প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫

 

পুরনো অ্যালবাম

কেয়া মুখোপাধ্যায়


(১০)

(আগের অংশ) ১৯৩৭ এর এপ্রিল মাস। ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে স্পেনে। ২৬ তারিখে ফ্যাসিস্ট জেনারেল মোলার সৈন্যরা ঘিরে ফেলল বাস্ক সেনাদের। নিরূপায় বাস্ক সেনারা রাজধানী বিলবাওয়ের দিকে পিছিয়ে যেতে লাগল। এমন সময় ফন্ রিকটোফেনের জার্মান বিমানবাহিনী টার্গেট হিসেবে বেছে নিল একটি ছোট শহরকে। বিলবাওয়ের সঙ্গে তুলনায় শহরটির সামরিক গুরুত্ব তেমন কিছু নয়। কিন্তু শহরটি ঐতিহাসিক। সোমবার, ২৬ এপ্রিল শহরটির নিরীহ, নিরস্ত্র নর-নারী-শিশুর ওপর নেমে এল এক চরম অমানবিক আঘাত। নিরন্তর বোমাবর্ষণ।

২৭ এপ্রিল। ফরাসি কাগজ Ce Soir ছাপল একটা সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রাম। বিলবাও থেকে Ce Soir-এর সংবাদদাতার পাঠানো টেলিগ্রামে লেখা ছিল, এই নৃশংস কান্ড স্পেনের গৃহযুদ্ধের ‘সবচাইতে বিধ্বংসী ও ভয়াবহ বোমাবর্ষণ’।

২৮ এপ্রিল। কমিউনিস্ট সংবাদপত্র L’ Humanite জানাল: ‘হিটলার আর মুসোলিনির এরোপ্লেন থেকে এক হাজার বিস্ফোরক বোমা শহরটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।’ প্রতিবেদনের সঙ্গে ছিল নিহত নারী ও শিশুদের ক্লোজআপ ছবি। ক্রমশ আরও বিস্তৃত বিবরণ এসে পৌঁছল প্যারিসে।

স্পেনের বার্সেলোনার এক শিল্পী তখন প্যারিসে। স্বদেশ থেকে নির্বাসিত। তাঁর মা আর পরিবার তখনও স্পেনে। বন্ধুদের অনেকেও সেখানেই। খবরগুলো পড়ছেন তিনি। মনে মনে তুমুল আলোড়ন।

এর কয়েকমাস আগের কথা। জানুয়ারিতে প্যারিসে নির্বাসিত স্প্যানিশ সরকারের তরফ থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্যারিসের আগামী ‘বিশ্বমেলা’তে স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নের জন্য একটি ম্যুরাল বা দেয়ালচিত্র আঁকার জন্য। তাঁর বন্ধু ইওসেপ লুইস সের্ত আমন্ত্রণকারী প্রতিনিধিদের নেতা। আর তিনিই স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নের প্রধান স্থপতি। এতদিন কাজটায় খুব একটা আগ্রহ ছিল না তাঁর। এর আগে একটি বিরাট পর্দার কাজ ছাড়া এত বড় ম্যুরালের কাজও তিনি করেননি। কিন্তু এখন একটা সঙ্কল্প যেন একটু একটু করে দানা বাঁধছে। বোমাবর্ষণের চারদিন পরেই শুরু হল কাজ। রাতে জেগে থেকে। শেষ হল জুন মাসে।

আগাগোড়া সাদা-কালো ছবি। বর্ণালীর বাহাদুরি নেই। তবু সেই সাদা-কালোর ভেতর থেকে শোনা যায় মানবতার সুতীব্র আর্তনাদ। অন্য কোনো রং সে যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলতে পারত না। ধ্বংস হয়ে যাবার আগে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত শহরটা ছিল প্রায় দশ হাজার লোকের বাসভূমি। ২৬ শে এপ্রিলের পর সেখানে শুধুই শূন্যতা। প্রায় ছাব্বিশ ফুট দীর্ঘ এবং বারো ফুট প্রশস্ত ছবিতে বিধ্বস্ত, পুড়ে যাওয়া শহরের কোনো চিহ্নই আবিষ্কার করা যায় না। নেই দুপক্ষের সংঘর্ষের সরাসরি উপস্থাপনা। তবু এ ছবি কথা বলে। প্রতীকী অবয়বের আড়ালে মানুষের যন্ত্রণার নির্যাসটুকু তুলে ধরে। আর প্রতিবাদ করে। মানুষের সৃষ্টি করা যন্ত্রণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠ হয়ে ওঠে।
‘গোয়ের্নিকা’। একটি ছোট শহর। একটি আলোড়ন তোলা শিল্পকর্ম। শিল্পী পাবলো পিকাসো।

