, সাহসী রং জুড়ে ছিল তার সে সময়কার সব ছবিতে। কিন্তু ভ্যান গখ এক জটিল, দুর্বোধ্য চরিত্র। সঙ্গীসাথীহীন নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ। সহজে কারও সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় না। শুধু অনেকদিনের এক স্বপ্ন তাঁর, সমমনস্ক কিছু চিত্রশিল্পীকে নিয়ে একটা আবাস গড়ে তোলার। সেখানে সবাই মিলে শুধু ছবি আঁকবেন।
আর্ল-এর প্লেস লেমারটিনে ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া নিলেন ভ্যান গখ। তারপর উজ্জ্বল হলুদ রঙে সাজিয়ে তুললেন সেই বাড়ি। ঠিক করলেন, ওই হলুদরঙা বাড়িই হবে তাঁর দক্ষিণের স্টুডিও। আর পল গগ্যাঁ হবেন সেই স্টুডিওর প্রধান। জুন মাসে, গগ্যাঁর ৪০তম জন্মদিনের ঠিক আগে, ৫০ ফ্রাঁ সহ আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিলেন ভ্যান গখ।

গগ্যাঁর হাতে তখন টাকাপয়সা নেই তেমন। তবু ভ্যান গখের প্রস্তাব লুফে নিতে তাঁর দ্বিধা হচ্ছিল প্রথমে। শেষ অবধি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন গগ্যাঁ। তবে তখনই নয়। আরো কিছুদিন পরে। ওদিকে হলুদ বাড়ি সাজাতে ক্লান্তিহীন একের পর এক ক্যানভাস ভরিয়ে তুলছেন ভ্যান গখ।

অগাস্ট মাসে আর্ল-এ এলেন গগ্যাঁ। দু’জন সৃজনশীল মানুষ। দু’জনেই অসম্ভব প্রতিভাবান। আবেগপ্রবণ। তর্ক-বিতর্ক থামতেই চায় না। ক্যানভাসে ছবি ফুটে ওঠার পর ছবির আলোচনা তো নয়, যেন দুজনের যুদ্ধ! দু’জনে পরস্পরের কঠোর সমালোচক।

মনে পড়ে আর্ভিং স্টোনের ‘লাস্ট ফর লাইফ’। এ শুধু এক উপন্যাস নয়। এক গভীর গবেষণায় ঋদ্ধ সে যুগের ঐতিহাসিক দলিল। পল গগ্যাঁর ছবি দেখে সেখানে ভিনসেন্টের প্রথম প্রতিক্রিয়া:

"You're like Lautrec," murmured Vincent. "You hate. You hate with all your might."

সে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। দু’জনেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। লাভা উদ্গীরণ এক নিমেষে, যখন তখন। কিন্তু এভাবে কি চলে দীর্ঘদিন?

রাতের তুমুল নেশার প্রভাব কেটে যাওয়ার পর এক সকালে ভিনসেন্ট পলকে বললেন, আগের রাতে তাঁর পলের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা ঠিক হয়নি। আসলে ক্ষিপ্ত ভিনসেন্ট মদভর্তি গেলাস ছুঁড়ে মেরেছিলেন পলের দিকে। ততদিনে ছবি যত আঁকা হয়েছে, পরস্পরের প্রতি ক্ষোভ জমেছে তার চেয়ে বেশি। গগ্যাঁর আর ইচ্ছে করছিল না আর্ল-এ থাকতে। আগের রাতের ঘটনা তাঁর সেই ইচ্ছেকেই আরও উসকে দিল। পরদিন সন্ধ্যায় বিদায়ের কথা জানালেন পল। একইসঙ্গে দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ ভিনসেন্ট। এক সময় ছুরি হাতে তাড়া করলেন পলকে। পলের প্রতিরোধের মুখে ফিরেও এলেন ঘরে। কিন্তু আবেগজর্জর ভিনসেন্ট রাগ সামলাতে না পেরে ধারালো ক্ষুর দিয়ে নিজেই নিজের কানের লতি কেটে ফেললেন। তারপর এক টুকরো কাপড়ে কানের সেই কাটা লতি পেঁচিয়ে নিয়ে হাজির হলেন স্থানীয় এক পতিতালয়ে। সেখানকার এক তরুণীকে উপহার দিলেন সেই কাটা কান। পল ফিরে দেখলেন রক্তাক্ত ভিনসেন্ট পড়ে আছেন বিছানায়। পুলিস এল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল ভিনসেন্টকে। আর পলও একমুহূর্ত দেরি না করে সেই রাতেই আর্ল ছাড়লেন। এভাবেই শিল্পের ইতিহাসের অতিনাটকীয় এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।

