ভ্রমণ কাহিনী
মে ৩০, ২০১৫
পুরনো অ্যালবাম
কেয়া মুখোপাধ্যায়
(৪)
(আগের অংশ) ১৮৭৭। প্যারিসের ভীষণ ব্যস্ত গার সাঁ লাজা (Gare Saint Lazare) স্টেশনে দামী পোশাকে সেজেগুজে হাজির এক যুবক। স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে চান। সচরাচর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া হাঁকিয়েই দেওয়া হয়। অমন হুট বলতেই তো আর দেখা করা যায় না। কিন্তু একে পোশাক-আশাক আর চেহারায় সম্ভ্রান্ত, তার ওপর আবার পরিচয় দিচ্ছেন বিশ্ববিখ্যাত আর্টিস্ট বলে। হোক না প্যারিস। শিল্পের শহর। তাই বলে কি স্টেশনের কর্মচারীরাও সব আর্টিস্টকে চিনে বসে আছেন? তাঁদের কাজ তো ইঞ্জিন আর কয়লা-টয়লা নিয়ে। শেষে ঝামেলা এড়াতে যুবকটিকে সোজাসুজি স্টেশন মাস্টারের অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
তা কি চান তিনি? বেশ অভিনব আবদার। একদিনের জন্য কয়েকটা ট্রেন একটু দেরীতে ছাড়তে হবে। আর ওই সব ট্রেনগুলোর ইঞ্জিনগুলো একসঙ্গে চালু করে দিতে হবে, যাতে চারদিকটা বেশ বাষ্পে ঢেকে যায়।
স্টেশন মাস্টার ভাবলেন, পাগল নাকি! সোজাসুজি বলে দিলেন, “অসম্ভব। ওসব হবে না।”
“হুম। তাহলে আর কি করা! মনে হচ্ছে এই স্পেশ্যাল পেইন্টিংটা গার দ্যু নর (Gare du Nord) স্টেশনেই করতে হবে আমাকে। ওখানকার স্টেশন মাস্টারকে বেশ আগ্রহীই মনে হচ্ছিল। আসলে আমারই ইচ্ছে ছিল আপনার এখানে...। যাক গে, চলি তাহলে। থ্যাঙ্ক ইউ।”
গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলে উঠেই পড়ছিলেন যুবক। স্টেশন মাস্টার বসতে অনুরোধ করলেন। আসলে বেশ দ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন তিনি গার দ্যু নর স্টেশনের কথা শুনে। ছেলেটি ওখানে গিয়ে ছবি আঁকলে তো তাঁর স্টেশনের জগদ্বিখ্যাত হবার এই দারুণ সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাবে! একদিন কটা ট্রেন একটুখানি নয় দেরিতেই ছাড়ল! আর ইঞ্জিনগুলো একসঙ্গে চালু করা...সেই বা কি এমন কঠিন কাজ?
পরের দিন দেখা গেল, বিরাট ক্যানভাস আর সঙ্গে রং-ব্রাশ ইত্যাদি সব সরঞ্জাম নিয়ে গার সাঁ লাজা স্টেশনে ঢুকছেন যুবকটি।
ইনিই ক্লদ অস্কার মোনে (Claude Oscar Monet)। তখন তিনি মোটেই বিশ্ববিখ্যাত নন, প্যারিসেই লোকে তাঁকে চেনে না সেভাবে। ওগুলো সব বানানো কথা। আর ওই পোশাক টোশাকও ধার করা। সবটাই ‘ইমপ্রেস’ করার জন্যে।
ফ্রান্সে প্রথম ট্রেন চলেছিল এই ঘটনার কয়েক দশক আগে। কিন্তু তখন গোটা দেশ জুড়ে রেলওয়ে ব্যবস্থা চালু করার মত অর্থনৈতিক জোর ছিল না ফ্রান্সের। ইংল্যান্ড, জার্মানী, বেলজিয়াম কি সুইজারল্যান্ডের থেকে এ ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে তখন ফ্রান্স। অনেক পরে আস্তে আস্তে দেশ জুড়ে রেলওয়ে চালু হল। আর তার পরেই মোনে-র ইচ্ছে হল গার সাঁ লাজা স্টেশনের ভেতরের অংশটা ছবিতে আঁকবেন।
