প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

অগাস্ট ৩০, ২০১৫

 

পুরনো অ্যালবাম

কেয়া মুখোপাধ্যায়


(৯)

(আগের অংশ) “দুই হাজার বছর তার বয়স, তবু চুল পাকল না।” লিখেছিলেন পারী-র সৌন্দর্যে মুগ্ধ অন্নদাশঙ্কর রায়।

এ এক আশ্চর্য শহর। শুধু দেখার নয়, অনুভবেরও। শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত - সবেতেই এক অনন্য নান্দনিকতার ছোঁয়া। সবই যেন এক অন্য জগতের। ফরাসীদের অসামান্য ক্রিয়েটিভ, রোম্যান্টিক মনের পরিচয় সবখানে। যত দেখি, তত বিস্মিত হই।

আমাদের ঠিকানা এখন ১৪ রু দ্য ত্রেভিস। YMCA-র আবাস। ফরাসিতে লেখা UCJG, Union Chrétienne de Jeunes Gens de Paris. পড়াশোনা করতে আসা বিদেশি ছাত্ররাই থাকে। কখনো সখনো আমাদের মত শর্ট টার্ম অতিথিরা। বড় বড় ফার্নিশড ঘর। এমনিতে ডাবল বেড থাকার কথা। আমরা তিনজন বলে আর একটা বেড-এর বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। রাস্তার দিকের সব ঘরেই ফ্লোর থেকে প্রায় সিলিং অবধি লম্বা কাচের জানালা। খুললেই ছোট্ট ব্যালকনি। কারুকাজ করা কালো রঙের রেলিং-এ ঘেরা। রেলিং-এর ধারে সবুজ লতানো গাছে গোলাপি ফুলেরা উঁকি দিচ্ছে। রাস্তা থেকে দেখলে প্রতিটা কারুকাজ করা কালো রেলিং ঘিরে সবুজ আর গোলাপির এই বাহার ভারি সুন্দর লাগে।

ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরে। ভারি পর্দা সরিয়ে দাঁড়ালাম ব্যালকনিতে। অন্ধকার খুব গাঢ় নিকষ কালো নয়। রাস্তার আলো মিশে একটা হালকা নীলচে অন্ধকারের চাদরে মোড়া স্বপ্ননগরী যেন! রু দ্য ত্রেভিস পুরনো পাড়া। আগেকার স্থাপত্যের নিদর্শন দু’পাশের বাড়িগুলোতে। সব বাড়িরই রঙ এক। হলুদ-রঙা বেলে পাথরের মত। শহরের নিয়ম, দুমদাম কেউ নীল, গোলাপি কি পাটকিলে – যা মন চাইল তেমনি রঙে নিজের বাড়ি সাজিয়ে নিতে পারবে না। অনুমতি নিতে হবে। নান্দনিকতা যেন একটুও ব্যাহত না হয় কোথাও। জায়গাটা বলতে গেলে হার্ট অফ দ্য সিটিতেই। একটু হেঁটে গেলেই মেট্রো স্টেশন।  

বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে আমার। পুরনো প্যারিসের গন্ধ মিশে আছে যেন! আমরা ছাড়া আরও জন তিরিশ ছেলে মেয়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউ কেউ অনেকদিনের বাসিন্দা। সকাল সন্ধেয় সিঁড়ির মুখে কি হলওয়ে কিংবা নীচের বাস্কেটবল খেলার জায়গায় দেখা হয়। টুকরো কথা, হাসি বিনিময়। ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে একতলা থেকে চারতলা। পাশের দেয়ালগুলো টুকটুকে লাল।



বাড়িটার আরও কয়েকটা ব্যাপার দারুণ ইন্টারেস্টিং। একতলায় একদিকে অনেকদিনের পুরনো এক থিয়েটার হল। উইকএন্ডে বেশ ভিড় হয় থিয়েটার দেখতে। আর ভেতরে, চারতলা বাড়ির ঠিক মাঝখানে এক টুকরো চৌকো উঠোন। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না ওরকম একটা সাবেক উঠোন লুকিয়ে আছে বাড়ির ভেতরে!