বিংশ শতাব্দীর সেরা চিত্রকরদের অন্যতম পিকাসো। চিত্রকলা আর ভাস্কর্যে উত্তর আধুনিকতার জনক। পিকাসো বলেছিলেন, চিত্রশিল্প হলো এমন এক মিথ্যা, যা আমাদের সত্যিকে উপলব্ধি করতে শেখায়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ গোয়ের্নিকা।

পিকাসোর সবচেয়ে আলোচিত এ ছবির অন্তত ন’টি চেহারাকে চেনা যায়। চারটি নারী, একটি শিশু, এক যোদ্ধার মূর্তি, একটি বৃষ, একটি অশ্ব এবং একটি পাখি। এই নারীরা ভীত। নিষ্ফল আক্রোশে আর তীব্র ঘৃণায় চিৎকার করছে তারা। মানবতার অসহায় নিরপরাধ মানব সভ্যতার  প্রতীক পিকাসোর এই নারীরা। চার দিকে ধ্বংসের মাঝে  এক মা যেন আলো নিয়ে এগিয়ে আসছেন। কিউবিস্ট ধাঁচ ছবি জুড়ে। একমাত্র পুরুষটিও পূর্ণ মানব নয় – অর্ধেক ভাস্কর্য এবং অর্ধেক মানুষ। যেন এক খন্ডিত মানবসন্তান অসহায়-অচেতন হয়ে নিচে পড়ে আছে। শিল্পীর অবচেতনের রাজনৈতিক আর শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রকাশ পিকাসোর গোয়ের্নিকা।

প্যারিসের বিশ্বমেলায় স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নে ঢোকার পথেই বাঁদিকে কবি গার্সিয়া লোরকার বিশাল ছবি। আর ডানদিকে গোয়ের্নিকা।  পিকাসোর আরও তিনটি ভাস্কর্যও ছিল। স্পেনে গৃহযুদ্ধের ট্র্যাজেডি তখনো ঘটমান বর্তমান। ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের সংবেদনশীলতায় অসম্ভব ধাক্কা দিয়েছিল গোয়ের্নিকা। বিশ্বমেলার পর শুরু হয় গোয়ের্নিকার বিদেশযাত্রা। প্রথমে লন্ডন। তারপর নিউইয়র্কে। প্রশংসা আর নিন্দার ঝড়- দুই-ই ওঠে গোয়ের্নিকাকে ঘিরে। কিন্তু ক্রমশ সকলেই গোয়ের্নিকা-র মানুষের মনের গভীরে নাড়া দেওয়ার প্রবল শক্তিকে স্বীকার করেন।

পিকাসো তো শুধু ছবি-আঁকিয়ে নন, তিনি একাধারে ভাস্কর, সেরামিক আর্টিস্ট আর ম্যুরালিস্ট। শিল্পের নানা ধারায় তাঁর সৃজনশীলতার প্রকাশ। শিল্পীসুলভ নিখুঁত অবজার্ভেশন। দুর্দান্ত ড্রইং। পিকাসো বলতেন, ছোটবেলায় তিনি ওল্ড মাস্টারদের মতো আঁকতেন। আর বড় হয়ে শিশুদের মতো। তাঁর ছবিতে ছিল শিশুদের সেই স্বাধীন, বেপরোয়া মন। রিয়ালিজমের মূল সুরের অর্জন তাঁর ছোটবেলাতেই। তারপর বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে চলল নানা ভাবে ছবিকে ভাঙার কাজ। নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। এসবের পাশাপাশি নাটক লিখতেন, সঙ্গে ছোট ছোট কবিতাও। অসম্ভব জীবনীশক্তি নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিল্পচর্চা করে গিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে দারুণ বর্ণময় এক চরিত্র। প্যারিস মানে পিকাসো-ও।