ভেতরের অনেক জায়গায় তখন সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু মোনে-র জেদ, ওখানে থেকেই আঁকতে হবে। বন্ধুরা বোঝালেন ওসব হবে না। ওখানে গিয়ে ছবি আঁকতে গেলে ওপর মহলের নির্দেশ লাগবে। অনেক ফরম্যালিটি। অন্তত মাসখানেকের ঝক্কি। কিন্তু মোনে নিজের জেদে অটল। শেষে বন্ধু রেনোয়া তো বলেই দিলেই মোনে-র মাথাটা নির্ঘাৎ গেছে! কিন্তু মোনে-র মাথায় অন্য প্ল্যান। ধার করা দামী পোশাকে সেজেগুজে গিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে একদিনেই সব ব্যবস্থা করে ফেললেন।
আঁকা হল ছবি। গার সাঁ লাজা স্টেশন সিরিজ। মোট এগারোটা ছবি। সে বছরই তার সাতটা দেখা গেল একজিবিশন-এ। বাকিটা ইতিহাস।
এর বছর কয়েক আগে চার্লস গ্লেয়ারের আর্ট স্কুলে শিখতে গিয়েছিলেন মোনে। ঠিক সেই সময়েই বিভিন্ন জায়গা থেকে ওই আর্ট স্কুলে এসে জুটছিলেন তার মত আরো তিনজন ক্ষ্যাপাটে তরুণ। পিয়ের অগুস্তে রেনোয়া, ফ্রেডরিখ বাজিল আর আলফ্রেদ সিসলী। ক্রমশ তাঁরা বুঝতে পারছিলেন তাঁদের পছন্দ আর ভাবনাগুলো খুব মেলে। প্রথাগত শিল্পের নিয়ম মেনে পৌরাণিক কাহিনী কিংবা ধর্মের মহান প্লট নিয়ে ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে না কারোরই। তাঁদের ছবিতে ক্রুশবিদ্ধ যিশু নেই। মাউন্ট অলিম্পাসের দেবদেবীরাও অনুপস্থিত। এমনকি কোনও রাজ-দরবার বা ঐতিহাসিক যুদ্ধ-টুদ্ধ-ও নেই।
তাহলে কী আছে? কখনো ধানক্ষেতে কাজ করা চাষীকন্যার গল্প, কখনো ছুতোরের কাজ, এমনকি নিজের বান্ধবীর ছবি আর প্রকৃতি ফুটে ওঠে তাঁদের ক্যানভাসে। একেবারে নতুন ফর্ম আর টেকনিক। ব্রাশের স্ট্রোক আর রং-এর ব্যবহারও অন্যরকম। পরিচয় হল সমমনস্ক আরো কয়েকজনের সঙ্গে। এদুয়ার্দ মানে, কামিল পিসারো, এদগার দেগা।
আকাদেমি দ্য বুজা (Académie des Beaux) তখন ফ্রান্সের শিল্পের ব্যাপারে শেষ কথা। মনে আর তাঁর বন্ধুরা সকলে নতুন রকম ছবি এঁকে পাঠাতে থাকেন অ্যাকাডেমির স্যালন এক্সিবিশনের জন্যে। আর অ্যাকাডেমি সেগুলো বাতিল করতে থাকে। অ্যাকাডেমির কাজ শিল্পের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। নতুন ক’জন এসে শিল্পের মত গুরুগম্ভীর ব্যাপারে নানা হালকা বিষয়ের ছবি এঁকে ফাজলামি করলে অ্যাকাডেমি মানবে কেন?
শেষে অতিষ্ঠ হয়ে ১৮৭৩-এ মোনে আর বন্ধুরা মিলে তৈরি করলেন Société Anonyme Coopérative des Artistes Peintres, Sculpteurs, Graveurs। এই কোঅপারেটিভ-এর আয়োজনেই হবে নিজেদের একেবারে ইন্ডিপেন্ডেন্ট একজিবিশন। কোন শিল্পী ৬০ ফ্রাঁ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করালেই তাঁর ছবি সাজানো থাকবে একজিবিশনে।
১৮৭৪ এর এপ্রিল থেকে মে- একমাস ধরে একজিবিশন চলল তিরিশজন শিল্পীর ছবি নিয়ে। নতুন এক শিল্পের ধারার জন্ম হল। মনে-র “Impression, soleil levant” (Impression, Sunrise) ছবির নাম থেকে এই নতুন ধারাকে পৃথিবী চিনল ‘ইম্প্রেশনিজম’ নামে। নতুন ফর্ম। প্রচুর সমালোচনা। তবু মানুষের ভাল লাগতে শুরু করল।
এর কিছু পরেই মনে-র ওই গার সাঁ লাজা স্টেশন অভিযান। আর বিখ্যাত স্টেশন সিরিজের জন্ম। ওই সিরিজ আঁকতে গিয়ে প্রায় মারাই পড়ছিলেন ভদ্রলোক। মোনে-র ওপর তৈরি ডকুমেন্টারীর কথায়,
"Monet could have died painting his station pictures, choking on carbon-monoxide and smoke. But he was an Impressionist. And Impressionists don’t take shortcuts."
