প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

মার্চ ৩০, ২০১৬

 

পুরনো অ্যালবাম

কেয়া মুখোপাধ্যায়


(১৭)

(আগের অংশ) স্নিগ্ধতার রং আর বিষণ্নতারও। সেই রং মেখে তাঁর ক্যানভাস জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপকথারা। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত ঘিরে থাকা মায়াবি কুয়াশা আর নরম আলোর রূপকথা, জনমানবহীন প্রকৃতি, জলের আশ্চর্য রূপ, যন্ত্রণার নীল আর মোহময় সবুজ বিছিয়ে থাকে তাঁর ক্যানভাসে। 'ওয়াটার লিলি পন্ড'- এ ফুটে থাকা কিছু ফুল আর বাঁকা একটা সাঁকো। আর কিছু নেই ছবিতে। কিন্তু ওই 'আর কিছু না থাকা'তেই হারিয়ে যায় মন। হারিয়ে যায় ছবির আশ্চর্য আলো, আশ্চর্য রং আর স্বপ্নিল মুহূর্তে।

ওয়াটার লিলি পন্ড

প্রিয় লিলি ফুল, লিলি-ভরা পুকুর, কাঠের সবুজ সাঁকো - এ নিসর্গ তিনি বার বার এঁকেছেন। নানা বয়সে, ভাবনার নতুন নতুন আলোয়। এঁকেছেন নানা ঋতুতে। কখনো বৃষ্টিধোয়া আবার কখনো বা উজ্জ্বল দিনে। এঁকেছেন সকাল-দুপুর-সন্ধেবেলায়। দিনের নানা সময়ের বদলে যাওয়া আলোয়। দ্রুত অপসৃয়মাণ আলো-ছায়ার গতি-বিভঙ্গে ক্যানভাস থেকে ক্যানভাসে দৃশ্যের রূপ বদলে গেছে। আলো আর রঙের তারতম্যে সেই বদলে যাওয়া রূপকে ধরে রেখেছেন শিল্পী।

ক্লদ মোনে। ফরাসি ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ। বলিষ্ঠ রেখা আর উজ্জ্বল রঙ্গের উৎসবের এক ব্যতিক্রমী শিল্পী যিনি বলতেন ‘Color is my day long obsession, torment and joy’.
নানা রং, নানা মুড, নানা আলোছায়াময়তায়, নানা কোণ থেকে, পুকুরের নানা পাড় থেকে মোনে তাঁর একান্ত প্রিয় লিলি ফুলের বাগানটির পুনর্নির্মাণ করেছেন বারবার - আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। ক্যানভাসজুড়ে জেগে থেকেছে কুহক সবুজ আর মায়াবি নীল। তাঁর ছবি জীবনের নানা ব্যস্ততা আর সমস্যার ঢেউ পেরোতে থাকা মানুষের চোখে বুলিয়ে দেয় শান্তির চন্দন প্রলেপ।

১৮৯৩ তে তাঁর জিভের্নির বাড়ির বাগানে মোনে সাজিয়ে তুলেছিলেন প্রিয় লিলি ফুলের জলাশয়। সেখানে ফুটত শ্বেত লিলি। সে বাগানে রং অফুরান, বেহিসেবি। সবুজ নীল সাদা গোলাপি রঙ্গের ছড়াছড়ি গাছগাছালি ঘিরে। ১৯১০ থেকে ১৯২৬ - এই সময় জুড়ে ওই বাগান আর ওয়াটার লিলির জলাশয়ই ছিল তাঁর ভালবাসা। মোনে বলতেন:

"I have come back to things that are impossible to do: water with weeds waving in the depths. Apart from painting and gardening, I am good for nothing. My greatest masterpiece is my garden."