ম্যুজে ন্যাশনাল পিকাসো-প্যারিস

৫ রু দ্য থরিগনি-তে ম্যুজে পিকাসো। এখন নতুন নাম ম্যুজে ন্যাশনাল পিকাসো-প্যারিস। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। ইউরোপের তিনটি বিখ্যাত পিকাসো মিউজিয়ামের একটি প্যারিসে। অন্য দুটি মাদ্রিদ আর অ্যান্টিব-এ। সপ্তদশ শতকের সুবিশাল হোটেল সালে-তে রয়েছে পিকাসোর স্কেচ, স্কাল্পচার, সেরামিক-এর কাজ, অসামান্য ছবির সংগ্রহ। প্রায় পাঁচ হাজার কাজ। হাল্কা হলুদ বেলেপাথরের রঙের প্রাসাদ যেন। গেট পেরিয়ে সবুজ মখমল-মোড়া লন। শ্বেতপাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। অপূর্ব নকশা-করা তার রেলিং-এ। সুন্দর ইন্সটলেশন। পিকাসোর কাজের বিভিন্ন পর্যায়কে খুঁজে পেলাম। আর অনুভব করতে পারলাম শিল্পীর অসম্ভব মানসিক শক্তি। একটি ছবি মানে তো শুধু বিষয় নয়। শিল্পীর মনন, নান্দনিকতা – সব কিছুর অনুভব নিয়ে সে ধরা দেয়। পিকাসোর ছবি- তা সে ল্যান্ডস্কেপই হোক কিংবা মানুষের মুখ- সেগুলি যেন নান্দনিকতা আর শক্তির সমাহার।
একেবারে গোড়ার দিকে ছবিগুলি বাস্তবধর্মী । এর মূল সংগ্রহ অবশ্য মাদ্রিদের মিউজিয়ামে। এর পরের পর্যায়টি ‘ব্লু পিরিয়ড’। জীবনে চরম দারিদ্র। রেস্তোরাঁয় খেতে আসা রুগ্ন, জীর্ণ চেহারার গরিব মানুষের ছবি আঁকতেন তিনি। এ ছবিগুলো ছিল মূলত নীল রঙে আঁকা। দুঃখকে যেন দেখতে পাওয়া যায় ছবিতে, স্পর্শ করা যায়। তখন থেকেই শিল্পমাধ্যমের ওপর তাঁর ক্ষমতা, প্রতিভা ক্রমশ স্বীকৃতি পেতে থাকে।

এর পরে এল ‘রোজ পিরিয়ড’। গোলাপি রঙা সময়। নানা রঙের প্রাচুর্য ছবি জুড়ে। স্প্যানিশ সার্কাস, সেখানকার হার্লেকুইন, ক্লাউন, সার্কাসের নানা কলাকুশলী, রিঙের খেলা – এসবই তাঁর ছবির বিষয়। এক-একটা পর্যায়কে ভেঙে আর একটা পর্যায়ে গিয়েছেন পিকাসো। এ যেন এক বাঁধনহারা সৃষ্টিশীলতা।  সব সময়ই নতুন কিছু খোঁজার প্রয়াস।  নিজে অবশ্য বলতেন, ‘আমি কিছু খুঁজি না, আমি পেয়ে যাই।’ সেজাঁ-র হাত ধরে ততদিনে ইউরোপে এসেছে কিউবিজম। পিকাসো তাঁর ছবিতে কিউবিজম-এর সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন নিজস্ব স্টাইল।  পিকাসোর নিজস্বতার স্বাক্ষর এক একটি ছবি।


দ্য পাইপস অফ প্যান

La Célestine, “Les Demoiselles d’Avignon”, Man with Guitar, Man with Mandolin, Women at a Fountain, The Pipes of Pan- একটার পর একটা অবিশ্বাস্য ছবি।  Woman in the Garden, the Bull’s Head, the Man with Sheep, Girl Skippin, The Nannygoat, The Baboon and Young – দুর্দান্ত সব ভাস্কর্য। দেখতে দেখতে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এর সঙ্গে আছে পিকাসোর সংগ্রহ করা সেজাঁ, দেগা, মাতিস- প্রমুখের কাজও। ‘ওয়ার্ল্ড আর্ট’-এর পিকাসোর অবদান যে কতখানি বৈপ্লবিক আর অনিবার্য, তাঁর অবস্থান যে কতটা তীব্র – ম্যুজে পিকাসোতে গিয়ে তার খানিকটা অন্তত অনুভব করতে পারলাম।

বেরিয়ে এসে দেখি  ঝকঝকে আকাশ। হাল্কা রোদ্দুর। সকালে যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল, সে উধাও। সবুজ আর হলুদ মেশা উজ্জ্বল রঙের একটা  হপ-অন্‌ হপ-অফ্‌ বাস-এ উঠে পড়লাম চটপট।  বাসের ছাদে বসে সুন্দরী পারীরপথে পথে ঘোরা রীতিমত রোম্যান্টিক ব্যাপার।  ঘুরতে ঘুরতে Champs Elysees Avenue। রূপসী পারীর সুন্দরতম পথ। এরই পশ্চিমে  ফ্রান্সের বিখ্যাত Arc De Triomphe আর পুবদিকে  বিশ্বনন্দিত ল্যুভর- Louvre Museum। দুনিয়ার সব নামী-দামী ব্র্যান্ডের শোরুম-ও এই রাস্তায়। দুদিকে প্রায় রাস্তার সমান প্রশস্ত ফুটপাত। সারি দেওয়া গাছ। মাঝে মাঝেই সাজানো চারিদিক খোলা অস্থায়ী রেস্তোরাঁ ও পানশালা।  লোকজন আয়েস করে খাচ্ছে আর মেতে আছে আড্ডায়। অগুনতি লোক চলছে ফুটপাত দিয়ে। খুশি আর আনন্দের ঝরণা যেন চারদিকে!
রিনি বলল,
“মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই! প্যারিসের প্রেমে পড়ে গেছি...”

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।