প্যারিসে যাব আর আর্ট মিউজিয়ামে যাব না, তা কি হয়? বিশেষ করে এরকম সব শিল্পের জন্যে প্রাণ দিতে বসার গল্প জানার পর? আমরা পাঁচজনে প্যারিস যাচ্ছি- এটা ঠিক হয়ে যাবার পর প্যারিসের কোথায় কোথায় যাব, এ নিয়ে রোজই আমাদের চায়ের ভাঁড়ে তুফান। ইন্সটিট্যুটের বাইরে বৌদির চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে তুমুল আলোচনা। আর বাড়ি ফিরেই হাতে বই কি ইন্টারনেট সার্ফিং। মিউজিয়াম আর দেখবার বিশেষ জায়গার লিস্ট করার দায়িত্ব সৌর আর আমার। অনিও হেল্প করছে। রিনি নিজেই বেছে নিল যেটা সবচেয়ে ভালবাসে। প্যারিসের কোথায় কোথায় ভালো শপিং করা যাবে। সঙ্গে সুমনা।
আগের দিনই ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি থেকে তুলে এনেছি The Great Book of French Impressionism. তাতেই মোনে-র ওই স্টেশন সিরিজের গল্প। পড়ে টড়ে আমি তো রীতিমত ইম্প্রেসড্। রোববারের সকাল মানেই লুচি। সকালবেলা সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছি লুচি সহযোগে নতুন জানা গল্পটা সবাইকে বলবো বলে, দেখি সিঁড়ির মুখে বাবা দাঁড়িয়ে, হাতে খবরের কাগজ। বললেন,
“আচ্ছা, আমাদের সঙ্গে বাজেট নিয়ে আলোচনা করোনি, সে নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু ইন্সটিট্যুটে যাঁরা প্রায়ই ট্রাভেল করেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করেছ নিশ্চয়ই! তোমাদের স্যর, কি কৃষ্ণমূর্তিদা বা অন্য সিনিয়রদের সঙ্গে কনসাল্ট করেছিলে তো?
যা করেছি সে যে আমরা পাঁচ মক্কেলই করেছি, অন্যদের একেবারেই পাত্তা-টাত্তা না দিয়ে, সেটা বলা যাবে না। আর নির্জলা মিথ্যে বলার প্রশ্নই নেই। তাই সেফ হল নিজেই আর একটা প্রশ্ন করে ফেলা চটপট।
“বাজেট নিয়ে আমাদের কোন প্রবলেম নেই তো! এমনি কেন মনে হল তোমার হঠাৎ?”
“প্রবলেম না থাকলেই ভালো। সবরকম খরচের এসটিমেট ঠিকঠাক হলে, আর সঙ্গে আরো খানিকটা আন-এক্সপেক্টেড খরচ ধরে থাকলে অসুবিধে হবার কথা নয় অবশ্য... তা না হলে কিন্তু...
“আন-এক্সপেক্টেড খরচ মানে? সে আবার কী?”
“আজকের কাগজটা দেখো। ফরেক্স (Forex), মানে ফরেন কারেন্সি এক্সচেঞ্জ মার্কেট বলছে ইউরোর দাম হঠাৎ ই অনেকটা বেড়েছে। আগামে কদিনে আরো বাড়তে পারে। The exchange rate of a currency versus other currencies is a reflection of the condition of that country’s economy, compared to other countries’ economies। আমাদের দেশের অর্থনীতি জড়িয়ে আছে তো। এখন ইউরোর বিপরীতে টাকার দাম কমছে। ইউরো টাকার চেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। তাই যাবার আগে যখন টাকা দিয়ে ইউরো কিনতে যাবে, এতদিন যা পেতে, তার থেকে সিগনিফিক্যান্টলি বেশ খানিকটা কম ইউরো পাবে।”
উফ!! ঠিক এখনই ইউরোর দাম বাড়তে হল! এবার কী হবে! আরে বাবা, বাজেট করার সময় কি আর ভেবেছিলুম দুম করে ইউরোর দাম এত বেড়ে যাবে! যত্ত ঝামেলা!
সেই প্রথমবার ফুলকো লুচিও যেন বিস্বাদ লাগছিল। কোনরকমে শেষ করে পর পর ফোন। খবরটা সকলেই জেনেছে। ঠিক হল দুপুরে দেখা করে সকলে একবার হিসেব করে দেখি কী দাঁড়াচ্ছে।
দেখা গেল ব্যাপারটা বেশ চাপের। সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে আমাদের ওই টু স্টার হোটেলে। ওই খরচটা কোনোভাবে কমানো গেলে সমস্যা তেমন নেই। কিন্তু রিনি বেঁকে বসল। টু স্টার হোটেল ছাড়া থাকবে না। তাতে যদি নিজেদের খানিকটা বাড়তি খরচ হয় হবে। আমি বললাম, “কৌস্তভকে ফোন করলে হয় না? আমাদের আইটিসি ট্রাভেল হাউসের?”
