ভ্রমণ কাহিনী

অগাস্ট ৩০, ২০১৬
পুরনো অ্যালবাম
কেয়া মুখোপাধ্যায়
(২০)
(আগের অংশ) কনফারেন্স ব্যাপারটা অদ্ভুত। এমনিতে যে দিব্যি হাসিখুশি, কনফারেন্সে গেলে সেও স্যুট পরে বা একখানা ব্লেজার চাপিয়ে গম্ভীর হয়ে বেশ ভব্যিযুক্ত হাবভাব দেখিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দেশে থাকতে, আমাদের ইন্সটিট্যুটের আয়োজনে মাঝে মাঝেই নানা কনফারেন্স হত। অন্য রাজ্য থেকে তো বটেই, বিদেশিরাও আসতেন। আর কোনও ব্যবস্থা থাকুক বা না থাকুক, কনফারেন্স মানেই যে কনফারেন্সের নামের ছাপ্পা মারা এক পিস কালো ব্যাগ, ব্যাগের পেটের ভেতর একটা পুঁচকে প্যাড, একখান পেন আর গলায় মাদুলির মতো ঝোলানো পরিচয়পত্র, সে আগেই দেখেছি। এই কনফারেন্স পাওয়া গেছে ধূসর রঙের ব্যাকপ্যাক। গলার মাদুলি নীল রিবনের। চারদিকে কিলবিল করা মানুষদের মধ্যে গলায় নীল রিবন আর পিঠে ধূসর ব্যাকপ্যাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে কে কে আমাদের সমব্যথী।
প্রথম সন্ধের রিসেপশনন ছাড়া খাওয়ানোর কোনও ব্যবস্থা রাখেননি আয়োজকরা। দেশের ঠিক উল্টো ছবি। এই প্রথমবার ইন্সটিট্যুটের জন্যে মন কেমন করছিল আমাদের। আহা! কোথায় সেই ধবধবে সাদা টেবিল কভার পাতা লম্বা টেবিল আর তাতে থরে থরে সাজানো সুখাদ্য! এক একদিন এক একরকম মেনু! তার ওপর আমরা ইন্সটিট্যুটেরই স্কলার বলে আলাদা ডেকে ডেকে ভাল আইটেম প্লেটে তুলে দেওয়ার খাতির। এ এক আজব জায়গা। প্রথম সন্ধেয় আঁশটে সি-ফুডের রিসেপশনের পর যাও, নিজেরা চরে খাও কেস। কোনও মানে হয়! ওদিকে হলের ভেতরে কেউ কেউ পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেখিয়ে তেড়ে ফ্রেঞ্চ বলে যাচ্ছেন। সে আর এক যন্ত্রণা। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থায় মাঝে মাঝেই ঘড়ির দিকে তাকাই, আর কতক্ষণ! মুক্তি পেলেই বাঁধ ভাঙা জলস্রোতের মতো বেরিয়ে পড়ে সবাই। অতঃ কিম? নানা রকম আয়োজন বাইরে। পরের পোস্টার সেশনের পোস্টার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কেউ। কেউ লাইন দেন বায়োটেক কোম্পানির স্টলে। খাবার দাবার স্টলও আছে। নামী ফরাসি বেকারি বা রেস্তোরাঁ এসেছে। লাঞ্চের আগে দেখা গেল বেকারির সামনে বিশাল লাইন। কী ব্যাপার? জানা গেল সকালের বেগেত ব্রেড ওরা বিলিয়ে দিচ্ছে দুপুরে। ওই ব্রেড আর ওরা বিক্রি করবে না। বুভুক্ষু কনফারেন্স যোগদানকারীর দল অমনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। শুধু স্টুডেন্টরাই নয়, নামী বিজ্ঞানী থেকে প্রোফেসররাও লাইন দিচ্ছেন। বুক ফুলিয়ে যখন বেরিয়ে আসছেন, তখন কাগজের প্লেটের ওপর বেগেতের ছোটখাটো এক বিন্ধ্য পর্বত। এমনটা যে হয়, ভাবিনি কখনো। ভাবি, ফ্রি-তে পেলেই লোকে এত খাবার নেয় কেন? টাকা যখন দিতে হচ্ছেই না তাহলে খামোখা কম নেব কেন- এই ভেবে? যাইহোক, দেখেশুনে আমরা তো তাজ্জব। বাইরের কাফেতে লাঞ্চ করব ভেবে বেরিয়ে এলাম।
‘উপর থেকে নীচে তাকাও, দ্যাখো,
লক্ষ লক্ষ টুকরো দৃশ্য
নতুন করে ভেঁজে
একটি অসীম রিক্ততাকে
তৈরি করল কে যে।
নোত্রদামের গির্জেটা আর
হোটেল, কাফে, মস্ত টাওয়ার
মিলিয়ে দিচ্ছে মেঘের শান্ত
হাল্কা নীলের তুলি।
মিলায় মিলায় পারির প্রান্ত-
(জুনের দুপুর/ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
