ভ্রমণ কাহিনী
মে ৩০, ২০১৫
পুরনো অ্যালবাম
কেয়া মুখোপাধ্যায়
(৬)
(আগের অংশ) “If you are lucky enough to have lived in Paris as a young man, then wherever you go for the rest of your life, it stays with you, for Paris is a movable feast.’’ Ernest Hemingway-র কথাগুলো পড়েছিলাম ক’দিন আগে। ভাবছিলাম, সত্যিই এমন হয় বুঝি? প্যারিসে কিছুদিন থাকলে মনের মধ্যে একটুকরো স্মৃতির প্যারিস বয়ে বেড়াব আজীবন? এইসব নানা ভাবনাচিন্তার মাঝে তাই এয়ার ওয়েজের ফ্লাইট ব্যাঙ্ককের মাটি ছুঁল। স্থানীয় সময় তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ঝকঝকে তকতকে এয়ারপোর্ট। ভারি সুন্দর সাজানো। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট। একসঙ্গে এত ট্যুরিস্ট আগে কখনো দেখিনি। ক্যারি অন ব্যাগটি টানতে টানতে এগোবার সময় এদিক ওদিক তাকাতে গেলেই প্রায় ধাক্কা লাগার উপক্রম।
ঘন্টা ছয়েকের অপেক্ষা ব্যাঙ্ককে। কী করে কাটবে সময়টা? একা হলে কারোর সে ভাবনা মাথায় এলেও আসতে পারে। কিন্তু একসঙ্গে আমরা ক’জন মানেই সেসব নিয়ে নো চিন্তা। শুধু এর-ওর লেগ পুলিং করেই কেটে যেতে পারে সময়টা।
"উফফ! শপিং এর এক্কেবারে আইডিয়াল জায়গা!" রিনির মুখে চোখে উচ্ছ্বাস আর খুশি।
"ব্যস! রিনি ওর মনোমত কাজ খুঁজে পেয়েছে। আর চিন্তা নেই।"
অনি অ্যাজ ইউজুয়াল পেছনে লাগল। সৌর এমন সুযোগ চট করে ছাড়ে না। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, "মনে আছে, ছোটবেলায় রচনা লেখার কথা? বড় হয়ে কী করতে চাও? হ্যাঁ রে রিনি, তুই বুঝি লিখতিস, বড় হয়ে প্রাণভরে শপিং করতে চাই?"
"নন্টে, ভাল হবে না বলে দিচ্ছি! আচ্ছা শোন, ওই হাই অলটিচুডে গলাটা খালি শুকিয়ে যাচ্ছিল। জাল খাব।"
সত্যি জল তেষ্টা পেয়েছিল। নন্টে আর ফন্টে জলের খোঁজ করতে গেল। আমরা একটা ওয়েটিং এরিয়াতে বসলাম। কিন্তু খানিক বাদেই প্রায় ছিটকে উঠে পড়তে হল। একটি ৫০০ মিলিলিটারের জলের বোতল হাতে দোলাতে দোলাতে নন্টে ফন্টে ফিরে এল।
"মানেটা কী? এইটুকু জলে কি হবে?" প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম রিনি, সুমনা আর আমি।
"এইটুকুই আড়াই ইউরো। আছ কোথায়!"
"অ্যাঁ? সে কি রে! বলিস কি!"
"জলের ওইরকমই দাম। তবে, ইয়ে...বীয়ার কিন্তু খুউব সস্তা।"
"উঃ! জ্বালিয়ে মারলে। জল তেষ্টা পেয়েছে, কোথায় জলের কথা হবে। তা না, বীয়ার সস্তা!" এতক্ষণে সুমনা ফিল্ডে নেমে পড়ল।
সৌর বলল, "শোন, সেটাই তো বলছি। এরা বুদ্ধিমান। জলের দাম এমন বেয়াড়া রকম বেশি বলে সকাল থেকে বীয়ার খায় নির্ঘাত! ফুড প্লাজাটা দেখে তো তাই-ই মনে হল! কেউ জল খাচ্ছে না রে। খাবার দাবার, সঙ্গে বীয়ার।"
বাস্তবিকই তাই। জলের বোতল না কিনে লোকজন জল খাচ্ছেন ওয়াটার ফাউন্টেন থেকে। জল ছাড়া অন্য পানীয়ই কিনছেন শুধু। অগত্যা পার হেড ১০০ মিলিলিটার জলের কোটার সদব্যবহার করে আমরাও ওয়াটার ফাউন্টেনকি জয় বলে এগিয়ে পড়লাম।
ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টের ঝাঁ চকচকে ডিউটি ফ্রি শপগুলো দেখতে দেখতেই কেটে যেতে পারে গোটা দিন। আমরাও বেশ লম্বা সময় কাটিয়ে দিলাম উইন্ডো শপিং করে। ব্র্যান্ডেড পোশাক, পারফিউম, চকোলেটস, কসমেটিক্স কী নেই সেখানে। আর হ্যাঁ, সোনার গয়নার দোকানগুলোতে ছিল দারুণ ভিড়। সবাই ঠিক করলাম, ফেরার পথে যদি হাতে কিছু টাকা অবশিষ্ট থাকে, তখনই নাহয় উঁকি ঝুঁকি মারব ওসব দোকানে। আগে থেকে মন খারাপ করে লাভ নেই কোনও।
পায়ে পায়ে এগোতে থাকি আবার। ল্যান্ড করার সময় মেঘলা ছিল আকাশটা। ভাবছিলাম, এতক্ষণে হয়তো ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝরে পড়ছে গাছের ডালে, পাতায় পাতায়। কিংবা সন্ধ্যা নেমেছে নীল আকাশ জুড়ে। কিন্তু ভেতরে থেকে বোঝার উপায় নেই একটুও। বৃষ্টির কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে ফিলিপ জাকোতের কবিতাঃ