সৌর বলে বসল,
“ও কি করবে? ও কি তোর ফরেক্স-এর দাম বাড়া-কমা স্টেবিলাইজ করে দেবে?”
এইটাই সমস্যা! তলিয়ে না ভেবে দুম করে বলে দিলেই হল! আইটিসি-তে গিয়ে থেকে দেখছি কৌস্তভ আদিত্য খুব এফিশিয়েন্ট। যথেষ্ট হেল্প করছে। এমনকি, কাউকে কাউকে দিল্লি গিয়ে ভিসার ইন্টারভিউ দিতে হলেও আমাদের দিল্লি যেতে হয়নি। বাড়িতে বসেই ভিসা পেয়ে গেছি। তার জন্য কৌস্তভ নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু আমরা তিনজন মানলেও সৌর আর অনি সেটা স্বীকার করবে না। ইগো, ইগো!!
“নাহ, ফরেক্স নিয়ে ব্যাপার নয়। তবে ও কোন অল্টারনেট অ্যাকমোডেশন ঠিক করে দিতে পারে। তাতে খরচ কম হবে।”
রিনি নিমরাজি, বাকিরা রাজি হল।
পরেরদিন কৌস্তভের অফিস। সব শুনেটুনে হো হো করে হেসে কৌস্তভ বলল, “প্রথমবার প্যারিস গিয়ে স্টুডেন্ট কি স্কলাররা টু স্টার হোটেলে থাকে, জিন্দেগীতে শুনিনি! করেছ কি? এক কাজ কর, তোমরা ওটা ক্যান্সেল করে দাও। YMCA র একটা হোস্টেল আছে। একেবারে হার্ট অফ দ্য সিটিতে। দারুণ ব্যবস্থা। তাতে অনেক টাকা বাঁচবে। সেটা দিয়ে বেড়ানো আর শপিং। কি বল রিনি? হাউ ইজ মাই আইডিয়া?” কৌস্তভের শেষ দুটো বাক্য রিনির দিকে তাকিয়ে।
আমাদের অবাক করে দিয়ে, এই প্রথমবার, রিনি বিনা প্রতিবাদে ঘাড় নাড়ল! রাজি হল!
(৫)
সকাল সাড়ে নটা। রিনি তার সদ্যকেনা স্যামসোনাইট স্কাইব্যাগটার গুণগান করছে। দরজা ঠেলে কৃষ্ণমূর্তিদা ঢুকলেন। কৃষ্ণমূর্তিদা আর আমাদের স্যর একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। চাকরিও মোটামুটি একসঙ্গে। ইন্সটিটিউটের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর কৃষ্ণমূর্তিদা। কিন্তু তবু সকলের সঙ্গে চমৎকার বন্ধুর মত মেশেন। তাই কৃষ্ণমূর্তিদা সম্বোধন। দিব্যি বাংলা বলেন। আর ‘ইয়ার’ কথাটা মুখের লব্জ। তক্ষুণি যেমন চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, “কী চলছে, ইয়ার?”
“এই যে, রিনি ওর নতুন স্কাইব্যাগের ডেসক্রিপশন দিচ্ছে।” ফুট না কাটলে বাড়ি থেকে খেয়ে আসা সকালের ব্রেকফাস্টটা কিছুতেই হজম হত না সৌরর।
“নোতুন? আপনি একটা নোতুন স্কাইব্যাগ কিনলেন ইয়ার? কেনো?”
কৃষ্ণমূর্তিদা সবাইকেই ‘আপনি’ বলেন। স্ত্রী আর ছোট ছেলে দুটোকেও আপনি বলেন কিনা জানার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওঁর বাড়িতে গেলে সকলের সঙ্গেই ইংরেজি বলেন। তাই সেটা আর আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। যাই হোক, রিনি একটু বিভ্রান্ত। প্রশ্নটা ঠিক কেন করা হল, বুঝতে পারে নি।
“কেন মানে? আমার প্যারিস যেতে লাগবে তো! তাই...”
“তাই একটা নোতুন স্কাইব্যাগ কিনে ফেললেন? আপনার বাড়িতে ছিল না? মা-বাবার? সেটা নিলে হত না?”
