প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

অগাস্ট ১৫, ২০১৫

 

পুরনো অ্যালবাম

কেয়া মুখোপাধ্যায়


(৮)

(আগের অংশ)

এখানেই ছিলে তুমি? এইখানে ছিলে একদিন?
ছুঁয়ে দেখি লাল মাটি, কান পেতে শুনি শালবন,
সমস্ত রাত্রির প্রেত সঙ্গে নিয়ে ফিরি, আর দেখি
তোমার শরীর নেই, তোমার আত্মাও আজ ঢেকে গেছে ঘাসে।” (শঙ্খ ঘোষ)

মাথাটা ঈষৎ নিচু, মোটা খাতার ওপরে কলম ধরে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে তোলাতে নিমগ্ন তিনি। বিকেলের নরম রোদ এসে পড়েছে উজ্জ্বল মুখটিতে। আমার আবাল্যের বন্ধু। চিকচিকে বালি পেরিয়ে, পা-ডুবে-যাওয়া হাঁটুজল ছোট নদীর অচেনা বাঁকে, কিচিমিচি করা উড়ন্ত শালিকের ঝাঁকে, সহজ পাঠের পাতায় পাতায় তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। দিনে দিনে বেড়েছে সখ্য। যত বেড়েছে, বুঝতে পেরেছি আমার চেনা-অচেনা-আধোচেনা সব অনুভূতি, কি আশ্চর্য, আগেই বুঝে, তিনি লিখে রেখেছেন পাতায় পাতায়। গোপন রহি গভীর প্রাণে, আমার সকল দুঃখ-সুখের গানে সুর দিয়েছেন। তিনি আমার ‘পাকা দেয়ালের ফাটল দিয়ে’ আসা ‘আচমকা আলো’, যে আলো হাত ধরে আমাকে নিয়ে চলে জীবনের নানা চড়াই উৎরাই বেয়ে। না, লালমাটি কি শালবন ছিল না সেখানে। তবু অজানা এই ছবির দেশের নরম কচি ঘাসে ঢাকা জোয়ান মিরো পার্কে মর্মর মূর্তিটির কাছে গিয়ে যেন অনুভব করলাম তাঁর উপস্থিতির সৌরভ। আমার রবীন্দ্রনাথ।

১৯২০-র অগাস্ট মাস। ২ তারিখে ইংল্যান্ড থেকে নরওয়ে যাবার কথা ছিল কবির। কিন্তু সে যাত্রা স্থগিত রেখে কবি প্যারিসে পৌঁছলেন ৬ই অগাস্ট। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের অধ্যক্ষ সুশীলকুমার রুদ্রের ছেলে সুধীরকুমার কবির জন্যে প্যারিসের মেট্রোপলিটন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। হোটেলটি কবির খুব একটা পছন্দ হয়নি। প্যারিসের উপকণ্ঠে প্রখ্যাত ফরাসি ব্যাঙ্কার ও শিল্পরসিক আলব্যর কান (Albert Kahn)-এর অতিথিশালা ওত্যুর-দ্যু-মঁদ। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের মনে পড়ল, তাঁরা যখন লন্ডনে ছিলেন, তখন ওত্যুর-দ্য-মঁদ-এর সেক্রেটারি কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কিছুদিন আতিথ্য গ্রহণের জন্যে। সুধীরকুমার তাঁকে জানালেন, কবি প্যারিসে এসেছেন। পরদিনই আলব্যর কান-এর আগ্রহে সেখানে গিয়ে আতিথ্য গ্রহণ করলেন কবি।   

ভারি সুন্দর সুবিশাল এক বাগানে ঘেরা বাড়িটিতে গিয়ে পরবাসেও ঘরে থাকার আনন্দ ও স্বস্তি পেলেন কবি। পরবর্তীকালে যখনই ফরাসি দেশে গেছেন, আলব্যর কান-এর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন কবি। রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য সেই বাগান আর সংলগ্ন বাড়িটি এখন একটি জাতীয় মিউজিয়াম, Musée Albert-Kahn।
“এই ছবির দেশে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্র-প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপনায় দুই বিদেশিনীর বিশেষ ভূমিকা ছিল।”
ফেরার পথে পার্কের পা-ডুবে যাওয়া নরম ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল সৌর।

রিনি বলল, “খানিকটা জানি, একজন তো কবির ‘বিজয়া,’ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। কিন্তু অন্যজন কে?”