একটা ঘোরানো লোহার লাল-কালো সিঁড়ি নেমে গেছে চারতলা থেকে একতলায়। প্রতিটা ফ্লোরের হলওয়ে থেকেই সে সিঁড়িতে যাওয়া যায়। ওই টুকরো উঠোনে কমলা রঙের প্যাটিও টেবিল-চেয়ার পাতা। উঠোনের এক দিকে কমন কিচেন আর ডাইনিং হল। কিচেন সবরকম আধুকিক গ্যাজেটস-এ ঠাসা। খাবার দাবার নিজেদের। আলাদা আলাদা রুম নম্বর লেখা বক্সে সেসব খাবার ভরে ফ্রিজে রাখতে হবে। সেসব ঠিকই আছে, শুধু একটাই ব্যাপারে রিনি খুঁতখুঁত করছিল। প্রতিটা ফ্লোরে তিনটে করে কমন শাওয়ার রুম। ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ নেই। 

যেদিন এসে পৌঁছেছিলাম, এয়ারপোর্ট থেকে বেরনোমাত্র ঠান্ডা হাওয়ায় একটু শীত শীত করেছিল। ভোরের দিকটায় হালকা ঠান্ডা। একটু বেলা হতেই বেশ গ্রীষ্ম গ্রীষ্ম ভাব। ঝলমলে আকাশ। কিন্তু ঘাম ঝরিয়ে ক্লান্ত করে দেওয়া আবহাওয়া নয়। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝলক মুখে, গায়ে আরামের তুলি বুলিয়ে যায়।
************

সুপারমার্কেট ছাড়াও এই রাস্তায় দুটো বড় বেকারি আছে। সেখান থেকে কয়েকরকম ফরাসি ব্রেড আনা হয়েছে। ব্যাগেত (baguette), ক্রসঁ (Croissant), ব্রিওস (brioche) - যার যেটা ভালো লাগে। সঙ্গে ফরাসি চিজ, বাটার, ডিম, জুস, আপেল, কলা ইত্যাদি ইত্যাদি। ও হ্যাঁ, কলকাতা থেকে টি-ব্যাগও এসেছে এক বাক্স। চা-পাতা দিয়ে চা করার হ্যাপা সামলাতে পারব না, ছড়িয়ে ফেলব- সেই ভাবনা থেকেই বিজ্ঞাপনের ‘বাঃ তাজ বোলিয়ে’ ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগকে সঙ্গী করা। সেই সঙ্গী নির্বাচন যে কত ভুল হয়েছিল- ক্রমশ বোঝা যাবে সেটা।
ব্রেকফাস্টের পরেই বেরিয়ে পড়ব। সকালে কিচেনের দায়িত্ব রিনি আর অনি-র। ব্রেড, চিজ, ফল এনে উঠোনের কমলা টেবিলে সাজিয়ে ফেলল অনি। প্যারিসের দর্শনীয় জায়গা নিয়ে প্রায় থিসিস ওয়ার্ক করে ফেলেছি আমরা আসার আগে। মাঝে মাঝেই সেইসব জ্ঞানের নানা ঝলক প্রকাশ পাচ্ছে কথায়। জ্ঞানের ছটায় মনে হচ্ছে নিজেরাই একটা ট্যুরিজম আপিস খুলে দিব্যি লোকজনদের গাইড করতে পারি! 