ব্যস্! সৌর ফিল্ডে নেমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বল ধরে নিল। রিনি কিছু বলার সুযোগই পেল না।
“আসলে কি বলুন তো কৃষ্ণমূর্তিদা, ওই মা-বাবার পুরোনো ব্যাগ নিয়ে গেলে হত না। না, দমদমে কোনও ব্যাপারই না। মুশকিল হত প্যারিস পৌঁছে। প্লেন থেকে ওর ব্যাগ আনলোড করার পর যেই না শার্ল দ্য গল-এর ভেতরে ঢুকবে, ওমনি দায়িত্বে থাকা লোকজন ভুরু কুঁচকে যাবে।
'একি! এরকম একটা পুরনো ব্যাগ, আউট অফ ফ্যাশন ব্যাগ কি করে প্যারিসে ঢুকবে! এ তো হতে পারে না! নাঃ! এ ব্যাগ কিছুতেই কনভেয়ার বেল্টে তোলা যাবে না।'
এদিকে রিনি ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কনভেয়ার বেল্টের সামনে। কিন্তু ব্যাগ আর আসে না! শেষে খোঁজ করতে ওরা জানাবে, এয়ারপোর্টে ঢুকলেও ওই ব্যাগ প্যারিস শহরে ঢোকার মত “রইস” নয়। হয় ব্যাগ ছাড়া ঢোকো, নয় এই এয়ারপোর্ট অবধি। আর নয়। একেবারে ওই যে “দ্য টার্মিনাল” ফিল্মের মত কেস হয়ে যাবে কৃষ্ণমূর্তিদা। সেই যে, একটা লোক দেশ ছেড়ে আমেরিকা পৌঁছেছে, কিন্তু ওই সময়ের মধ্যেই গৃহযুদ্ধ লেগেছে তার দেশে। সেই দেশটাকেই আর স্বীকার করে না কেউ। আর দেশ নেই যখন, পাসপোর্টও ভ্যালিড নয়। তাকে আমেরিকায় ঢুকতে দেবে কেন ইমিগ্রেশন দপ্তর? ব্যস, লোকটা আটকে পড়ল জে.এফ.কে-তে। ফিরতেও পারে না। ফিরবেই বা কোথায়? দেশই তো নেই! তবে আমাদের রিনির কেসটা অতটা সিরিয়াস হবে না। শুধু বলবে- ব্যাগ নয়, ওনলি রিনি। ওঃ! শুধু ব্যাগের জন্যে কত্ত সমস্যা হবে, একবার ভাবুন!”
এতক্ষণ সৌর-র এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনছিল সবাই। রিনি রীতিমতো দাঁত কিড়মিড় করছে। অন্য সময় হলে মেরেই দিত। নেহাত কৃষ্ণমূর্তিদা আছেন বলে পারছিল না। সৌর থামতে মুখ খুলল অনি,
“শুধু ব্যাগের জন্যে!" উফ! কী বললি সৌর! এই নামে একটা বাংলা সিনেমা হয়ে যেতে পারে! টম হ্যাঙ্কস্ এর জায়গায় মুখ্য ভূমিকায় রিনি বাসু।”
কৃষ্ণমূর্তিদার হাসি তো আর থামেই না। চলে যাবার সময় দুটো কথা বলে গেলেন।
এক, “শপিং টপিং তো হচ্ছে, আসল কাজটা হল কি! মানে যে জন্যে যাওয়া- সেই প্রেজেন্টেশন-এর কাজকর্ম কি কিছু এগোল!” অমনি সমস্বরে ‘হ্যাঁআআআআ’ আর ‘ইয়েস’ মিলেমিশে “হ্যাঁয়েস” শোনা গেল আমাদের মুখ থেকে।
দুই, “লাইফে ভ্যালু অফ মানি বুজতে শিখুন ইয়ার। শুধু শুধু ওয়েস্ট কোরা ঠিক নয়। আপনারা তো আর ফ্যাশন শো-তে টেক পার্ট কোরতে যাচ্ছেন না!”