“তিনি ফ্রান্সের প্রথম নারী কমান্ডার অব লেজিয়ঁ দ্যনর প্রাপক। আকাদেমি ফ্রাঁসেজ-এর গ্রাঁ প্রি-ও পেয়েছিলেন । সৌন্দর্য, প্রতিভা আর প্রতিপত্তির মিশেলে অসামান্যা এক নারী। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ফরাসি সাহিত্যিকরা তাঁর প্রেমিক কি মুগ্ধ অনুরাগী। মার্সেল প্রুস্ত, আঁদ্রে জিদ, পল ভালেরি, গাব্রিয়েল দান্নুনৎসিও, জাঁ ককতো- আরও কত নাম সেখানে।”

“এই হল মুশকিল! নামটা বল না! নাহয় আসার আগে তুই ক’পাতা পড়ে এসেছিস!”

বিশিষ্ট ফরাসি সাহিত্যিক। উপন্যাস ও স্মৃতিকথা ছাড়াও লিখেছিলেন কয়েকটি অসামান্য কয়েকটি কবিতার বই, উপন্যাস আর স্মৃতিকথা। ফরাসি কবিতার প্রায় সব বিশিষ্ট সঙ্কলনেই আছে তাঁর কবিতা।

ফরাসি গদ্যের অন্যতম সেরা রূপকার মার্সেল প্রুস্ত (Marcel Proust) নিজেকে বলেন তাঁর intoxicated admirer, মৃত্যুশয্যা থেকে চিঠি লেখেন তাঁকে। সেই নারীকে নিয়ে রচনা করেন,  "Les Éblouissements". শুধু এঁরাই নন, প্রধানমন্ত্রী ক্লেমাঁসো থেকে কুখ্যাত জাতীয়তাবাদী লেখক ও রাজনীতিবিদ মরিস বারেস-এরও বান্ধবী তিনি।

আরও আছে। আবহমান কালের জন্যে তাঁর সৌন্দর্যকে নিজের সৃষ্টির মধ্যে ধরে রেখেছেন স্বয়ং অগুস্ত রদ্যাঁ, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভাস্কর। প্যারিসের Musée Rodin-এ রাখা আছে তার মৃত্তিকারূপ আর শ্বেতপাথরের আবক্ষ মূর্তিটি আছে নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়মে।

আনা, কঁতেস ম্যাতিউ দ্য নোয়াই (d’Anna, Comtesse Mathieu de Noailles)”।

১৯২০-র ১৬ সেপ্টেম্বর। ওত্যুর-দ্যু-মঁদ-এ রবীন্দ্রনাথের কাছে আনা কঁতেস দ্য নোয়াই-কে নিয়ে এলেন আলব্যর কান। এই আলাপচারিতাকে মনে রেখে নিজের স্মৃতিকথা ‘On the Edges of Time’-এ রথীন্দ্রনাথ লিখলেন:

‘Her appearance, her dress, her very first words with father brought out the coquette in her. ... Her vivacity of conversation was remarkable. But her movements and manners seemed unnatural and calculated to produce effect. But after she had been with father for some time she soon quietened down and then her own true self came out.’

আনা এসেছিলেন ঝড়ের মত। প্রাচ্যের কবিকে জয় করতে চেয়েছিলেন তিনি। ফিরে গেলেন যখন, তখন তিনি গীতাঞ্জলির স্রষ্টার একান্ত ভক্ত। রথীন্দ্রনাথ লিখছেন:

‘Before she left she confessed to father that she had come to conquer but all her vanity had vanished on meeting him, and she was going away a devotee and a worshipper’.