প্রকৃতির সহজ সরল রূপ ধরা বলিষ্ঠ রেখায়। উজ্জ্বল রঙের বিস্ফোরণ এক একটা। প্রকৃতির মাঝে মানুষের শরীরের রেখাগুলি একটু অন্যরকম। খানিক বিসদৃশই বুঝি সে শরীরী বিভঙ্গ। ক্যানভাসে ধরা beauty in ugliness। অপার্থিব এক অনুভবের স্পর্শ, একান্ত নিজস্বতার স্বাক্ষর প্রতি ক্যানভাসে। এই হলেন পল গগ্যাঁ। এক বর্ণময় চরিত্র। বিতকির্তও। সুরা আর নারীতে অদম্য আকর্ষণ আজীবন। সৃষ্টির আকুতিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছেন গগ্যাঁ আজীবন। বারবার ছেড়েছেন নিরাপদ জীবনের আশ্বাস। শিল্পসৃষ্টির তাগিদেই ১৮৯১ সালে গগ্যাঁর প্যারিসের শহুরে জীবন ছেড়ে তাহিতিতে চলে যাওয়া। আদিমতার স্বর্গের সন্ধানে।

তাহিতির সাধারণ মানুষদের জীবনের জার্নাল ‘নোয়া নোয়া’

ম্যুজে ডি’ অরসে-র গ্যালারিতে পল গগ্যাঁর আঁকা ছবির সংখ্যা ২৪। ক্যানভাসগুলির বেশিরভাগই তাহিতি দ্বীপনির্ভর। ফ্রান্সের কাছে সমুদ্রে জেগে ওঠা অগুন্তি দ্বীপ ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে। সেই দ্বীপগুলোই একত্রে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত তাহিতি। তাহিতি আর পল গগ্যাঁ শব্দ দুটো বুঝি সমার্থক। ভোরের সূর্য থেকে থেকে রাতের আকাশের উজ্জ্বল তারা ছুঁয়ে থাকে তাহিতির অনাবিল নিসর্গ প্রকৃতি। আদিম ছায়ায় ঘেরা রহস্যময় অরণ্য। মানুষের অনাড়ম্বর যাপন। ভারি মায়াবি তাদের পৃথিবী। সেখানে বেপরোয়া ঝড়ের মত এলেন পল গগ্যাঁ। বাকি জীবনটুকু থিতু হলেন তাহিতিতেই। তাহিতি দ্বীপের মেয়েরাই ধরা দিয়েছে পল গগ্যাঁর শিল্পসৃজনে। অনাড়ম্বর তাহিতিয়ান জীবনযাত্রা, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, তাদের যৌন আকর্ষণ সবই কিছু খোলামেলাভাবে ধরা পড়ে গগ্যাঁর ক্যানভাসে। এই তাহিতি দ্বীপেই আলাপ তেহুরার সঙ্গে। তেহুরার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাহিতিকে। তাঁর কলমে তাহিতির সাধারণ মানুষদের জীবনের জার্নাল ‘নোয়া নোয়া’। ‘নোয়া’ মানে সুগন্ধী। এ বিশ্লেষণ তেহুরা সম্পর্কে। বিশ্লেষণটি তাই তাহিতি সম্পর্কেও।