সেইন নদীর তীরে নেপোলিয়নের সমাধিস্তম্ভ লে ইনভ্যালিদা। তার কাছেই ৭৯ রু দ্য ভারেন (Rue de Varenne)-এ বাগান ঘেরা এক সুরম্য প্রাসাদে রদ্যাঁ মিউজিয়াম। আমাদের গন্তব্য। আপেল কাটতে কাটতে অনি বলল,
“শুনেছি কলকাতায় একবার রদ্যাঁ-র স্কাল্পচারের একজিবিশন হয়েছিল।”
মেট্রোর-র ম্যাপে মুখে গুঁজে বসেছিল সৌর। মুখ না তুলেই বলল,
“হুঁ। জানি। বিড়লা আকাদেমিতে হয়েছিল। ওগুলো ছিল প্লাস্টার কাস্ট।”
“সে কি রে! প্লাস্টার কাস্ট দেখতে অত ভিড়! প্রতিদিন নাকি হাজার হাজার লোক লাইন দিত!
"শিল্পপ্রেমিক মানুষ সব কলকাতায়! ভিড় হবে না। “কলকাতায় রদ্যাঁ” নির্ঘাত এরকম সব ক্যাচি হেডলাইন দিত কাগজে।”
সৌর-র কথায় একটা প্রচ্ছন্ন শ্লেষ ছিল। খোঁচালে আরও কিছু শোনা যাবে ধরে নিয়ে বললাম,
“এইটাই তোর মুশকিল! তুই শিল্পরসিক হতে পারিস। কিন্তু যেসব হাজার হাজার লোকে লাইন দিচ্ছিল, তারা রদ্যাঁর স্কাল্পচারের মর্ম কিচ্ছু বুঝবে না। তাদের শুধু হুজুগ, এই তো?”
ম্যাপটা ভাঁজ করে রেখে দিল সৌর।
“না, তা নয়। অবশ্যই শিল্প-বোদ্ধা মানুষ গিয়েছিলেন। কিন্তু সে আর কতজন? বাকিদেরটা হুজুগই। খোঁজ নিলে দেখবি, তাদের  সারা জীবনের কাজকর্মের সঙ্গে শিল্পের এতটুকু সম্পর্ক নেই। যদি থাকত, তাহলে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস কিংবা অন্য সব গ্যালারিগুলোতে রোজ দারুণ ভিড় হত। হয় কি? শুনেছিস কোনদিন? মাছি তাড়ায় তো বেশিরভাগ সময়।”
“প্রতিদিনকার একজিবিশন আর পৃথিবীর অন্যতম সেরা ভাস্করের কাজ দেখা- এ দুটো কি এক হল?”
“হল না তো! সেইটাই তো বলছি। পৃথিবীর অন্যতম সেরা ভাস্করের কাজ দেখল তিন ঘন্টা লাইন দিয়ে। তারপর তারা কী করল বাকি জীবন? মাছ-ভাত, পলিটিক্স আর ফুটবল বা ক্রিকেট- এই নিয়ে কাটিয়ে দিল। রদ্যাঁ দেখা, তাদের বাকি জীবনটাকে- ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনকে কীভাবে ইনফ্লুয়েন্স করল তাহলে বল? যে রদ্যাঁর নামই শোনেনি, তার সঙ্গে তফাৎ কী রইল? আসলে ‘been-there’, ‘seen-that’ “এইরকম smugness দেখাবে বলেই বাঙালিরা এসব জায়গায় যায়, which people in other places in India don't care for!”
“না। মানতে পারছি না। অন্তত কয়েকটা মানুষের জীবনেও যদি এর একটা প্রভাব পড়ে থাকে তো সেটাও অনেক...”

তর্কটা আরও খানিকক্ষণ চলত, কিন্তু হঠাত ফট্ ফট্ ফট্ করে বিপুল আওয়াজ। খুব কাছেই কিছু ফাটছে। সুমনা বলল,
“পটকা নাকি!”
অনি কিছু একটা আন্দাজ করে কিচেনে দৌড়ে গেল। সঙ্গে আমরাও।
“রিনি, ডিমগুলো কোথায় রে? ওভেনে গরম জলে বসিয়েছিলাম যে!”
ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে তখনও প্রবল ফট্ ফট্ ফট্।
“ইয়ে, তাড়াতাড়ি হবে বলে আমি ওগুলো মাইক্রোওয়েভে দিয়েছি।”
লাফিয়ে গিয়ে মাইক্রোওয়েভ স্টপ করল অনি। খুলতেই ভেতরে একরাশ ধোঁয়া, পঞ্চত্ব-প্রাপ্ত ডিমগুলো ভেঙে ছিটকে ছড়িয়ে গেছে মাইক্রোওয়েভের ভেতরটায়। সে এক লন্ডভন্ড কান্ড।
“মাইক্রোওয়েভে ডিম সেদ্ধ করা যায় না- এইটুকু জানে না, চললেন রদ্যাঁ দেখতে!”
ভেতরটা পরিষ্কার করতে করতে গজগজ করছিল সৌর।
“আশ্চর্য! ডিমসেদ্ধ-র সঙ্গে স্কাল্পচারের কী সম্পর্ক? বাজে বকিস না বলে দিচ্ছি...”
রিনিকে ক্রিম চিজ আর ক্রঁস খেতে বের করে নিয়ে যাওয়া হল বলে ঝগড়াটা আর জমল না তখনকার মত।
********************

Musée Rodin। অগুস্ত রদ্যাঁর মিউজিয়াম। উনিশ শতকের শেষভাগে শিল্পের জগতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল রদ্যাঁর কাজ। কখনো তিনি Beaux arts ধারার অনুগামী। আবার কখনো বিরোধী। মানুষের মূর্তি নির্মাণে অদ্বিতীয় নৈপুণ্য তাঁর। পূর্ববর্তী আর পরবর্তী সমস্ত ভাস্কর্য-নির্মাণ ধারা থেকে তিনি স্বতন্ত্র। ভাস্কর্যের ইতিহাসে ফ্লোরেন্সের মাইকেলএঞ্জেলো বাদে আর কোন ভাস্করই এমন দুনিয়াজোড়া সম্মান পাননি। প্যারিস তথা বিশ্বের নানা জাদুঘরে আছে রদ্যাঁর ভাস্কর্য। কিন্তু তাঁর শিল্পকলার মূল সংগ্রহ সবই পারীর এই মিউজিয়ামে।