‘আমাদের এ জীবনে যেহেতু এসেছি আমি এক অগন্তুক
শুধুই তোমার সঙ্গে কথা বলি অজানা ভাষায়
কেননা তুমিই বুঝি হতে পারো একমাত্র আমার স্বদেশ
আমার বসন্ত, টুকরো খড়কুটোর বাসা, বৃষ্টিপাত বৃক্ষশাখে।’
ঊনিশ শতকের শেষে, কিংবা বিশ শতকে বিশ্ব কবিতার ইতিহাসে যে প্রভাব ফেলেছিল ফরাসী কবিতা, তার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে না। এমন গভীর প্রভাব আর কোনও ভাষার কবিরা রাখতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বিষয়গত বৈচিত্র তো বটেই, সেইসঙ্গে শব্দ আর বাক্যের আশ্চর্য ব্যবহারও বিস্মিত করে বারবার। কেমন করে যেন দেশটাই হয়ে উঠেছে কবিতার এক আশ্চর্য দেশ।
প্রথমবার বিদেশ, প্রথমবার প্যারিস। অজানার আনন্দ আর উত্তেজনার আঁচ পোহাতে পোহাতে কখন যেন পেরিয়ে গেল অনেকগুলো ঘন্টা। মাঝরাতে কিংবা বলা ভাল, পরের দিনের ভোরবেলাতে উঠে বসলাম পরের ফ্লাইটে। দীর্ঘ সফর শেষে পা দিলাম ফরাসী দেশের মাটিতে। শার্ল দ্য গল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আশ্চর্য এক অনুভব। সত্যিই তাহলে স্বপ্নপূরণ হল!
ইমিগ্রেশন পর্ব চুকিয়ে ব্যাগেজ নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগল মুখে। যেন আদর করে বরণ করে নিল ভিনদেশি অতিথিদের।
"একটা ক্যাব নেব তো আমরা?"
"
ক্যাব? পাগল নাকি! আমরা মেট্রো করে যাব।" সুমনার প্রস্তাব এক কথায় নাকচ করে দিল সৌর।
এ ওর মুখের দিকে তাকালাম।
"তা কী করে সম্ভর? একটা ক্যারি অন, একটা বড় ব্যাগেজ- এত কিছু নিয়ে মেট্রো!"
"আমরা হলাম বাজেট ট্রাভেলার। এখনই ক্যাব ডাকার বিলাসিতা না করাই ভাল। হয়তো ঘুরপথে নিয়ে গেল। তখন? এক ধাক্কায় অনেকগুলো ইউরো বেরিয়ে যাবে।"
"কি আশ্চর্য! এ কি কলকাতার ট্যাক্সি নাকি! ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে মিটার বাড়াবে!"
এইরকম নানা বাকবিতণ্ডার শেষে ঠিক হল মেট্রো করেই যাওয়া হবে। গোটা প্যারিস শহর জুড়ে দুর্দান্ত মেট্রো ব্যবস্থা। খুব অল্প সময়ে যে কোন জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়। আগামী এক সপ্তাহের পাস কিনে নিলাম আমরা। তারপর কোনরকমে ব্যাগেজ টেনে টুনে প্ল্যাটফর্মে। সকলেই ফিরে তাকান এক ঝলক। এত লটবহর নিয়ে কেউ যাতায়াত করেন না তো সচরাচর, তাই।
হৈ হৈ করে নেমে পড়লাম স্টেশন আসতেই। বাইরে বেরিয়ে একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাব। কিন্তু হাঁটছি তো হাঁটছি, রাস্তা আর শেষ হয় না! দোকান দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করি। কেউ মাথা নাড়ে, বোঝাতে চায় জানে না। কেউ ফ্রেঞ্চ-এ কিছু বলে। যার অর্থ আমরা বুঝি না। শেষে একজন বললেন আমরা ভুল করে আগের স্টেশনে নেমে পড়েছি। মাথায় বজ্রাঘাত! তাহলে উপায়? একটা মাত্র মেট্রো স্টেশনের দূরত্ব ক্যাব যেতে যায় না। আর অন্য উপায়ও নেই কোনও। অতএব হন্টন। প্যারিসের সাজানো রাস্তা, চমৎকার ফুটপাথে সুবেশা নারী-পুরুষ। তাঁদের বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে এক হাতে ঢাউস স্কাইব্যাগ আর অন্য হাতে ক্যারি অন ট্রলি ব্যালেন্স করে টানতে টানতে লাইন দিয়ে আমরা পাঁচজন যখন YMCA তে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন মনে হচ্ছিল হাঁটুর তলার অংশটা বোধহয় খুলে বেরিয়ে গেছে! কিন্তু তখনও কাজ বাকি। নিয়মকানুন মিটিয়ে ঘরে গিয়ে বিছানার আরামে নিজেকে ছেড়ে দিতে দিতে মালুম হল কিছু না খেলেই নয়! তাই আবার ছোটা সামনের সুপার মার্কেটে।
সুপার মার্কেটে আর এক কান্ড! এটা ওটা কিনতে কিনতে চোখ পড়ল ওয়াইনের দিকে। থরে থরে সাজানো।
সৌর বলল, "একটা কিনে নিয়ে যাই।"
রিনি বলল,
"আমিও খুঁজছি।" একটা লালচে গোলাপী বোতল তুলে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে বলল,
"এইটা বেশ ভাল হবে।"
অনি জিজ্ঞেস করল,
"কী করে বুঝলি?"