কবির সঙ্গে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আনা তাঁকে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিয়েছেন দিন আর রাত্রির আলো। সে আলো- গীতাঞ্জলি।

আর কবি? তাঁর কেমন লেগেছিল আনা-কে? ‘রবীন্দ্রজীবনী’তে প্রভাতকুমার জানালেন:
‘এই বিদুষীর কথাবার্তা, মনস্বিতা কবিকে খুবই আশ্চর্য ও মুগ্ধ করে।’

তখনও কি কেউ জানতেন, ইতিহাসের এক আশ্চর্য বাঁকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর আনা কঁতেস ম্যাতিউ দ্য নোয়াই- দুই রবি-অনুরাগিণী বিনি-সুতোর এক অদৃশ্য মালায় গ্রথিত হয়ে যাবেন কোনদিন?

প্যারিসের সঙ্গে এক আশ্চর্য ভাল লাগার সম্পর্ক ছিল কবির। তাই ফিরে ফিরে আসতেন। ১৯২০ সালে কবি যখন ইউরোপ ভ্রমণে, তখন La Nacion-এ প্রকাশিত হচ্ছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-র লেখা। ১৯২১ সালের ১৬ এপ্রিল আবার প্যারিসে এলেন কবি। সঙ্গী পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীসহ মোট বারোজন। প্যারিসে তাঁকে স্বাগত জানালেন আলব্যর কান। গোলিয়াথ নামে ছোট একটি বিমানে করে কবির প্যারিসে অবতরণের দৃশ্যটি এখানে দেখা যাবে।

১৯২৪ সালে La Nacion পত্রিকায় প্রকাশিত হল ভিক্টোরিয়ার প্রবন্ধ- ‘রবীন্দ্রনাথ পড়বার আনন্দ।’ এর কিছুদিন পরেই কবির সঙ্গে সাক্ষাত হয় ভিক্টোরিয়ার। আর্জেন্তিনার সান ইসিদ্রো-তে।

১৯৩০ সাল। কবি আবারও গেলেন প্যারিসে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর আঁকা চারশো ছবি।

‘পিতৃস্মৃতি’-তে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন:

‘১৯৩০ সালে বাবা আবার যখন প্যারিস যান, সঙ্গে ছিল তাঁর আঁকা কিছু ছবি। ছবি দেখে কয়েকজন ফরাসি শিল্পী বাবাকে একটা চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, চট করে প্যারিস শহরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা অসম্ভব বললেই হয়। মোটামুটি একটা পছন্দসই হল পেতে হলে বছর খানেক আগে থেকে চেষ্টাচরিত্র করতে হয়। বাবা সেনিওরা ওকাম্পোকে তারযোগে অনুরোধ জানালেন তিনি এসে যেন বাবার সহায় হন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে এলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হল বিনা আয়াসেই প্রদর্শনীর সব রকম ব্যবস্থা তাঁর সাহায্যে হয়ে গেল’।

ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত জীবনে বেশ ঝড় বয়ে গেছে তার আগে। সেসব ভুলে জীবনকে আবারও নিজস্ব ছন্দে ফিরিয়ে আনতে তিনি তখন প্যারিসেই। সময় কাটাচ্ছেন বন্ধুদের সঙ্গে। কবির আহ্বান পেয়ে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আর অত্যন্ত সুচারুভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলেন ভিক্টোরিয়া। কবি স্বয়ং চিঠিতে প্রতিমাদেবীকে জানালেন,
‘ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত, তাহলে ছবি ভালই হোক আর মন্দই হোক, কারো চোখে পড়ত না। একদিন রথী ভেবেছিল ঘর পেলেই ছবির প্রদর্শনী আপনিই ঘটে – অত্যন্ত ভুল। এর এত কাঠখড় আছে যে সে আমাদের অসাধ্য- আঁন্দ্রের পক্ষেও। খরচ কম হয়নি – তিন চারশো পাউন্ড হবে। ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্চে। এখানকার সমস্ত বড় বড় গুণীজনদের ও জানে – ডাক দিলেই তারা আসে। কঁতেস দ্য নোয়াইও উৎসাহের সঙ্গে লেগেচে – এমনি করে দেখতে দেখতে চারিদিক সরগরম করে তুলেচে। আজ বিকেলে দ্বারোদঘাটন হবে – তারপরে কি হয় সেটাই দ্রষ্টব্য…’