রোদ্দুরে কেমন যেন বেড়ানোর হাতছানি। সে হাতছানিকে উপেক্ষা করে সকালের লম্বা লম্বা দুটো সেশনের পর আবার ‘ডেথ বাই পাওয়ারপয়েন্ট’-এর সম্ভাবনার দিকে ছুটে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। তাই আবারও প্যারিস মেট্রোতে সওয়ার।
অলিম্পাসের চুড়োয় বসে জিউস দেখতে পেতেন সারা পৃথিবী। ঠিক তেমনি এক জায়গা আছে প্যারিসের উত্তরে। ছোট্ট এক পাহাড়। মঁ মার্ত্র (Montmarte)। তার চুড়োয় এক দর্শনীয় ব্যাসিলিকা। Basilica of the Sacred Heart of Paris, ফরাসিতে Basilique du Sacré-Cœur। রোমান ক্যাথলিক চার্চ। প্যারিসের সর্বোচ্চ বিন্দু। সেখান থেকে দেখা যায় হাজার বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে ওঠা এই রূপকথার নগরীর রঙিন, আশ্চর্য ইতিহাস।
আমাদের ছোটবেলায় দুটো বইমেলা হত কলকাতায়। ডিসেম্বরের শেষে ক্রিসমাসের সময় পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা আর জানুয়ারির কমলালেবু রোদের দুপুরে কলকাতা বইমেলা। প্রথমটা আর হয় না। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে আজও কলকাতা বইমেলার একটা জায়গা ভারি টানে। সেখানে শিল্পীরা বসে ছবি আঁকেন, গানের সুরের সঙ্গে বেজে ওঠে গিটার আর তার সঙ্গে তুমুল আড্ডা। মঁমার্ত। প্যারিসের মঁ মার্ত্রর অনুপ্রেরণাতেই কলকাতা ময়দানের একটা টুকরো হয়ে উঠত প্যারিস। শিল্প, সঙ্গীত আর আড্ডার মাধুর্যে। মঁ মার্ত্রে দাঁড়িয়ে তাই খুব মনে পড়ছিল কল্লোলিনী কলকাতার কথা। আমার সে শহরে তখন ব্যস্ত সকাল।
মঁ মার্ত্র আসলে পাশাপাশি কয়েকটা গলি। পাথুরে রাস্তায় বিকেলের রোদ্দুর। জমজমাট সেই চত্বরে ছবি এঁকে চলেছেন শিল্পীরা। ছবি আঁকা দেখতে ভিড় জমে শিল্পীকে ঘিরে। কেউ আবার আঁকা ছবির পশরা সাজিয়ে বসেছেন। এ ছবি, ও ছবি দেখতে দেখতে কেউ কিনে নেন একটা। এভাবেই স্মৃতির এক টুকরো প্যারিস তাঁরা নিয়ে যাবেন নিজের শহরে। এদিকে ওদিকে সালঁ, রেস্তোরাঁ। সন্ধেকে স্বাগত জানিয়ে রাস্তার নিয়নবাতি জ্বলার আগে থেকেই সেখানে শুরু হয়ে যায় রঙিন নেশায় ভাসা। হাওয়ায় ভেসে আসে ভারি সুন্দর গীটারের সুর। যে সুরে মন ভিজে যায়। চারদিকে এক অফুরন্ত প্রাণের উৎসব।
মঁ মার্ত্রে গিয়ে মনে পড়ছিল ফরাসি শিল্পের জগতে আরেক বিস্ময় তুলুস লোত্রেক-এর কথা। ম্যুজে ডি’অরসে তে লোত্রেকের ছবি দেখেছি। তাঁর জীবন উপলব্ধি না করলে বোঝা যায় না তাঁর ছবির সাবলীল আর শক্তিশালী রেখাগুলোর উৎস কী। যখন একটু একটু করে মানুষটাকে ধরা যায়, তখনই আরো বেশি করে চেনা যায় লোত্রেকের ছবির বলিষ্ঠ রেখা, রঙের আশ্চর্য বিন্যাস।
মাত্র ৩৬ বছরের জীবন। জিনগত অসুখের প্রকোপে লোত্রেকের সারাটা জীবন কেটেছে অসীম শারীরিক ও মানসিক দোলাচলে। ছোটবেলায় পর পর দু'বছর দু’পায়েরই ফিমার ভেঙে গিয়েছিল মাঝখান থেকে। তাই মানুষটির উচ্চতাই আর বাড়লো না। আটকে গেলেন সাড়ে চার ফুটে। কিন্তু ক্ষুদ্রকায় এই মানুষটিই ছবিকে নিয়ে গেলেন অসামান্য এক উচ্চতায়।