ইউজিন অঁরি পল গগ্যাঁর আত্মপ্রতিকৃতি

সামনে পল গগ্যাঁর পোর্ট্রেট, পিছনে হলুদ যিশুর ছবি। Portrait de l'artiste au Christ jaune, Portrait of the Artist with the Yellow Christ। বড় অদ্ভুত ছবি! গগ্যাঁ হলুদ যিশু এঁকেছিলেন ১৮৮৯ সালে। ক্রুশবিদ্ধ হয়ে যিশুর মৃত্যু দৃশ্য ধরা আছে এই ছবিতে। ক্যানভাসজুড়ে হলুদ রঙের ছড়াছড়ি। সেই রঙেই ক্যানভাসে ফুটে উঠেছেন যিশু। ত্রিকোণাকৃতি মুখ। তাঁর পায়ের কাছে প্রার্থনারত তিন নারী। এ ছবিতে মূর্ত সিম্বলিজম বা প্রতীকবাদ।

ঊনিশ শতকে মাঝামাঝি থেকে শেষ ভাগ জুড়ে সিম্বলিজম-এর বিস্তার। ফরাসি, রাশিয়ান আর বেলজিয়ামের শিল্পীদের মাধ্যমেই এই ঘরানার উদ্ভাবন। তবে সিম্বলিজম তত্ত্বের উদ্ভাবক চিত্রশিল্পীরা নন। ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার এর সাড়া জাগানো কবিতা সঙ্কলন Les Fleurs du mal, The Flowers of Evil (১৮৫৭) প্রকাশের পরেই চিত্রকলায় সিম্বলিজম-এর সূচনা। এভাবেই সিম্বলিজমে এসে মিশে গেছে সাহিত্য আর শিল্প। আবার অনেকে বলেন সিম্বলিজম রোমান্টিসিজমেরই গথিক অংশ। এ ঘরানা সরাসরি প্রকৃতি, বাস্তবতা আর আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে। তাই সিম্বলিজম মানে বাস্তবতাবিরোধী স্বপ্ন আর কল্পনার উড়ান।

পল গগ্যাঁ বলতেন, গ্রামের সাধারণ জীবনযাত্রাই শিল্পসৃষ্টির প্রধান উপাদান। বলতেন, প্রাচীন জীবনই সৃজনশীলতায় অনুপ্রেরণা দিতে পারে। শহরকেন্দ্রিক জীবন বড় রূঢ় আর নিরেট। সে জীবনে কিছুতেই শিল্পের সহায়ক নয়। গ্রামের সহজ সরল জীবন আর শহরের জটিল জীবনের মধ্যে ভালো কোনটি, তা নিয়ে রীতিমতো বিতর্কের অবতারণা করেছিলেন গগ্যাঁ।

তাহিতিয়ানদের নিয়ে শিল্প সৃষ্টি করতে গিয়ে যে ঘরানার চিত্রকলার সূচনা করলেন পল গগ্যাঁ, তাকেই বলা হয় প্রিমিটিভিজম। শিল্পে মূর্ত আদিমতা। সব মানুষকেই একদিন তার শেকড়ের সন্ধান করতে হবে। এটাই প্রিমিটিভিজমের প্রধান বিষয়। মায়াবি এক আদিম রহস্যময়তা ধরা দিয়েছে গগ্যাঁর ক্যানভাসে।

Arearea, Joyfulness ১৮৯২

Arearea, Joyfulness ১৮৯২। মাঝখানে দুই নারী। দূরে গাছ। ফোরগ্রাউন্ডে নানা মোটিফ। লালরঙা কুকুর। আকাশ দৃশ্যমান নয়। সবুজ, হলুদ, লাল রঙ ব্যাকগ্রাউন্ড জুড়ে। সেখানে এক কল্প-দৃশ্য। এক মূর্তির পুজোয় রত কিছু নারী। একইসঙ্গে ক্যানভাসে ধরা সমন্বয় আর বিষণ্ণতা।