১৯৩০-এর ২রা মে মাসে প্যারিসের গ্যালারি পিগাল (Pigalle)-এ কবির আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনীর উদ্বোধন। একশ ছাবিবশটি ছবি ছিল সেখানে। ভিক্টোরিয়ার অনুরোধে প্রদর্শনীর ব্রোশিয়র লিখলেন আনা কঁতেস ম্যাতিউ দ্য নোয়াই। আঁদ্রে জিদ আর পল ভ্যালেরিকেও আনা নিয়ে এলেন কবির সেই প্রদর্শনীতে। রবীন্দ্রনাথের ছবির এক অসামান্য আলোচনায় আনা জানালেন:

‘বিস্ময়কর এই সৃষ্টিগুলি, যা একাধারে চোখ জুড়োয় আর আমাদের টেনে নিয়ে চলে বহু দূরের সেই সব দেশে, যেখানে কাল্পনিক বস্তুই বাস্তবের চেয়ে বেশি করে বাস্তব। ভেবে চমৎকৃত হতে হয় কী করে যুক্তিবাদী স্বপ্নপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ এই সৃষ্টির দ্বার খুলে দিলেন!’

তারপর লিখলেন:

‘I love you and have more admiration for you, Tagore, since when you made to us such rich and sometimes such cruel confidences; but would I ever find again the great ingenuous angel that you were, when your silent feet, on the garden gravel, made me think of my sins, imaginary perhaps, and of your sublime innocence?’

কবির ভাবনা ছিল, তাঁর ছবিগুলিকে প্যারিসের শিল্পরসিকরা না জানি কীভাবে গ্রহণ করবেন! যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তা মোটেই সামান্য নয়। চিত্রশিল্পী আঁদ্রে কার্পেলেস, পল ভ্যালেরি কিংবা আঁদ্রে জিদ-এর মত বিশেষজ্ঞরা ছবিগুলোকে চিহ্নিত করলেন ‘আগামীদিনের শিল্প’ হিসেবে। প্যারিসের সফল প্রদর্শনীর পর প্রদর্শনীর প্রস্তাব এল লন্ডনে আর বার্লিন থেকেও। সে সময়টায় আনন্দে একেবারে শিশুদের মত উৎফুল্ল ছিলেন কবি। নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখলেন:

‘আজ আমার জার্মানীর পালা সাঙ্গ হল, কাল যাব জেনিভায়। এ পত্র পাবার অনেক আগেই জানতে পেরেছ যে, জার্মানিতে আমার ছবির আদর যথেষ্ট হয়েছে। বার্লিন ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে। এই খবরটার দৌড় কতকটা আশা করি তোমরা বোঝো। ইন্দ্রদেব যদি হঠাৎ তাঁর উচ্চৈঃশ্রবাঃ ঘোড়া পাঠিয়ে দিতেন আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য তা হলে আমার নিজের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতুম’।

কবির সার্ধ শতবর্ষ উপলক্ষে প্যারিস, বার্লিন, রোম, লন্ডন আর শিকাগো আর দিল্লি-তে তাঁর নির্বাচিত ছবি নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিলে ভারত সরকারের উদ্যোগে-  “The Last Harvest” প্যারিসের প্রদর্শনীটি হয়েছিল Patit Palais-এ।

জার্মানী যাবার আগে ১৯৩০ সালের ১১ই মে প্যারিসে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কাছ থেকে বিদায় নিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্যারিসের গার দ্যু নর রেলস্টেশনের ছবিতে ধারণ করা আছে তাঁদের সেই শেষ বিদায়ের দৃশ্য। প্যাট্রিশিয়া স্টেইনার লিখেছেন, “রেলস্টেশনে তোলা বিখ্যাত সেই ছবিতে তাঁদের দেখাচ্ছিল ম্লান এবং বেদনার্ত”। এরপর ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে কবির আর সাক্ষাত হয়নি কখনো।

“রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি কি প্যারিসের কোনও মিউজিয়ামে আছে?”