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে আমরা লেগে পড়লুম কাজে।
*****************
এইরকম আরো নানা পর্ব পেরিয়ে শেষমেশ একদিন সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা সকলে হাজির হলাম দমদম এয়ারপোর্টে। একটা পাঁচে তাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। একটা ব্যাগেজ, একটা ক্যারি অন প্রত্যেকের। তিনজনের পোস্টার প্রেজেন্টেশন, দুজনের ওরাল। তিনজনের তিনটে পোস্টারকে একটা চারফুট লম্বা কালো নলের মত পোস্টার হোল্ডারে ঢোকানো হয়েছে। তাতে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে কাঁধে নেওয়ার ব্যবস্থা। সেটা কাঁধে নিয়ে অনি-কে মনে হচ্ছে প্রায় রাইফেল ঝুলিয়ে হাঁটছে।
সব বাড়ির বাবা-মা-রাই হাজির। তাঁদের খোকা-খুকুরা এই প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছে কিনা! তাও আবার বাড়ির লোক ছাড়া, একা একা।
সব বাবা মা-দের আলাপ ছিল না। আলাপ পর্ব চলতে চলতে বোঝা গেল ছেলে মেয়েদের ওপর কারোরই তেমন ভরসা নেই। যারা বাড়ির কোন কাজই প্রায় করে না, তারা বিদেশে গিয়ে YMCA-র হোস্টেলে থেকে কী যে করবে, তাতে ঘোরতর সন্দেহ। হোটেল হলেও নাহয় কথা ছিল। কিন্তু YMCA-এ তে থাকা মানেই বাজার করে, রান্না করে খেতে হবে। তাতে খুব একটা দুঃখ নেই কারোর। বরং কথা বার্তায় বোঝা গেল, এইবার যে চূড়ান্ত ফাঁকিবাজ ছেলেমেয়েগুলোর একটা শিক্ষা হতে চলেছে- এতে তাঁরা যারপরনাই আহ্লাদিত।
রিনির বাড়ি থেকে বাবা মা ছাড়াও পিসি আর পিসেমশাই এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ। রিনি যতই ভুরু কোঁচকাক না কেন, ওর পিসিমণি আমাদের সবাইকে বলতে লাগলেন, রিনি বড়ই চঞ্চলমতি কন্যে। ওকে যেন আমরা একটু সামলে রাখি।
আমরা পাঁচ মক্কেল। প্রতিজনের বাবা-মা মিলিয়ে আরো দশ। আমার কাকু, আর রিনির পিসিমণি আর পিসেমশাই। প্লাস আমাদের ব্যাগেজ। সব মিলিয়ে বেশ একটা বড়সড় জটলা। সবাই যাবার সময় একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছেন ক্রমাগত ক্যালরব্যালর করে চলা এই টিমটিকে। বোঝার চেষ্টা আর কি, ক’জন আসলে যাচ্ছে আর ক’জন এসেছে তাদের সী অফ করতে। আমরা যতবার চাইছি ব্যাগেজ চেক করে ইমিগ্রেশন এর দিকে যেতে, ততবার কারোর না কারোর মা বলছেন, “দাঁড়াও না। এখনো তো সময় আছে।”
শেষে কাকু বললেন, “এবার না গেলে সিকিউরিটি চেকিং করে ইমিগ্রেশনে যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। ওরা এগোক, আমরা চলুন একটু কফি নিই।”
সৌর গজগজ করছিল, “সত্যি! এমন করছে যেন বনবাসে যাচ্ছি। অন্যদিন তো এত আদিখ্যেতা দেখা যায় না! যত্তসব!”
সকলে ব্যাগেজগুলো টেনে এগোতে যাচ্ছি, হঠাত সুমনার বাবা অনি আর সৌরকে দেখে বললেন, “তোমাদের দায়িত্ব রইল কিন্তু। এই তিনটি মেয়ে যাচ্ছে...প্রথমবার বিদেশে...”
সুমনা হাঁ হাঁ করে উঠল। “ওদের দায়িত্ব মানে? ওদের কে সামলায় তার নেই ঠিক!”
চান্স পেয়ে সৌর মুচকি হেসে বলল, “নিশ্চয়ই কাকু। আপনারা কোনও চিন্তা করবেন না।”
কলারটাও তুলবে ভাবছিল সৌর। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। সৌর-র বাবা হেসে বললেন, “কাকে বলছেন! ছেলেগুলোর খেয়ালই রাখতে হবে ওদের। নাহলে কখন এদিক ওদিক চলে যাবে! তোমরা একটু ওদের দেখো তো। আর গিয়েই সব্বাই ফোন করবে কিন্তু!”
সৌর-র মুখের চওড়া হাসিটা নিভে গেল যেন। তার ওপর, বেলুনে পিন ফোটানোর মত করে মিষ্টি হেসে রিনি সৌর-র বাবাকে বলল, “একদম চিন্তা করো না কাকু। এখন থেকে এই নন্টে-ফন্টের দায়িত্ব আমাদের। কথা দিচ্ছি, আস্ত ফিরিয়ে আনব।”
সৌর জ্বলন্ত চোখে রিনির দিকে চাইলেও বাকিরা একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