রূপসী পারীর মুকুটের উজ্জ্বল এক রত্ন রদ্যাঁ মিউজিয়াম। এক অসামান্য শিল্পীর জীবনের আনাচ-কানাচে যেন উঁকি মেরে দেখা যায় এখানে এলে। সুবিশাল প্রাসাদ। রদ্যাঁর জীবনের অনেকটাই কেটেছে এখানে। স্টুডিও-ও ছিল এখানেই।

টিকিটের লাইনে দীর্ঘ অপেক্ষার পর পায়ে পায়ে বাগানে। চোখ জুড়নো ঘন সবুজ মখমল। লনের দুপাশে সারি দেওয়া গাছ। এদিক ওদিক ফুটে আছে গোলাপ। কি অপরূপ রঙ তাদের! প্রধান ফটকের ডানদিকে গাছপালার ভেতরে এক উঁচু বেদি। পেছনে, দূরে ঝলমল করছে নেপোলিয়নের সমাধিস্তম্ভ লে ইনভালিদা। আর প্রকৃতির মাঝে, বেদির নিরিবিলিতে রদ্যাঁর মহত্তম সৃষ্টি। মাইকেলএঞ্জেলোর ডেভিড বা প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য ভেনাস দ্য মিলো ছাড়া আর কোনও ভাস্কর্য খ্যাতিতে যার কাছাকাছি আসতে পারে না। দ্য থিঙ্কার! একটি হাত আলতোভাবে হাঁটুর ওপর, অন্যটি থুঁতনিতে। মাথা নামানো। নগ্ন বলিষ্ঠ এক মূর্তি। গভীর চিন্তা-নিমগ্ন। Le Pensevr। সে চিন্তা কি মানুষের জন্যে? এই পৃথিবীর জন্যে!

অনন্যসাধারণ এক মাস্টারপিস রদ্যাঁর থিঙ্কার। দিনে দিনে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনের প্রতীক হয়ে উঠেছে সে। রদ্যাঁ যে কটি ব্রোঞ্জ আর মার্বেলের থিঙ্কার তৈরি করেছিলেন, তাদের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। অনেকে বলেন, মূর্তিটি গড়া হয়েছে মহাকবি দান্তের অনুকরণে।  এ এক আশ্চর্য ভাস্কর্য।  কে বলবে এ শুধু আবেগহীন এক পাথরের মূর্তি!  পাথর খোদাই করে যেন প্রাণ ফোটানো!

দ্য থিঙ্কার-এর কাছেই বাগানে প্রকৃতির কোলে রদ্যাঁর আরেক সুবিখ্যাত কাজ বালজাকের ভাস্কর্য। বরেণ্য এই ফরাসী সাহিত্যিকের অসংখ্য ভাস্কর্য গড়েছেন রদ্যাঁ। এটিই সবচেয়ে বড়।

মিউজিয়ামের মূল বাড়িটি এককালে পরিচিত ছিল ‘হোটেল বায়রন’ নামে। না, বাড়ি নয়। এক অপূর্ব সুরম্য প্রাসাদ যেন! কারুকার্যময় সিঁড়ি আর জানালার রেলিঙ। বিশাল সুদৃশ্য ঝাড়বাতি প্রতিটি ঘরে। ফরাসি সরকারের সঙ্গে রদ্যাঁ-র চুক্তি হয়েছিল, মৃত্যুর পরে তাঁর সমস্ত সংগ্রহ দিয়ে রদ্যাঁ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এখানেই ছিল তাঁর স্টুডিও।

প্রতিটি ঘরে রদ্যাঁর তৈরি অসংখ্য অপরূপ, বিশ্ব-সেরা ভাস্কর্য। কোনটা মার্বেলের, কোনটা আবার ব্রোঞ্জ। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা যে বলি! এখানে আছে ‘ল্য ক্যাথেড্রাল।’ দু’টি হাত আর তার দশটি আঙুলের কি সুন্দর উপস্থাপনা! আছে ‘দি হ্যান্ড অব গড।’ পাথরের ভাস্কর্য। কাদা ছেনে নর ও নারী বানাচ্ছে একটি হাত। ঈশ্বরের হাত। সেই নর নারী আবার পরস্পরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ!