মোনের ওয়াটার-লিলি সিরিজের ছবিগুলোর প্রথম পর্যায়ে জলাশয়, লিলির পাতা, জল ছুঁই ছুঁই উইলো, বাগান, নানা রঙের ফুল - এই সব কিছু আলাদা করে চেনা যায়। তারপর ক্রমশ হারিয়ে যায় ফর্ম। মুছে যায় অবয়ব। পাতা, ফুল, জল কি আকাশ আর আলাদা করে চেনা যায় না। জেগে থাকে শুধু কিছু রং। একেবারে বিমূর্ত ছবি। শুধুই রঙের কম্পোজিশন। কিন্তু আগের পর্যায়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে এলে বোঝা যায় এখানেও আছে সেই মায়াবি জলাশয়, সেই আশ্চর্য লিলিফুল, কুহক সবুজ গাছ আর রঙ্গিন ফুলের সমাহার। শুধু তাদের নির্দিষ্ট রূপ, রেখা আর সীমানা মুছে গেছে ক্রমশ।

Nymphéas bleus (Blue Water Lilies)

ছবির নাম - Nymphéas bleus (Blue Water Lilies)। "Nymphaea" ওয়াটার লিলির বিজ্ঞানসম্মত নাম। দিগন্ত আর আকাশ মুছে গেছে। লিলিভরা পুকুরের ছোট্ট একটা জায়গায় ফোকাস করেছেন মোনে। যেন প্রকৃতির এক টুকরো ক্লোজ-আপ। ডিটেইল বোঝা যায় না। কোনও ফ্রেম অফ রেফারেন্স নেই। আর তা নেই বলেই এই টুকরো ক্লোজ-আপে ধরা দেয় অসীম, অনন্তের অনুভব।

এর আগে মনে-র ব্রাশস্ট্রোক এত মুক্ত ছিল না। ফর্মের থেকে এত বিচ্ছিন্ন ছিল না। এই ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে থাকলে সম্পূর্ণ বিমূর্ততার এক আশ্চর্য অনুভূতি হয় মনে। দৃশ্যমান ছবি আর ভাবনার মধ্যে সাযুজ্য তৈরি করে চলতে হয় দর্শককে প্রতিনিয়ত। ক্যানভাসে যেন ধরা নিসর্গের সুরেলা বিমূর্তরূপ। এ ছবি মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে।

Women in the Garden

১৮৬৬ তে আঁকা 'Women in the Garden'। এ ছবি আঁকার সময় মোনে-র মূল লক্ষ্য ছিল, কেমন করে নিসর্গের মধ্যে মানুষকেও আনা যায়। আর প্রকৃতির মধ্যে এসে পড়া মানুষকে ঘিরে আলো-ছায়া-হাওয়ার চলাচলের বিভঙ্গকে রূপ দেওয়া যায়। এ ছবি নিয়ে এমিল জোলার কথাগুলোই দেওয়া যাক:

"The sun fell straight on to dazzling white skirts; the warm shadow of a tree cut out a large grey piece from the paths and the sunlit dresses. The strangest effect imaginable. One needs to be singularly in love with his time to dare to do such a thing, fabrics sliced in half by the shadow and the sun".

The Rocks at Belle-Ile, The Wild Coas

আর একটা ক্যানভাস। Les rochers de Belle-Ile, la Côte sauvage (The Rocks at Belle-Ile, The Wild Coast)। ব্রেটন দ্বীপেপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ বেল-ইলে-তে তখন বড় একটা যেতেন না শিল্পীরা। কিন্তু মোনে নতুন নতুন নিসর্গ আঁকতে চান। নতুন জায়গায়। ১৮৮৬-র নভেম্বরের অনেকগুলো দিন তিনি কাটিয়েছিলেন এই দ্বীপে। গুস্তাভ ক্যালিবোঁকে লিখেছিলেন:

"I am in a wonderfully wild region, with terrifying rocks and a sea of unbelievable colours; I am truly thrilled, even though it is difficult, because I had got used to painting the Channel, and I knew how to go about it, but the Atlantic Ocean is quite different".