" আহা দেখছিস না, কি সুন্দর রংটা।"
"তুই রং দেখে ওয়াইন কিনতে চাস!!! ওঃ ভগবান! এ কাকে এনেছি সঙ্গে!"
***********
ঠিক হল বিকেলবেলা আইফেল টাওয়ার দেখতে যাওয়া হবে।
টিকিট কেটে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিদর্শিত স্মৃতিস্তম্ভ এই টাওয়ার। সারা দুনিয়া একে আইফেল টাওয়ার বলে জানলেও ফরাসীরা বলেন Tour Eiffel। একেবারে শুরুর দিকে কিন্তু ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণীর শিল্পী আর বুদ্ধিজীবীরা ১০৬৩ ফুট উচ্চতার সম্পন্ন, লোহার ঝাঁঝরির মত নির্মাণশৈলীর এই টাওয়ারটিকে মোটেই পছন্দ করেননি। কিন্তু ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল ১৮৮৯ সালে ফরাসী ইঞ্জিনিয়ার গুস্তাভ আইফেল-এর পরিকল্পনা করা এই আইফেল টাওয়ার।
তিনটি স্তরে ভাগ করা এই টাওয়ার। প্রথম আর দ্বিতীয় স্তরে রেস্টুরেন্ট। তৃতীয় স্তরে Observatory Deck। মনোরম আবহাওয়া। বসুবিশাল চত্বর। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন অগুনতি মানুষ। এতদিনের দেখা শুধু ছবিতে। সামনে দাঁড়ানোর অনুভূতি আলাদা। যেটুকু ছবিতে ধরা যায়, বন্দী করলাম ক্যামেরায়। আর যা ধরা যায় না, প্রকৃতি আর পরিবেশের সব রঙ, গন্ধ, সৌন্দর্যটুকু মনের ফ্রেমে সাজিয়ে নিয়ে এগোতে থাকলাম লাইনের পিছু পিছু।
অবজার্ভেটরি ডেক থেকে দেখা বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধের প্যারিস বড় অপরূপ। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়না। প্যারিস শহরের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বহে গেছে সেইন নদী (River Seine)। শেষ বিকেলের রোদ নরম হয়ে এল। সূর্যাস্ত হল। মুঠো মুঠো রঙ কে যেন গুলে দিল সেইনের জলে। শম্বুকগতিতে এগোচ্ছে লাইন। চলতে চলতে সকলেই প্যারিসের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করায় তৎপর। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সন্ধে গড়িয়ে রাতের দিকে এগোতেই লক্ষ আলোর মালায় ঝলমল করে উঠল আইফেল টাওয়ার।
মিরাবো সেতুর তলা দিয়ে সেইন বয়ে চলে অনিবার
আর আমাদের যত প্রেম
স্মৃতি হবে কি জাগাতে তার
সুখ দেখা দিত দুঃখের জ্বালা জুড়োলে বারংবার
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন
হাতে হাত রেখে এসো মুখোমুখি থাকি শুধু দুজনায়
আর আমাদের বাহুর
সেতুর তলা দিয়ে বয়ে যায়
নিরবধি যত দৃষ্টির ঢেউ অবসিত জড়িমায়
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন
প্রেম চলে যায় যেন জলধারা ছুটে যায় তরতর
প্রেম চলে যায় এ জীবন
যেন কিরকম মন্থর
দুরাশার মায়া যেন কিরকম তীব্র ভয়ংকর
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন
পার হয়ে যায় দিনগুলি আর সপ্তাহ হয় পার
গতকাল আর গত যত
প্রেম ফিরে আসেনা তো আর
মিরাবো সেতুর তলা গিয়ে সেন বয়ে চলে অনিবার
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন।
(গীয়ম আপলোনীয়ারের Le Pont Mirabeau মিরাবো সেতু’, পুষ্কর দাশগুপ্ত-র অনুবাদে)
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে
আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে
বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে।
কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও
জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি
বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।