আর আছে রদ্যাঁর তৈরি সবচেয়ে রোম্যান্টিক ভাস্কর্য। ‘দ্য কিস।’ দুই নর-নারী পরস্পরের নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ। দুজনের ঠোঁট দুটি মিশে যাচ্ছে ভালোবাসায়। পাথর কেটেও যে এই ভাবে অ্যানাটমির কঠিন আর কোমলকে ফুটিয়ে তোলা যায়, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না! আর কি আশ্চর্য অনুভূতি ফুটে উঠেছে পাথরে! দু’জনে দু’জনের কাছে একেবারে সমর্পিত। মেয়েটির কনট্যুর হেলানো, ছেলেটি একেবারে সোজা বসে আছে। কোথাও কোনও আড়ষ্টতা নেই। মেয়েটি নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে ছেলেটির কাছে, আর পুরুষটির দেহরেখার মধ্যেও কোথাও কোনও জোর করা নেই! কি জীবন্ত!  এ এক বিস্ময়!

মহাকবি দান্তের চরিত্র ফ্রান্সেসকা আর পাওলো থেকে এ ভাস্কর্যের মূল ধারণা নেওয়া। অনেকে বলেন, নারীমূর্তিটির মুখের আদল যেন রদ্যাঁর ছাত্রী আর প্রেমিকা ক্যামিল ক্লোদেলের মত। ক্যামিল ক্লোদেলও ছিলেন অসামান্য প্রতিভাময়ী। অকালে চলে না গেলে তাঁরও খ্যাতির বিভা হয়তো ছড়িয়ে পড়ত বিশ্বজুড়ে। রদ্যাঁ-র এই মিউজিয়ামে স্বয়ং রদ্যাঁ ছাড়া একমাত্র ক্যামিল ক্লোদেল-এর কিছু সৃষ্টি আছে।

একবার রদ্যাঁ-কে বলা হয়েছিলো সাধারণ মানুষকে ভেবে কিছু ভাস্কর্য গড়তে। রদ্যাঁ শুধু কিছু 'পা'য়ের ভাস্কর্য গড়েছিলেন। এগোতে গেলে পা। মিছিলে হাঁটতে পা। স্বপ্নের পথে হাঁটতেও পা। সাধারণ মানুষের শুধু 'পা'-ই তো দরকার!

রদ্যাঁ-র আর এক শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য ‘গেট অফ হেল।’ একটি আলাদা সৃষ্টি নয়, আসলে এ যেন নানা ভাস্কর্যের সমাহার। ইতালীর মহাকবি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ আর ফরাসি কবি শার্ল ব্যোদলেয়ারের ‘দ্য ফ্লাওয়ার্স অফ দ্য ইভিল’ কাব্যগ্রন্থ এই ভাস্কর্যের অনুপ্রেরণা।  সুবিশাল এক সিং-দরজা। তার ওপারেই বোধহয় নরক! সিং-দরজার উপরে কেন্দ্রবিন্দুতে চিন্তামগ্ন দ্য থিঙ্কার। আছে আর্তনাদরত নর-নারী। আর তাঁর নানা ভাস্কর্যের ক্ষুদ্রাকৃতি প্রতিমূর্তি।

রদ্যাঁর শিল্প-সংগ্রহও ছিল অসামান্য। তাঁর সংগৃহীত গ্রীক কি রোমান সভ্যতার নিদর্শন অথবা সমসাময়িক চিত্রকলার সম্ভার আছে মিউজিয়ামে। রেনোয়া, এডোয়ার্ড, ক্লদ মোনের সৃশটির পাশাপাশি আছে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের তিনটি মাস্টারপীস।

বাগান কি প্রাসাদ- কোথায় যে বেশি সময় কাটাব বুঝতেই পারছিলাম না! অসামান্য এক একটা সৃষ্টিতে ভরে আছে সবখান। এক একটি ভাস্কর্য যেন একটি কবিতা। গল্পের মত, উপন্যাসের মত সে কবিতা পড়ে শেষ করে ফেলা যায় না। তার কাছে বার বার ফিরে আসতে হয়। কখনো একা, কখনো প্রিয়জনের হাত ধরে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত বেরিয়ে এলাম যখন, আকাশে নরম সোনা-রোদ্দুর। সেইন নদীতে ভেসে চলেছে কত প্রমোদতরণী। আর কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে গানের সুর...

“When you kiss me heaven sighs
And though I close my eyes
I see la vie en rose.
...
Give your heart and soul to me
And life will always be la vie en rose”
(Édith Piaf)

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।