পাথরের গায়ে সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির মুহুর্মুহু ঝাঁপিয়ে পড়া ধরা দেয় ক্যানভাসে। ছবির একেবারে ওপরের দিকে দিগন্তরেখা। আকাশের জন্যে তত জায়গা আর নেই ক্যানভাসে। গাঢ় রঙের বিন্যাস। নীল, সবুজ, বেগুনি। ঢেউয়ের মাথায় সাদা। মোনের নরম্যান্ডি স্টাইলের থেকে একেবারে আলাদা নতুন রকমের ব্রাশস্ট্রোক। জনমানবশূন্য প্রকৃতির একান্ত নিজস্ব লীলাভূমিতে শিল্পীর নতুন অনুভব রূপ পেল ক্যানভাসে।

মিউজিয়ামের একটা আলাদা সম্ভ্রম আছে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিতে মন চায় না। আনাচকানাচের নিস্তব্ধতা মেখে নিজের সঙ্গে নিজে কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাদিন। কিন্তু একা না গেলে সে সুযোগ মেলা ভার। আর হাতে সময়ও বাঁধা। তাই হাতের ক্যাটালগ থেকে বেছে নিয়ে হয় অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে কী কী দেখব। একটা গ্যালারি থেকে অন্য গ্যালারি রঙ্গের আর রেখার ঘোর লাগা চোখে কাটাতে গিয়ে বুঝতে পারি সেই কাজটাই সবচেয়ে কঠিন।

পিকাসো এক শিল্পী সম্পর্কে বলতেন - "তিনি একজন যাদুকর, তার রংয়ের ব্যবহার অপার্থিব।”আর সেই শিল্পী নিজে বলেছেন - "আমি রং দিয়ে অনুভব করি"। রং, রেখা আর আকারের গভীর আন্তঃসম্পর্ক নিজের কাজে ধরে রেখেছেন অঁরি মাতিস। তাঁর ছবিতে আর ভাবনায় মাতিয়ে দিয়েছেন বিশ শতক, দুনিয়াজুড়ে। তাঁর গ্যালারি বাদ দেওয়া অসম্ভব।

ভ্যান গখ আর গগ্যাঁর কাজের ভক্ত ছিলেন মাতিস। ভ্যান গখের মতই তিনিও ছুটেছিলেন দক্ষিণ ফ্রান্সে। সূর্যের আলো আর উজ্জ্বলতার খোঁজে। সংগী অঁদ্রে দের্ঁ। সেখানে গিয়ে দেখলেন প্রকৃতির অকৃপণ রূপ। জাদুকরি টানে চোখ টেনে রাখছে গাছপালা- ফুল-উপচনো বনভূমি-আকাশ। প্রকৃতিতে রঙের উৎসব যেন। উত্তর ফ্রান্সের বর্ণহীন, হৃদয়হীন, কঠিন শীতলতা পেরিয়ে এসে সূর্যের উজ্জ্বলতায় প্রকৃতি রঙে রঙে উচ্ছল। ক্যানভাসের পর ক্যানভাস ভরে উঠল ছবিতে।

মাতিসের Luxe, calme et volupté

প্যারিসে ফিরে সেসব ছবি দেখালেন বন্ধু ভ্লামিঙ্ক-কে। মুগ্ধ ভ্লামিঙ্কের হাতে উঠে এল ব্রাশ। প্যারিসের বুকেও সৃষ্টি হল আশ্চর্য ছবি। এই সব ছবিগুলো দেখানো হল ‘সাঁলো দে আঁতোমে’ (Salon d'Automne) -তে। প্রচুর নিন্দা হল। প্রশংসাও এল কিছু। তীব্র নিন্দা করলেন সমালোচক লুই ভ্যুসেল (Louis Vauxcelles) লিখলেন "বুনো পশু (Le Fauve) যেন দৃশ্যটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে"।