কাউন্টের ছেলে লোত্রেক স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে না পেরে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন রঙের জগতে, ছবির দুনিয়ায়। তাঁর অনেক ছবিই আঁকা মঁ মার্ত্র আর মুল্যাঁ রুজে বসে। এঁকে চলেছেন একের পর এক মানবী শরীর। সেইসঙ্গে তাদের ঘিরে সামাজিক অনুষঙ্গ। রেখায় অবাক করা বোল্ডনেস। সে যেন তাঁর মেজাজের মতোই একরোখা। অল্প ক’টি বলিষ্ঠ রেখায় ফুটে উঠছে সেসময়কার ডাকসাইটে সব সুন্দরীদের শরীরী বিভঙ্গ। দেহোপজীবিনীদের উন্মত্ত ব্যালে নাচ তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠছে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা আর অসামান্য ভারসাম্যে। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট যুগের সমকালীন শিল্পীরা মুগ্ধ ছিলেন তাঁর ড্রয়িং-এ। নিজের শরীরী গঠনের জন্য সমাজের কাছে হাস্যাস্পদ লোত্রেক মানুষের ফিগার-স্কেচে অর্জন করেছিলেন ঐশ্বরিক দক্ষতা।
শেষ জীবনে অনেকদিন আর ছবিই আঁকতে পারেননি লোত্রেক। দু’পা অকেজো হয়ে গেছে ক্রমশ। অনিয়ন্ত্রিত, বোহেমিয়ান জীবনযাপনে দু-দু’বার হৃদরোগ। শরীরে সিফিলিসের সংক্রমণ। তবু সেই অপরিসীম শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁর ছবির সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজারের ওপর। তার মধ্যে ৭৩৭ টি ক্যানভাস অনায়াসে তাঁকে নিয়ে যায় প্রতিষ্ঠার শিখরে। তাঁর শিল্পসৃজনকে স্বীকৃতি দেয় ইতিহাস। স্পেস সৃষ্টির ক্ষেত্রে লোত্রেকের ছবিতে জাপানী শিল্পের প্রভাব পড়েছিল। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আর্টকে সেটাই খোঁজ দিল নতুন দিগন্তের।
মুল্যাঁ রুজ ধরা দিয়েছে লোত্রেকের ক্যানভাসজুড়ে। শুধু লোত্রেকেরই নয়, ভ্যান গঘেরও মুল্যাঁ রুজের জীবন শিল্পের দুনিয়ায় যুক্ত করেছে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। প্যারিসের বিখ্যাত নিশিবাসরের কেন্দ্রবিন্দু, পৃথিবীবিখ্যাত হেরিটেজ ক্যাবারে এই মুল্যাঁ রুজ। ১৮৮৯ সালে প্রথম তৈরি হয়েছিল। প্যারিসে বেড়াতে গিয়ে মুল্যাঁ রুজের ফেরি শো আর ফ্রেঞ্চ ক্যানক্যান ডান্স না দেখতে পেলে অনেকেরই খুব আফসোস হয়। মুল্যাঁ রুজ নিয়ে ছবিও হয়েছে। একবার ১৯৫২-তে। পরে ২০০১-এ আর একবার। সেটা ছিল নিকোল কিডম্যান অভিনীত এক হলিউডি মিউজিক্যাল।
সার্কাস অনুপ্রাণিত এক বিশেষ ধরনের বিনোদনই ছিল মুল্যাঁ রুজের মূল উদ্দেশ্য। প্রথম দিকে মুল্যাঁ রুজে যাঁরা পারফর্ম করতেন, তাঁরা ছিলেন মূলত দেহোপজীবিনী। উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত সাহিত্যিক-শিল্পীদের প্রেরণার উৎস ছিলেন মু্ল্যা রুঁজের মোহময়ী সুন্দরীরা। মুল্যাঁ রুজের মূল আকর্ষণ স্বল্প পোশাকে শরীরী আবেদনমূলক নাচ। স্ট্রিপটিজ এবং বার্লেস্ক নাচই এই ক্যাবারের বৈশিষ্ট্য। ১৯১৫ সালে পুড়ে গিয়েছিল মূল বাড়িটি। এখনকার মুল্যাঁ রুজ তার পরে তৈরি হয়। ২০১৪ সালে মু্ল্যাঁ রুজ পা দিল ১২৫ বছরে।
ছবিতে দেখা, লাল উইন্ডমিলের চেহারার সেই বাড়িকে ঘিরে ফরাসি নিশিবাসরের মৌতাত ঠিক কেমন, তা দেখতে অন্তত কাছাকাছি কি একবার ঘুরে আসব না? ভাস্কর জাঁ ব্যাপতিস্ত পিগাল-এর নামে জায়গাটার নাম পিগাল। সেই মেট্রো স্টেশনে নেমেই চোখে পড়ল বাড়িটা। দীর্ঘ লাইন মুল্যাঁ রুজের সামনে। রাস্তার দু’দিকেই একের পর এক স্ট্রিপটিজ বার। মোহময়ী সুন্দরী প্যারিস ঝলমল করে উঠেছে নিয়ন আলোয়। হাসির ফোয়ারার মিশে যাচ্ছে ঝিলমিল কটাক্ষ, উচ্ছল বিভঙ্গ। সম্ভাব্য খদ্দেরদের ডাকাডাকি, চটুল ইশারায় মোড়া সন্ধে জুড়ে ফরাসি ওয়াইনের মদিরতা।
এ ক’দিনের চেনা প্যারিসের ভেতরে এ এক অন্য প্যারিস। এখানে শুধু অবিরাম আনন্দলহরী।
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।