১৮৯৩ সালে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছিল এই ছবিটি। সঙ্গে তাহিতির আরো অনেক ছবি। পলের অনেক প্রত্যাশা ছিল সেই প্রদর্শনীকে ঘিরে। কিন্তু সমাদর পায়নি ছবিগুলো। বরং ছবিতে লাল কুকুর দেখে বিদ্রূপে মুখর হয়েছিলেন অনেকে। তথাকথিত বন্ধুরাও। এই ছবিটি ছিল পলের মনের বড় কাছাকাছি। বিক্রির পর, ১৮৯৫-তে একবার নিজে কিনেও নিতে চেয়েছিলেন আবার।

Tahitian Women on the Beach

দাঁড়িয়ে আছি গগ্যাঁর আঁকা বিখ্যাত ছবি Femmes de Tahiti, ou Sur la plage, Tahitian Women on the Beach-এর সামনে। ১৮৯১তে আঁকা। তাহিতির দুই যুবতী মেয়ে বসে আছে সমুদ্রতীরে। এটাই ছবির বিষয়। পলের নিজস্ব সিগনেচার-এর পাশাপাশি এ ছবিতে মানে আর মাতিস-এর প্রভাবও মিশে আছে।

আছে গগ্যাঁর Vairumati। কেউ কেউ বলেন, ফিমেল আইডল। এ ছবির নায়িকা প্রায় নিরাবরণ। Vairumati-র কাছেই আছে আরো একটি ক্যানভাস - 'Et l'or de leur corps, And the gold of their bodys (১৯০১)। এই ছবিতে নিরাবরণ দুই তাহিতিয়ান নারীর শরীর ঘিরে জ্যোতি।

প্রিমিটিভিজম ঘরানার ছবি আঁকার সময় গগ্যাঁ ছবির চরিত্রদের রূপ দিতেন জ্যামিতিক ডিজাইনে। সঙ্গে সুস্পষ্ট কনট্রাস্ট। তাহিতির এই ক্যানভাসগুলো সেই বৈশিষ্ট্যকেই ধরে রেখেছে রঙে, রেখায়।

১৯০১ সাল। তাহিতিতেই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন গগ্যাঁ। চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণতর। তবু ফিরতে চাননি প্যারিসে। ১৯০৩ -এর ৩রা মে চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। বয়স তখন পঞ্চান্ন।

তারপর দুকূল ছাপিয়ে বন্যার মত এল খ্যাতি। ক্রমশ অমূল্য হয়ে উঠল তাঁর ছবি। ‘তুমি কবে বিয়ে করবে?’ এই শীর্ষকের ছবিটিতে তাহিতি দ্বীপের দুই তরুণীকে এঁকেছছিলেন গগ্যাঁ। ১৮৯২ সালে আঁকা ছবিটি ছিল সুইজারল্যান্ডের একজন সংগ্রাহকের কাছে। মধ্যপ্রাচ্যের কাতারের একটি জাদুঘরের কাছে গতবছর এটি বিক্রি হয়েছে ৩০ কোটি মার্কিন ডলারে। সত্যি, বড় বিচিত্র এই শিল্পের দুনিয়া!

ভিনসেন্ট আর পলের গ্যালারির পর পা বাড়ালাম সেই শিল্পীর ছবি দেখতে, নানাভাবে জলের রূপ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে যিনি সাধনা করে গেলেন প্রায় গোটা জীবনজুড়ে। ক্লদ মনে।

কানে কানে আর্ভিং স্টোন তখনো বলছেন,

“Art is amoral; so is life. For me there are no obscene pictures or books; there are only poorly conceived and poorly executed ones.”

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।