সুমনার মত আমারও মনে এল প্রশ্নটা তখনই। ও অবশ্য জিজ্ঞেস করছিল সৌরকে। মাথা নাড়ল সৌর। জানে না। রিনি একটা চান্স পেল এবার।

“এটা সৌর-র কমন পড়েনি। যা মুখস্থ করে এসে পণ্ডিতি ফলাচ্ছে, সেখানে এটা ছিল না। তাই নারে নন্টে?”
কথায় কথায় পৌঁছে গেছি মেট্রো স্টেশনে। দিনের আলো আরও অনেকক্ষণ থাকবে। আলো ঝলমল রাস্তা। দুপাশে রেস্তোরাঁর বাইরে চেয়ার পেতে নানা বয়সী মানুষ। ভেতরে নয়, বাইরেই বসে সবাই। ওয়াইন, চিজ আর খাবার নিয়ে গল্পে মশগুল। মুগ্ধতা নিয়ে সন্ধের প্যারিসে দেখতে দেখতে মনে হল, আমরাও চেয়ার টেনে বসে পড়ি কোথাও। আজকে নাহয় বাইরেই খাওয়া যাক।

মেনু কার্ড দিয়ে চলে যাচ্ছিল ফরাসি তরুণটি। আবারও ডাকতে হল। ফরাসি, হিব্রু, ল্যাটিন সবই সমান আমাদের কাছে।

“ডু ইউ হ্যাভ ওয়ান ইন ইংলিশ?”

ঘাড় নেড়ে বলল, নেই!

তাহলে উপায়? ভাঙা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দেবার জন্যে ভেতর থেকে ডাকতে গেল একজনকে। ততক্ষণে রিনির চোখ পড়েছে, কয়েকটা আইটেমের পাশে ছবি আছে। সিদ্ধান্ত নিল, যাই-ই বোঝাক, ও অর্ডার দেবে ছবি দেখে।

পরের গোটা দিনটা সময় আছে, তার পরের সন্ধেতেই কনফারেন্স শুরু। কোথায় যাওয়া যায়, ঠিক করতে গিয়ে ভাবছিলাম, ল্যুভর না অন্য কোথাও!

অনি বলল, “ভাবা যায়! স্বয়ং রদ্যাঁ তাঁর ভাস্কর্যে আনা-কে আগামীকালের কাছে অমর করে দিয়ে গেছেন!”

খুব সত্যি! অগুস্ত রদ্যাঁ শুধু একজন শিল্পী নন, একজন ভাস্কর নন, একা একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বের শিল্পকলার নিরিখে মাইকেল এঞ্জেলো ছাড়া আর কোন ভাস্কর এমন সম্মান পান নি। প্যারিসে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল অসংখ্য ফরাসি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীর। প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’ থেকে জানা যায়, রদ্যাঁর সঙ্গে সাক্ষাতেও সবিশেষ আগ্রহী ছিলেন কবি। কলকাতায় কবির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দার্শনিক কাউন্ট হারমেন কাইজারলিং-এর। কাইজারলিং কবিকে লিখেছিলেন:

‘বলেছিলেন আপনি রদাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চান। তিনি আগামীকাল আসছেন চায়ে, মঙ্গলবার ৫টায় প্রিন্সেস লিচোনস্কির ৯ কার্লটন হাউস টেরাস-এ।… প্রিন্সেস আমার খুবই ভালো বন্ধু, চমৎকার মহিলা, তিনি আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হবেন। সেখানে তিনি, আপনি, রদ্যাঁ, আমি এবং হয়তো আমার বোন থাকবেন।’

সম্ভবত অসামান্য এই দুই প্রভিভার সাক্ষাৎকারটি ঘটেছিল, কিন্তু তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।
ঠিক হল, পরের দিন সকালে আমাদের প্রথম গন্তব্য Musée Rodin।

তথ্যসূত্র:
রবিজীবনী: প্রশান্তকুমার পাল।
ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ: শঙ্খ ঘোষ।

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।