এরপর আরো কয়েকবার সব বাবা-মা-রা পাখি পড়ার মত করে বললেন সকলে সকলের খেয়াল রাখার কথা। একা একা কোনও অ্যাডভেঞ্চার করার চেষ্টা না করার কথা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাধা দিয়ে লাভ নেই বুঝে গেছি আগেই। তাই অতি লক্ষ্মী আর অতি বাধ্য ছেলেমেয়ের মত কাঁধ অবধি মাথা হেলিয়ে সব্বাই সম্মতি দিলুম।
ফাইন্যালি এগোবার ঠিক আগে বাবা বললেন, “মোবাইল ফোনটা কি নিয়ে যাবে? লাভ নেই তো কোনও! ফ্রান্স-এ এয়ারপোর্ট-এ নেমে কিংবা হোস্টেলে চেক ইন করে কাছাকাছি সুপার মার্কেট থেকে কলিং কার্ড কিনে নিয়ে ফোন করো।”
তখন মাথা একটু যেন স্লো কাজ করছিল। মনে হল, ঠিকই তো! রোমিং নেই যখন নিয়ে গিয়ে আর লাভ কি! ফোনটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে পড়লুম। রোমিং এর আগেই যে ফোনটা জরুরি কাজে লাগতে পারে, তখন মনে পড়েনি।
পাঁচজনের জন্যে ফার্স্ট লেগে কলকাতা টু ব্যাঙ্কক উইন্ডো সিট পাওয়া গেল তিনটে। সিকিউরিটি, ইমিগ্রেশন সামলে হাতে বোর্ডিং পাস নিয়ে ফ্লাইটে ওঠার সময় মিষ্টি হেসে হাতে পার্পল অর্কিড ধরিয়ে দিলেন তাই এয়ারওয়েজের সুবেশা বিমান কন্যারা।
রিনি আর আমি পাশাপাশি, উইন্ডো আর আইল সীট। উইন্ডো সীটটা বদলাবদলি করব মাঝে মাঝে। আমাদের পিছনে সুমনা আর সৌর। বাঁদিকের উইন্ডোতে অনি।
ওদিকে খোকা-খুকুদের সী অফ করে, কফি খেয়ে, আরো খানিক গল্প করে বাবা মা-রা তখন বাড়ির পথে। বাবার পকেটে সুর তুলে মোবাইল বেজে উঠল। বাবার তখন নিজের মোবাইল ছিল না। বলতেন, দরকার নেই। আমার মোবাইলটা হাতে ধরিয়ে অনেক কসরৎ করেও খুব বেশি কিছু শেখাতে পারিনি। শুধু সবুজ বাটন মানে কল রিসিভ করা, আর লাল বাটন মানে কেটে দেওয়া- এইটুকু বাবার দৌড়। তাই কোথা থেকে সুরেলা বাদ্যি বাজছে, বাবা সেটা বুঝতেই পারেননি প্রথমটায়। মা বললেন, “ওই যে, তোমার পকেটে।”
“ও হ্যাঁ তাই তো! কি আশ্চর্য”, বলে পকেট হাতড়ে ফোন বের করতে করতে বাদ্যি থেমে গেল। কয়েক মিনিট বাদে আবার। এবার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ বাটন টিপেই কানে। এবং তারপর আরো আশ্চর্য হবার পালা। কারণ উল্টোদিক থেকে ভেসে এল, “তোমার কি উইন্ডো সীট? টেক অফ্-এর টাইম হয়ে এল তো!”
প্রথম প্রশ্নে হাঁ হয়ে গেলেও দ্রুতই পরিস্থিতি বুঝে গেলেন বাবা। নাঃ, রং নাম্বার নয়। রাইট নাম্বার কিন্তু রং পার্সন।
বাবা বললেন, “হ্যাঁ, উইন্ডো সীটই বটে। তবে কিনা গাড়িতে। আর কলকাতার জ্যামে আটকে। আর যার ফোন, তিনি এখন..."
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি বুঝেছি....”
দু’জনের গল্পটা আরো খানিকক্ষণ গড়িয়েছিল। আমি দু’তরফেরই রিপোর্ট পেয়েছি পরে।
ফ্লাইটে সামনের সিটের পিছনে ছোট্ট স্ক্রীনে ম্যাপ দেখাচ্ছে। কীভাবে আকাশ-পথে ব্যাঙ্কক পৌঁছব। বেশ আয়েস করে বসেছিল রিনি। হঠাৎ ছিটকে সোজা হয়ে বসে ম্যাপের দিকে আঙুল তুলে বলল, “এই এই, আমরা তো ডিট্যুর করছি। উল্টো দিকে যাচ্ছি এখন!”
বললাম, “আরে বাবা, তাই এয়ারওয়েজে যেতে হলে তো ব্যঙ্কক হয়ে যেতে হবে। সেটাই তো ওদের হাব।”
“হ্যাঁ, কিন্তু কেন? উল্টো দিকে কেন যাব? ডিট্যুর করব কেন?”
অনি খুব ক্যুললি বলল, “রিনি, এই ম্যাপটা দেখার আগে বুঝতে পারিস নি নারে? এই এত্তোদিন ধরে যখন প্ল্যান হচ্ছিল?”
পেছন থেকে সৌর বলল, “কৌস্তভ বলেনি তোকে আগে? অবশ্য ম্যাপ নিয়ে আর তোদের কথা হবে কেন!”
ব্যস। গরম তেলে বেগুন।
“অ্যাই নন্টে। চুপ করে থাক। ফোড়নের কৌটো বন্ধ কর।”
এসবের মধ্যেই “এনিথিং ফর ইউ টু ড্রিঙ্ক স্যর”, বলে সৌর-র সামনে অর্কিডে সাজা বিমানকন্যার আবির্ভাব।
সৌর একটা পুঁচকে রেড ওয়াইনের বোতল নিল হাসিমুখে। সুমনা ওরেঞ্জ জুস। আমার সামনে আসতেই আমি চাইলাম চা আর রিনি নিল হোয়াইট ওয়াইন। সৌর ঝুঁকে পড়ে বলল,
“সিরিয়াসলি রিনি? তুই এখন ওয়াইন নিবি?”