সেই শুরু। জন্ম হল 'ফভিজম'-এর।

আসলে ঊনিশ শতক পর্যন্ত ব্যাপ্ত চিত্ররীতিকে যেন একপাল বুনো জন্তুর মতই ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন আঁরি মাতিসের দলবল আর এই ফভিজম। সে একরকম বেহিসেবি তুলকালাম কাণ্ড। রীতিমতো শোরগোল তুলে ফভিজম ঢুকে পড়ল ফরাসি চিত্রকলার দৃশ্যপটে। একদিকে তখন ক্যামেরা আর ফটোগ্রাফি প্রযুক্তি বস্তুর অবিকল প্রতিচিত্রণের দায় থেকে মুক্তি দিচ্ছে চিত্রকলাকে। আর একদিকে শিল্পীরা ধীরে ধীরে দেখাতে চাইছেন যা কিছু দৃশ্যমান, তার অন্তর্গত অনুভূতিকে। বুঝতে চাইছেন মনের গভীর বিশ্লেষণ। ইমপ্রেশনিজমের বিপরীতে গিয়ে মানবাত্মার নীরব অভিব্যক্তি শোনার ঐকান্তিক চেষ্টা! এক অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে দেখতে চাওয়া জগতকে। উজ্জ্বল রং আর ক্ষিপ্ত ও ক্ষিপ্র রঙতুলির আঁচড়ে ধরা গভীর আবেগভার। আকার, অভিব্যক্তি কি প্রকৃতিগত সাযুজ্যের বাইরে শিল্পীর ভাবপ্রকাশের উন্মুক্ত, বুনো, বেপরোয়া চিত্রভাবনা, ভাস্কর্য-ভাষ্য। খুলে গেল সব দরজা। এল ‘এক্স্প্রেশনিজম’। প্রকাশপন্থী শিল্পধারা। শারীরিক বাস্তবতা নয়। আত্মিক অভিজ্ঞতাই এই ঘরাণার মূল কথা।

ছড়িয়ে পড়ল রঙের বিদ্রোহ। কালো-খয়েরির বদলে ঘন নীলে আঁকা ছায়া। মুখের আদলে প্রাগৈতিহাসিক ছোঁয়া। উজ্জ্বল হলুদ, কমলা আর খুনখারাবি লালের মাত্রা ছাড়া ব্যবহার। নতুন ব্যাখ্যা পেল শিল্পের আধুনিকতা। কিন্তু প্রথামাফিক ঐতিহ্যে বেড়ে ওঠা ফরাসি সমাজে এর স্বীকৃতি এসেছিল অনেক পরে।

অসম্ভব অনুভূতিপ্রবণ শিল্পী মাতিস। রং দিয়ে অনুভব করে আবেগ আর অভিব্যক্তির সবটুকু উজাড় করে দিতেন ক্যানভাসে। সত্তর বছর পার করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অশক্ত শরীর, চলার ক্ষমতা নেই। কিন্তু চিত্রকলার জগতে শুরু হল তাঁর নতুন এক যাত্রা। রঙিন পেপার কাট আউট। আকার আর অবয়বের নির্মাণ যেন শুধু রং দিয়ে। রঙিন কাটা কাগজে যেন উচ্ছল করে তুলল গোটা ক্যানভাসকে। রং আর আকারের কি বৈচিত্র্যময় সহাবস্থান!

জীবনের শেষ চোদ্দ বছর। অশক্ত শরীরের চলচ্ছক্তিহীন বৃদ্ধ শিল্পীর মন উড়ে চলে অসীমে- দিকদিগন্তের পানে। বাধাবন্ধহীন। সৃষ্টি হয় আশ্চর্য সব দ্বিমাত্রিক ভাস্কর্য! শেষ চিঠিতে প্রিয় বন্ধুকে লিখে যান:

“আমার বেঁচে থাকা আমার কাজে। যা আমি চেয়েছিলাম। যা আমি কখনো ভাবিনি কিন্তু যে বলটি আমি শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম, আমার সাধ্য অনুযায়ী, যার জন্য আমি নিশ্চিত নই, সে যে কোথায় গিয়ে পড়ল – জমিতে, সমুদ্রে অথবা এমন কোনও জায়গায় যেখা থেকে আর সে ফেরত আসে না।”

ছবি থেকে দ্বিমাত্রিক ভাস্কর্যের আশ্চর্য উড়ানে আমরাও সঙ্গী হই পায়ে পায়ে।

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।