“তুই নিলি যে? তার বেলা? একদম চুপ কর। জ্যাঠামশাইগিরি করবি না বলে দিচ্ছি। ভাল হবে না।”
ওদিকে অনির কথা মত কাপে কফি ঢেলে দিয়ে স্মিত হেসে বিমানকন্যা এগিয়ে যাচ্ছেন। অনি বোতাম টিপল। আর একজন অর্কিড-সুন্দরী এসে বিগলিত করুণা যাহ্নবী যমুনা হয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, “ইয়েস স্যর। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?”
“আই নিড ওয়ান মোর ক্রিমার ফর মাই কফি।”
“জাস্ট ওয়ান মোর? আর ইউ শ্যুর?”
“ওয়েল, মে বি টু।”
রহস্যময় হাসি হেসে অর্কিড-সুন্দরী অনির কফি কাপটা তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ফিরে এলেন যখন, তখন কাপে হাফ কাপ কফি। অন্য হাতে এক পট দুধ। অনির সামনের ট্রে-তে দুটোই নামিয়ে রেখে বললেন, “আই নো দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ে অফ ড্রিঙ্ককিং কফি। ভর্তি কফি কাপে দু-তিনটে ক্রিমার দিয়েও কিচ্ছু হত না। সো আই পোরড্ জাস্ট হাফ আ কাপ। রেস্ট হাফ ইজ ফর দ্য মিল্ক।”
“থ্যাঙ্ক ইউ!”
“মাই প্লেজার”, বলে তিনি তো মিষ্টি হেসে চলে গেলেন।
ঝাঁপিয়ে পড়ল সৌর। “অনি! কিছু বললি না যে! আরে, দেশ তুলে কথা বলল! বলে কিনা ইন্ডিয়ান ওয়ে অফ ড্রিঙ্ককিং কফি!”
“সে যাক গে। কফিটা কিন্তু চমৎকার হয়েছে।”
এদিকে রিনির হোয়াইট ওয়াইন বড়ই কষাটে লাগছে। মুখ কুঁচকে বলল, “আমার পিসিমণির বাড়ি সেদিন যে হোয়াইট ওয়াইনটা নিয়েছিলাম, কি ভাল যে খেতে! বেশ সুইট ছিল। মোটেই এমন কষাটে নয়। এটা বিচ্ছিরি। কিছুতেই এটা আসল ফ্রেঞ্চ ওয়াইন হতে পারে না।”
“ইয়ে, বলছি কি, পিসিমণি চিনি মিশিয়ে তোকে দেননি তো?”
আবারও একটা বিস্ফোরণ নিশ্চিত। অনির এই মন্তব্যের পর। কোনরকমে হাসি চাপতে আমি জানলার বাইরে তাকালাম। একটু আগেও অনেকটা নীচে চিকচিকে রুপোলি ফিতের মত গঙ্গা দেখা যাচ্ছিল। এখন সব অদৃশ্য। আমরা এখন মেঘেদের দেশে। কখনো পেঁজা তুলোর মত সাদা ফুরফুরে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার কখনো একটু ভারিক্কি ধূসর মেঘের থোকা। ছড়ানো ছিটোনো ক’টা মেঘের ভেলা পেরোতে না পেরোতেই হঠাৎ সামনে একটা মেঘের পাহাড়। সূর্যের আলো পড়ে ওই দূরে চিকচিক করছে আর একটা মেঘেরনদী।
এই তো, আশ্চর্য মেঘদল! শার্ল ব্যোদলেয়ারের (Charles Baudelaire) ‘The Stranger’ কবিতার চলিষ্ণু মেঘ!
‘...What, then, extraordinary stranger, do you love?
“I love the clouds- the clouds that pass- yonder- the marvellous clouds.”’
বলো আমাকে, রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো:
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, অথবা ভগ্নীকে?
-পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী- কিছুই নেই আমার।”
তোমার বন্ধুরা?
-ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।
তোমার দেশ?
-জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান ।
সৌন্দর্য?
-পারতাম বটে তাকে ভালোবাসতে- দেবী তিনি, অমরা।
কাঞ্চন?
-ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ভগবানকে।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কি ভালোবাসো তুমি?
-আমি ভালোবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে...ঐ উঁচুতে...
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
(‘অচেনা মানুষ’/ বুদ্ধদেব বসু-র অনুবাদে)
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে
আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে
বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে।
কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও
জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি
বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।